আজ দিল্লির ৭০টি আসনে ভোট হবে। তার জন্য খোলা হয়েছে মোট ১৩,৭৬৬টি কেন্দ্র। যেখানে ভোটগ্রহণ করা হবে। এক কোটি ৫৬ লক্ষ ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তার মধ্যে ৮৫ লক্ষ ৭৬ হাজার পুরুষ, ৭২ লক্ষ ৩৬ হাজার মহিলা এবং ১,২৬৭ জন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার। ভোটের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়েছে ২২০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। এছাড়াও সাড়ে ৩৫ হাজারের বেশি দিল্লি পুলিস এবং ১৯ হাজার হোমগার্ড মোতায়েন থাকবে বিভিন্ন বুথে।
গত ২৫ বছর ধরে দিল্লির ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা বিজেপির হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মতো হেভিওয়েট নেতারা। দিল্লি জুড়ে মোট ২২টি রোড শোয়ের আয়োজন করে পদ্মশিবির।
এই ভোটচিত্র দেখলেই একটা গ্রামীণ প্রবাদ মনে পড়ে যাচ্ছে। কারণ, দিল্লিতে আপ এবং পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের যে যে বিষয়গুলো রাম-বাম-কং-দের চোখে একটা বিষম বিদ্রুপোযোগী বলে মনে হচ্ছিল, সেগুলোই এবারকার ইন্দ্রপ্রস্থ সমরে পদ্মপক্ষের শঙ্খ, গদা, সুদর্শনচক্র।
‘উন্নয়নের পথ’ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি (ইনক্লুসিভ পলিটিক্স)-র ভিত গড়ার লক্ষ্যে যে ‘সংকল্প পত্র’ (পড়ুন ‘নির্বাচনী ইশতেহার’) প্রকাশ করেছেন, তাতে মহিলাদের আড়াই হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নারীর সশক্তিকরণের জন্য পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সেই জনহিতকর প্রকল্পকে ‘ভিক্ষের দান’ বলতে ছাড়েননি। মহিলা ভোটাররা বিজেপির মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছিল। সেই চরম অভিজ্ঞতার পরম আলোকে দীপ্র বিজেপি মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে যথাক্রমে ‘লাডলি বহেনা’ ও ‘লড়কি বহিন’ যোজনা চালু করে ভোটযুদ্ধে ফসল তুলেছে।
এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট আপ। নিখরচতায় বিদ্যুৎ, জল ও বাস পরিষেবা প্রদানের ঘোষণা করে তারাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মোদি শাহদের বিদ্রুপ ও সমালোচনার শিকার হয়েছিল। দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার তো পরোক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচক্ষণতার প্রতি, তাঁদের জনহিতকর প্রকল্পের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন। বিজেপি সেটা অস্বীকার করবে কোন আক্কেলে? অস্বীকার করার উপায়
নেই যে, তথাকথিত ‘খয়রাতি নীতি’র নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখাটাই এখন নরেন্দ্র মোদির গ্যারান্টি। আপদের নীতিই মোদির বাঁচার জন্য খড়কুটো। কাদের মধ্যে বিলি হবে নগদ অর্থ? প্রাপকের তালিকায় মহিলা থেকে বয়স্ক নাগরিক, সবাই আছেন। সর্বস্তরের নাগরিককে ছুঁতে চাইছে বিজেপি।
শুধু মহিলাদের মাসিক ভাতা ২,৫০০ টাকা করা নয়, পাশাপাশি গ্যাসের দাম ভর্তুকি দিয়ে ৫০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে বিজেপি। হোলি আর দেওয়ালিতে নিখরচায় মিলবে একটা করে সিলিণ্ডার। বয়স্ক নাগরিকদের অবসরকালীন ভাতা ২০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতিও আছে তাদের ঝুলিতে।
আরও পড়ুন: আজ শুরু বিজিবিএস, থাকছেন ৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধি
এখানেই উঠছে প্রশ্ন। যদি কেজরিওয়ালের বিনা ভাড়ায় বাসে যাতায়াতের সুযোগ নিশ্চিত করাটা অপদের অপব্যয় হয়, তবে মোদিজিদের এসব প্রকল্প বাবদ খরচও তো অনর্থক ব্যয়ের বোঝা। সরকারের ব্যয়ের বোঝার ওপর শাকের আঁটি। আর তাই যদি হবে, তবে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মোদিপক্ষ সেই পথে হাঁটছেন কেন? মানুষের আস্থা পেতে বিজেপির রেওড়ি-রাজনীতি ঠিক আর মানুষের আস্থা ধরে রাখতে মমতা কিংবা কেজিরিওয়ালদের নগদ সুবিধা সরাসরি হস্তান্তরের রাজনীতির ওপর নির্ভর করাটা অনুচিত, এ আবার কেমন কথা! এ তো, এক কথায় দ্বিচারিতা।
এই দ্বিচারিতা স্পষ্টতর হয় যখন দেখি ও জানি, যে বিজেপি দিল্লিতে কেজরিওয়ালের নিখরচায় বাস পরিবহণ পরিষেবা চালু রাখতে আগ্রহী, তারাই পশ্চিমবঙ্গের বাস পরিষেবার ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান নিচ্ছে। এ রাজ্যে বাসে ভর্তুকি তুলে দিয়ে সরাসরি। সরকারি কর্পোরেট সংস্থার হাতে বাস পরিবহণ ব্যবস্থার রাশ তুলে দিতে চায় তারা।
এই পরস্পর-বিরোধী অবস্থান বুঝতে ও বোঝাতে একটি গবেষণাপত্রের কথা বলা প্রয়োজন।
সম্প্রতি কে কে কৈলাস এই জনকল্যাণমূলক সামাজিক প্রকল্পের ভোট রাজনীতিতে অভিঘাত নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। ২০২৪-এ প্রকাশিত ‘দ্য পলিটিক্স অব ওয়েলফেয়ার : দ্য বিজেপি অ্যান্ড দ্য ডিসার্নিং ভোটার’ শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মাঝখানে যাকে ‘রেওড়ি রাজনীতি’ বলে ব্যঙ্গ করছিল বিজেপি সেটা ভারতে স্বাধীনতার পর থেকেই চালু ছিল। সামাজিক শক্তিগুলো সবসময় আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে। তাই গরিবি হটানোর উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল এই ধরনের জনকল্যাণকর ব্যবস্থা। পরে যখন বাজার অর্থনীতি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ব্যবস্থাটাকেই নড়বড়ে করে দিল, তখন ক্রমাগত বাড়তে থাকা আয় বৈষম্যের প্রতিষেধক হিসেবে এই ধরনের ‘খয়রাতি’ দরকার হয়ে পড়ল। আয় বৈষম্যের বিরাট হাঁ বোজাতে অর্থনৈতিক সংস্কারের অনস্বীকার্য উপাঙ্গ হয়ে উঠল এই ধরনের প্রকল্পগুলো।
কে কে কৈলাস আরও দেখিয়েছেন, নগদ সুবিধা হাতে পেলেই যে ভোটাররা গদগদ হয়ে দাতা রাজনৈতিক দলকে ভোট দেবে, তেমনটা মোটেই নয়। যদি ভোটারের আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক হয় আর পাশাপাশি ওই ধরনের সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা তিনি বিশেষ কোনও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পান তবে সুবিধা প্রদানকারী সরকার বা রাজনৈতিক দল প্রতিপক্ষের থেকে অন্তত ১৫ শতাংশ অধিক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে। আর যদি ভোটার তাঁর নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকেন, তবে সহজে এ ধরনের সুবিধা পাওয়া গেলেও তিনি বিরোধী পক্ষে ভোট দেন। এটাই দস্তুর।
এই চালচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিজেপির ঢোঁক গেলা, ডিগবাজি খাওয়া, এসব দেখে পূর্বোল্লিখিত গ্রামীণ প্রবচন ছাড়াও, শঙ্খ ঘোষেরই কবিতার চারটে লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে।
“হঠাৎ কখনো যদি বোকা হয়ে যায় কেউ, সে তো নিজে আর / বুঝতে পারে না। কেউ যদি বুঝতই তাহলে তো বুঝদারই / বলা যেত তাকে। তাই যদি, তবে / তুমিও যে বোকা নও কীভাবে তা বুঝবে বলো তো?”
বোকা হোক বা চালাক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতি টুকলি করে দিল্লির ভোটে বিজেপির চেষ্টা প্রমাণ করে দিল, ভোট হওয়ার আগেই নীতিগতভাবে হেরে গেছে তারা। তাই তাদের প্রচারিত বুলির কোনও দাম নেই।