গুলেন বারে সিনড্রোম (Guillain-Barre Syndrome) একধরনের অটোইমিউন রোগ বা ডিজিজ। অটোইমিউইন ডিজিজ হল এমন এক রোগ যেখানে নিজের কোষকেই চিনতে পারে না শরীর। ফলে শরীরের কোষগুলো একে অপরের শত্রু হয়ে ওঠে।
জি বি সিনড্রোম কী?
এটি হল অ্যাকিউট ইনফ্ল্যামেটরি ডিমায়েলিনেটিং পলির্যাইডিকিউলোনিউরোপ্যাথি (এআইডিপি) অথবা Acute Motor Axonal Neuropathy (AMAN) বা Acute Motor-Sensory Axonal Neuropathy (AMSAN)। এই অবস্থায় আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের দেহের পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এটি মস্তিষ্ক আর মেরুদণ্ডের বাইরের স্নায়ুতন্ত্রের অংশ। এই স্নায়ুগুলোর আচ্ছাদন হল মাইলিন শিথ। যাকে আক্রমণ করে এই রোগ।
কী থেকে হয়?
যে কোনও সংক্রমণ থেকে এর সূত্রপাত হয়। বিশেষ করে রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন এবং ডায়রিয়া। মূলত ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি নামক ব্যাকটেরিয়া দায়ী। এই ব্যাকটেরিয়ার কাজ হল ডায়রিয়া করানো। অর্থাৎ এটি খাদ্যনালিতে সংক্রমণ ঘটায় এবং পেটখারাপ হয়। আমরা অনেকেই এক দু-দিন পেটখারাপ হলে খুব একটা গুরুত্ব দিই না। অনেক সময় না বলেকয়ে ওষুধ খেয়ে ফেলি এর ফলে প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া সেরে গেছে মনে হলেও রোগের ব্যাকটেরিয়া সম্পূর্ণ নির্মূল হয় না শরীরে রয়ে যায়। এখানেই হয় যত সমস্যা। এছাড়াও এপ্সটেইন বার ভাইরাস, জিকা ভাইরাস, কোভিড-১৯ ভাইরাস ইত্যাদিও জিবি সিনড্রোম করতে পারে। ওই ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া থেকে সুরক্ষিত রাখতে আমাদের দেহ নিজে থেকে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে। এই অ্যান্টিবডিগুলোই নার্ভ টিস্যুকে আক্রমণ করে। ফলে পেট খারাপ হবার এক-দুই সপ্তাহের পর হঠাৎ কোনও একদিন সকালে দেখা গেল পা ফেলতে অসুবিধে হচ্ছে। হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য থাকছে না এবং ধীরে ধীরে পা অসাড় হতে থাকছে। এই রোগে প্রথমে পা আক্রান্ত হয় তাই একে বলা হয় অ্যাসেন্ডিং প্যারালিসিস। কারণ প্রথমে পা থেকে এরপর মাথার দিকে যায়।
বোঝার উপায় কী?
এখন তো হরদম জ্বর সর্দি কাশি হয়, টুকটাক পেট খারাপ লেগেই আছে তাহলে বোঝার উপায় কী যে কখন এই রোগটি হানা দেবে? সমস্যাটা এখানেই। আমাদের হাজার একটা সংক্রমণ ঘটতে পারে কিন্তু বোঝার কোনও উপায় নেই যে কোনও সংক্রমণের ফলে জি বি সিনড্রোম হতে পারে। তাই যে কোনও সংক্রমণ যত হালকাই হোক না কেন চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। এমনটা নয় যে সবক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক খেতেই হবে কিন্তু গাফিলতি চলবে না।
হঠাৎ কেন বাড়বাড়ন্ত?
এই রোগ বহু আগে থেকেই ছিল হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনও সমস্যা নয়। কিছু নির্দিষ্ট কারণ বাদ দিলে কোভিড ১৯-এর পরেও অনেকের জিবি সিনড্রোম দেখা গেছে। করোনার ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও দেখা গেছে। এখন মানুষ রোগ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন বলে বিষয়টা হঠাৎ নজরে আসতে শুরু করেছে।
উপর্সগ
প্রথমে হঠাৎ পা-ব্যথা দিয়ে শুরু হয় এবং পা অসাড় হতে থাকে।
ধীরে ধীরে যন্ত্রণা যায় হাত পর্যন্ত। হাত অসাড় হতে থাকে।
চোখে দেখতে বা চোখের পাতা ফেলতে সমস্যা হয়। প্রচণ্ড মাথাব্যথা বা গা-ব্যথা হতে পারে।
ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা মুখের অংশে পক্ষাঘাতও হতে পারে (মিলার ফিশার সিনড্রোম)।
কথা বলতে, ঢোঁক গিলতে অসুবিধে হয়
কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মুখ থেকে শুরু হয় পক্ষাঘাত সেটা ধীরে ধীরে পা পর্যন্ত যায়।
পনেরো দিনের মধ্যে এই উপসর্গ প্রকট হয়ে ওঠে। এই রোগে শ্বাসনালির পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
মাইল্ড বা হালকা অ্যাটাক হলে উপসর্গ তিন-চারদিন থাকে। তারপর ধীরে ধীরে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়।
তবে সিভিয়র হলে রোগীকে ভেন্টিলেশনে পর্যন্ত দিতে হতে পারে। তাই উপসর্গ বুঝে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান।
কী টেস্ট?
পক্ষাঘাত হলে প্রথমেই সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া হয়। তাই আগে সিটি স্ক্যান এবং এম আর আই করে নিতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে বিষয়টা।
মেরুদণ্ডের এমআরআই করা যেতে পারে পায়ের পেশির দুর্বলতার ক্ষেত্রে।
এরপর ইলেক্ট্রোমায়োগ্রাম নার্ভ কনডাক্ট ভেলোসিটি টেস্ট বা ইএমজি-এনসিভি করা যেতে পারে। এতে রোগটা ধরা পড়ে।
চিকিৎসা
রোগীকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে। উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। দু-রকম চিকিৎসা করা হয় এক্ষেত্রে। গামা ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইন্ট্রাভেনাস। অপরটি প্লাজমা থেরাপি বা প্লাজমা এক্সচেঞ্জ করা হয়। এর সঙ্গে রোগীর আর যা যা সমস্যা রয়েছে তার সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট চলতে থাকে। যেমন রোগীর যদি শ্বাসকষ্ট থাকে তবে অক্সিজেন দেওয়া। যে অঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়েছে তার জন্য ফিজিওথেরাপি চালু করা ইত্যাদি। মূলত প্যারালিসিসের রোগীকে যা করা হয় মূল চিকিৎসার সঙ্গে সেগুলো চলতে থাকে।
আতঙ্কিত হবেন না
৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে জি বি সিনড্রোম সিভিয়র হয় না। ৫ থেকে ১০ শতাংশ সিভিয়র কেস হয় সেক্ষেত্রেও রোগী একশো শতাংশই রিকভার করে। কিছু ক্ষেত্রে সিরিয়াস হয়ে যেতে পারে। তাই অযথা আতঙ্কিত হবেন না।
জি বি সিনড্রোম ছোঁয়াচে রোগ নয়, এর থেকে অন্যের মধ্যে বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায় না। এটা কার হবে কেউ জানে না।
শীতকালে শীতকালীন ডায়রিয়া কমন তাই ডায়রিয়া হলেই গুলেন বারে হবে এটা ভাবারও কোন কারণ নেই।
ডায়রিয়া বা যে কোনও সংক্রমণ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ করুন।
হাত ভাল করে ধুয়ে নিন। কাটা ফল, স্যালাড, বাসি খাবেন না, প্যাকেটজাত মাছ, মাংস না খাওয়াই ভাল। পনির, চিজ বেশি না খাওয়াই ভাল। কাঁচা বা অপরিশোধিত দুধ এড়িয়ে ফোটানো বা প্যাকেটজাত দুধ পান করুন।
সুসিদ্ধ হওয়া রান্না খান। বিশেষ করে চিকেন, মাটন। ভাত বেশি খাবেন না। প্রোবায়টিক খাবার, যেমন টকদই খান নিয়মিত।