প্রতিবেদন : ২০২১ এর আবহাওয়াটাই যেন ঠিকঠাক কাটছে না! গ্রীষ্মকাল জুড়েই রইল প্রবল তাপপ্রবাহ, হাঁসফাঁস করা গরম। তারপর বর্ষা পড়তেই তুমুল বারিধারা, চলল মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত। জলবর্ষণ থামেই না! এবার শীতের খেলা দেখানোর পালা। আবহবিদরা বলছেন, এবার নাকি অতিরিক্ত হাড়কাঁপুনি শীত আর শৈত্যপ্রবাহ দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে উত্তর ভারতে শীতকাল প্রবল কম্পন ধরাবে, এমনটাই ভবিষ্যদ্বাণী। কারণ, দুর্বল হচ্ছে এল নিনো। তাই এবার ঋতুচক্রের উপর প্রভাব বাড়ছে লা নিনার। যার জের পড়তে চলেছে উত্তর ভারতের শীতকালীন আবহাওয়ায়। আবহবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি মাসে সেখানকার বিস্তীর্ণ অংশের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে আরও প্রায় ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নিচে চলে যেতে পারে। আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ডিটিএন-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট রেনি ভ্যান্ডেওয়েজ জানিয়েছেন, আমাদের অনুমান লা নিনার প্রভাবে এবারের শীতে উত্তর-পূর্ব এশিয়া জুড়ে ঠান্ডা অনেকটাই বেশি পড়বে। ২০২২ এর মধ্য ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত শীতের প্রবল কনকনে ভাব থাকার সম্ভাবনা ৮৭ শতাংশ।
এখানে এখনও তেমন বোঝা না গেলেও উত্তর ভারতে কিন্তু এই প্রভাব ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ভারতের পির পাঞ্জাল রেঞ্জের বর্ধিত অংশ অর্থাৎ ধউলাধর রেঞ্জের কোলে সম্প্রতি ভালই তুষারপাত হয়েছে। কাশ্মীরের গুলমার্গ, শোনমার্গ, পহেলগাঁও, সোপিয়ান ও গুরেজ এলাকায় ভালই ঠান্ডা পড়ে গেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকেই এবার শুরু হয়েছে মাঝারি তুষারপাত, যা অন্য বছর, আরও ক’দিন পড়ে শুরু হয়। সেইসঙ্গে এবার, অতিরিক্ত বর্ষণ যেন তাপমাত্রা আরও কমিয়ে রেখেছে। দিল্লির হাওয়া অফিস সুত্রে জানানো হয়েছে, এই বছর, উত্তরাখণ্ডেই ১-২১ অক্টোবর, পাঁচগুণ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। অক্টোবরে যেখানে ভারতে, গড়ে, ৬০.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, এ বছর সেটাই হয়েছে ৮৪.৮ মিলিমিটার।
প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে ঘটে যাওয়া এনসো (ENSO) চক্রের দুটি বিপরীত অবস্থা হল এল নিনো ও লা নিনা। প্রশান্ত মহাসাগরের নিরক্ষীয় পূর্ব উপকূলে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা ও ১২০ ডিগ্রি পশ্চিম দ্রাঘিমাংশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সমুদ্র ও বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রার মধ্যে অস্থিরতাকে বোঝাতে এনসো শব্দটি ব্যবহার করা হয়। লা নিনা দ্বারা শীতল অবস্থা এবং এল নিনো দ্বারা উষ্ণ অবস্থা বোঝানো হয়।
এল নিনো (El Nino) কী?
আরও পড়ুন : আরও অনেক রান চান Mayank
‘এল নিনো’ শব্দটি স্পেনীয় শব্দ। যার অর্থ শিশু খ্রিস্ট (Christ Child)। ডিসেম্বর মাসে বড়দিনের সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে সৃষ্ট উষ্ণ সমুদ্রস্রোতকে এল নিনো বলে। দক্ষিণ আমেরিকা সংলগ্ন প্রশান্ত মহাসাগরের পেরু উপকূলে অস্থির উষ্ণ সমুদ্রস্রোত হল এল নিনো। এর উৎপত্তির কারণ ৩টি।
১) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার পার্থক্য অর্থাৎ পূর্বভাগের তুলনায় পশ্চিমভাগের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্রপৃষ্ঠে একটি পূর্বমুখী ঢালের সৃষ্টি হয়। উষ্ণ সমুদ্র স্রোত রূপে দক্ষিণে এগোতে থাকলে এল নিনোর আবির্ভাব হয়।
২) প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে সামুদ্রিক শৈলশিরা থেকে ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাতের ফলে নির্গত তাপপ্রবাহ এল নিনো তৈরি করে।
৩) আবহবিজ্ঞানী ভি. বার্কনেস-এর মতে প্রশান্ত মহাসাগরে কোনও উষ্ণ স্থানের উৎপত্তি হলে এল নিনোর আবির্ভাব হয়।
পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরেরে পেরু ইকুয়েডর উপকূল বরাবর কোনও কোনও বছর ডিসেম্বর মাসে যে এক প্রকার দক্ষিণমুখী উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রবাহ লক্ষ করা যায়, তাকে এল নিনো বলা হয়ে থাকে। এল নিনো একটি স্প্যানিশ শব্দ যার অর্থ ছোট্ট বালক বা যিশুর সন্তান। প্রতি ২ থেকে ১০ বছর অন্তর এবং গড়ে প্রায় ৪ বছর অন্তর এল নিনোর আবির্ভাব হয়ে থাকে। এল নিনোর ফলে সেই অঞ্চলের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হয়, উদ্ভিদ প্লাংটনের পরিমাণ হ্রাস পায় বলে মাছের উৎপাদন কমে যায়, যার ফলে পেরু, ইকুয়েডর ও উত্তর চিলির শিকারিরা অর্থনৈতিক ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। উষ্ণ স্রোতের প্রভাবের ফলে সেই অঞ্চলের জলবায়ুর পরিবর্তন হয় এবং এই পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে প্রচুর পাখি ও অন্যান্য অনেক ছোট- বড় প্রাণী মারা যায়।
আরও পড়ুন : এত খারাপ ফল ৪-৫ বছরে হয়নি, T20 বিশ্বকাপ নিয়ে সৌরভের তোপ
লা নিনা (La Nina) কী?
স্প্যানিশ শব্দ লা নিনার অর্থ হল ছোট্ট বালিকা। সাধারণত এল নিনোর বিপরীত অবস্থাই হল লা নিনা। সহজ ভাষায় ‘এক শীতল ঘটনা’। প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে পেরু উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলের স্বাভাবিক উষ্ণতা স্বাভাবিক উষ্ণতা চেয়ে ৪° সেলসিয়াস কমে গেলে যে শীতল সমুদ্র স্রোত প্রবাহিত হয় তাকে লা নিনা বলে। এর দরুন প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম দিকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তর অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে, অপরদিকে পূর্ব উপকূলে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকার পেরু ও ইকুয়েডর উপকূলে শুষ্ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। লা-নিনা অবস্থা ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।
দক্ষিণ আমেরিকায় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকায় মোটামুটি ভাবে ৩ থেকে ৭ বছর অন্তর এল নিনোর প্রভাব দেখা যায়। জলস্তরের (সি সারফেস) তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়। ফলে, উপকূলবর্তী এলাকার বায়ুমণ্ডলও তেতে ওঠে। সমুদ্রের সেই অতিরিক্ত তাপ নির্গত হয় সমুদ্রপৃষ্ঠের বাতাসে। তার জেরে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। ভারতেও একাধিকবার তার প্রভাব পড়েছে। আসলে, এক কথায়, এল নিনো সক্রিয় হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ে আর তা দুর্বল হলে বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় বাড়তে থাকে শীতলতা। তাকেই বলে লা নিনা। এ বছর লা নিনার প্রভাবে চিন, জাপান, কোরিয়ার মতো দেশে শৈত্যপ্রভাবের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রেনি। আপাত শান্ত প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে এসে উত্তর ভারত তো বটেই, ঠান্ডা বাতাস ঢুকে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশের তাপমাত্রা কমিয়ে দিতে পারে বলে তাঁর পূর্বাভাস। আর এই পূর্বাভাস মিলছে, কারণ শীতের শুরুতেই মাঝেমধ্যে প্রবল বর্ষণে উত্তর ভারতের পারদ এবার একটু বেশিই কমে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত গলছে পশ্চিম সাইবেরীয় অঞ্চলে, উত্তর মেরুর কারা সাগরের বরফ। ফলে, অতিরিক্ত হিমেল হাওয়ার সঙ্গে লা নিনার দাপট দেখতে আমাদের বোধহয় তৈরি থাকতেই হবে। এবার শীতটা বোধহয় একটু বেশিই পড়বে।