কী বলা যায় পঞ্চানন বর্মাকে? এক কথায়। সহজ করে। সম্ভবত একটিই শব্দবন্ধ এই ব্যাপারে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পঞ্চানন বর্মা ছিলেন নতুন সত্তা পরিচয়ের দিশারি। রাজবংশী জনজাতির মধ্যে শ্রেণি সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে।
আরও পড়ুন-উত্তরে ১০টি-সহ তৈরি হয়েছে ১২টি নয়া হিমঘর, বাড়ানো হবে আলু মজুতের পরিমাণ, সিদ্ধান্ত রাজ্যের
ঔপনিবেশিক ভারতে ১৮শ শতাব্দীর শেষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা প্রশাসনিক কাজে উচ্চবর্ণের লোকদের নিযুক্ত করত। ফলে, একসময় সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের হাতেই সমস্ত জমির মালিকানা এবং চাকরির সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সকল উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা কোচ রাজবংশীদের নিচু চোখে দেখত। সম্পন্ন রাজবংশী পরিবারগুলিও বর্ণবাদী হিন্দুত্ব প্রথার বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সেই আবহেই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিকভাবে ক্ষত্রিয় বংশজাত হিসেবে পরিচিতি লাভের তাগিদ দেখা দেয়। অন্ত্যজ শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কারণে রাজবংশীরা তখন সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে বাধ্য হয়েছেন, অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পাননি। জোতদার, মহাজন আর ব্রাহ্মণদের বঞ্চনা নীরবে মানতে বাধ্য হয়েছেন। এই রকম একটা কাল পর্বে, শুধু রাজবংশী নয়, শেখ মুসলিম সম্প্রদায়-সহ অপরাপর পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষের প্রেরণাদাতা ও পরিত্রাতা হিসেবে অবতীর্ণ হন পঞ্চানন বর্মা।
অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন রাজবংশী পরিবারে জন্ম তাঁর। তাই অনেক রাজবংশী শিক্ষাবঞ্চিত হলেও, পড়াশোনার সুযোগটুকু পেয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই সঙ্গে সংস্কৃতে স্নাতকোত্তর এবং ওকালতির পরীক্ষা পাশ করেন। ১৯০১-এ প্র্যাকটিস শুরু করেন রংপুর কোর্টে। সেখানেই অনুভব করেন অন্ত্যজ শ্রেণিভুক্তির কারণে বিচ্ছিন্নকরণের প্রবণতা। এক সঙ্গে খাওয়া তো দূর, কেউ কাছে বসতেও চাইত না। তাই পঞ্চানন জোর দেন প্রথাগত শিক্ষা, বিশেষত ইংরেজি জানার উপর। শুরু করেন রাজনৈতিক তদবির, যাতে রাজবংশী আন্দোলন পায়ের তলায় জমি পায়। ১৯০৬ সালের বরিশালের কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কলকাতায় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু আশানুরূপ ফল না পেয়ে, কোচবিহারে ফিরে আসেন। কোচবিহারের ভূপ রাজাদের সঙ্গে রাজবংশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈরিতা ছিল। তা সত্ত্বেও আয়োজন করেন মহামিলন সভার। সেখানে ব্রাহ্মণসমাজের অমত সত্ত্বেও অসংখ্য রাজবংশী সামাজিক ভাবে পৈতে ধারণের অধিকার গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন-শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালে শুরু লেজার সার্জারি
১৯২০-তে রংপুর নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত হন পঞ্চানন বর্মা। নির্বাচনে জয়লাভ তাঁকে অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিতে তো বটেই, ভারতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তিনিই প্রথম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মহিলাদের ভোটদানের অধিকার নিয়ে লড়াই করেন। আরও উৎসাহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজবংশীদের উন্নয়নে। রাজবংশী নারী-পুরুষ উভয়েরই শিক্ষাকে সমান গুরুত্ব দেন।
দলিত নারী-পুরুষের এতখানি আলোয় বেরিয়ে আসা মেনে নিতে পারেনি মূল সমাজ। শুরু হয় রাজবংশীদের উপর অত্যাচার, নারী অপহরণ। ততদিনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি প্রদান করেছে। তাই অন্যায় অবিচারের প্রত্যুত্তরে রায় সাহেব লেখেন কামতাপুরি ভাষার বিখ্যাত কবিতা— ‘ধাং ধারি মাও’। ‘নারী রক্ষা সমিতি’ স্থাপন করেন, রাজবংশীদের অস্ত্রশিক্ষা, লাঠিখেলা শেখানো শুরু করেন।
গ্রামীণ রাজবংশী সমাজে চিরকালই জোতদার ও মহাজনদের অত্যাচার ছিল। রুখে দাঁড়াতে, রায় সাহেব রাজবংশীদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। তৈরি হয় বর্মা কোম্পানি। ১৯২১-এ স্থাপিত হয় ক্ষত্রিয় ব্যাঙ্ক। তারা রাজবংশী চাষি ও ব্যবসায়ীদের কম সুদের হারে ধার দিত।
পঞ্চানন বর্মার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের পরবর্তী পর্যায় শুরু হয়েছিল ১৯৩০-র গোড়ায় বিশেষ করে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক (১৯৩০-৩২) ও তার ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা ও নিম্নবর্ণীয় হিন্দুদের জন্য কয়েকটি পৃথক আসন সহ নির্বাচকগোষ্ঠীর ব্যবস্থা গ্রহণের দ্বারা। জাতীয় কংগ্রেস-সহ অন্যান্য উচ্চবর্ণীয় হিন্দু প্রভাবিত রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থাকে হিন্দুদের মধ্যে বিভাজনের প্রক্রিয়া হিসাবে চিহ্নিত করে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার (Communal Award) বিরোধিতা করেছিল। অন্যদিকে বি আর আম্বেদকর (১৮৯১-১৯৫৬) পৃথক নির্বাচনের সপক্ষে সওয়াল করায় এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত পুনা চুক্তির (১৯৩২) দ্বারা ১৯৩৫-এর ভারতশাসন আইনে ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভায় (Legislative Assembly) তফসিলিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়।
আরও পড়ুন-ট্রাম্পের বড় ধাক্কা, ইউনুস প্রশাসনকে বন্ধ রাজনৈতিক উন্নয়নের অনুদান
রাজবংশী জনজাতি আলোর মুখ দেখেছিল পঞ্চানন বর্মার হাত ধরে। তাঁদের দাবি মেনে, ১৯২১ এবং ১৯৩১ সালের জনগণনায় তাঁদের উল্লেখ করা হয় ক্ষত্রিয় জাতি বলে। শিক্ষা এবং ইংরেজির প্রসার হয়। স্থাপিত হয় গ্রামীণ মণ্ডলী, যাতে একত্র হয়ে জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন রাজবংশীরা।
পঞ্চানন বর্মার অভিজ্ঞতা ও কার্যাবলীকে বাংলা-সহ ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গতিধারার মধ্যে আলাদা ভাবে আলোচনা করার প্রবণতা, পঞ্চানন বর্মাকে ‘ঠাকুর’, ‘মনীষী’, ‘মহাপুরুষ’, ‘রাজবংশী জাতির জনক’, ইত্যাদি; অভিধায় ভূষিত করেছে। তাঁর নামে সেতু, রাস্তা, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে তাঁর নামে চেয়ার অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি রাজবংশী ক্ষত্রিয় আন্দোলনের বৈধতার স্বীকৃতি হিসাবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র রাজবংশী জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে কখনওই তাঁর কার্যাবলীর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে না। আমরা তাঁকে দেখেছি সামাজিকভাবে নিপীড়িত জাতির আত্মমর্যাদা ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হতে। তাঁর হাত ধরেই অসংখ্য তথাকথিত পিছিয়ে পড়া মানুষের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল রংপুর সাহিত্য পরিষদের মূর্ত হয়ে ওঠা। তাই বলা যায় যে ‘পঞ্চানন বর্মার মতো মানুষেরা কথা বলতে জানেন, শাসক ও শাসিতের ভাষায় লিখতে জানেন, ন্যায়বিচারের আন্দোলন করতে জানেন, অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করতে জানেন, জানেন নারীর সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য নারীকেই প্রশিক্ষিত করতে’। তাই আমাদের মার্কসীয়, সাবলর্টানীয় ও দলিত ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে পঞ্চানন বর্মাকে বিচার করতে হবে।
মা মাটি মানুষের সরকারের উদ্যোগে সেই কাজটাই ইতিহাসনিষ্ঠ হয়ে করার চেষ্টা চলছে।