বায়োকম্পিউটিংয়ে ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগ

খালি চোখে যাদের দেখা দায়, তারা নাকি অংশ নেবে জটিল গাণিতিক গবেষণায়! বিজ্ঞানীদের এই প্রচেষ্টা নিয়েই হোক আজকের চর্চা। আলোচনায় প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

মাইক্রোস্কোপের সাহায্য ছাড়া যার অস্তিত্ব বোঝা দায়, সেই আণুবীক্ষণিক জীব নাকি করবে জটিল গবেষণা! সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমনই দাবি করছেন। জটিল হিসাবে অংশগ্রহণ করছে ক্ষুদ্র জীব। ভাবতে অবাক লাগলেও বিজ্ঞানীদের এই চেষ্টা কিন্তু সত্যি।
সম্প্রতি উঠে আসা একটি অভিনব কৌশল হল কোষ-ভিত্তিক বায়োকম্পিউটিং, যা যে-কোনও ধরনের গণনা সম্পাদনের জন্য কোষীয় প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। এই ধরনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বায়োকম্পিউটারগুলি প্রচলিত মাইক্রোপ্রসেসর-ভিত্তিক কম্পিউটারগুলির অনেক শক্তি, খরচ এবং প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলি অতিক্রম করতে সক্ষম। যদিও এই প্রযুক্তি এখনও মূলস্রোতে প্রবেশের অধিকার পায়নি, তবুও এই নিয়ে বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস কিন্তু তুঙ্গে। এই প্রযুক্তির মূল চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে অন্যতম হল এমন এক কোষ-ভিত্তিক সিস্টেম তৈরি করা যা জটিল গণনাগত সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে।
ভারতের সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের একদল গবেষক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা-সহ কোষ-ভিত্তিক এই বায়োকম্পিউটার তৈরি করতে জিনগতভাবে পরিবর্তিত ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করেছেন। এই গবেষকরা এমন ১৪টি প্রকৌশলী ব্যাকটেরিয়া কোষ তৈরি করেছেন, যার প্রতিটি একটি মডিউলার এবং কনফিগারযোগ্য সিস্টেম হিসেবে কাজ করে। তারা প্রমাণ করেছে যে উপযুক্ত মডিউলগুলিকে মেলানো-মেশানোর মাধ্যমে এমন এক বহুকোষী সিস্টেম তৈরি কর সম্ভব যেটি নটি হ্যাঁ/না গণনাগত সিদ্ধান্তের সমস্যা এবং একটি অপ্টিমাইজেশান সমস্যা সমাধান করতে পারে।
নেচারের কেমিক্যাল বায়োলজিতে বর্ণিত কোষীয় সিস্টেম মৌলিক সংখ্যা শনাক্ত করতে পারে, একটি প্রদত্ত অক্ষর, একটি স্বরবর্ণ কিনা তা পরীক্ষা করতে পারে, এমনকি সোজাভাবে কাটা নির্দিষ্ট সংখ্যক পিজার স্লাইসগুলির সর্বাধিক সংখ্যাও নির্ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন-দেউচা-পাঁচামির কাজ শুরু হয়েছে দ্রুতলয়ে, ১৪৩ জন পেলেন সংশোধিত পরচা

কীভাবে কোষভিত্তিক এই গণনাকার্য সম্পাদিত হয়
আমরা জানি, জীবিত কোষগুলি তাদের জৈবিক কাজ সম্পাদনের জন্য ‘গণনা’- কেই ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলি যে-কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে সংযোগসাধন করে এবং গণনা করে; আবার বাহ্যিক আক্রমণের ক্ষেত্রে, আমাদের অনাক্রম্য কোষগুলি গণনা করে এবং বিচার করে, প্রবিষ্ট জীবাণুদের ধ্বংস করে। তাই কোষীয় এই গণনাভিত্তিক গুণাবলিকেই কাজে লাগিয়ে চেষ্টা চালানো হচ্ছে বায়োকম্পিউটার তৈরি করার।
জীববিজ্ঞান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের সংমিশ্রণের ফলে কম্পিউটেশনাল সমস্যা সমাধানের জন্য জীবন্ত কোষভিত্তিক জৈব কম্পিউটারের বিকাশ ঘটেছে। এখানে, জীবন্ত কোষগুলিকে বায়োকম্পিউটার তৈরির জন্য সার্কিট এবং উপাদান হিসাবে ব্যবহার করার জন্য ইঞ্জিনিয়ার করা হয়। ইদানীং, গবেষকরা গ্রাফ ও মেইজ-এর সমাধান খুঁজতেও কোষের সাহায্য নিচ্ছেন।

গণনাকার্য সম্পাদনের জন্য ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজন কেন
ব্যাকটেরিয়া হল এককোষী জীব, আকারে ২-৫ মাইক্রোমিটার, দ্রুত প্রতিলিপি সময় (প্রায় ৩০ মিনিট)। তারা যে-কোনও পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে এবং তাদের ন্যূনতম শক্তির প্রয়োজন হয়, তাদের এই অভিনব ক্ষমতা, অতি ক্ষুদ্র কম্পিউটার প্রযুক্তি গড়ে তোলার জন্য একটি আদর্শ কাঠামো প্রদান করে। বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে তারা যে ব্যাকটেরিয়াটিকে বেছেছেন সেটি হল আমাদের সকলের অতি পরিচিত এসচেরিশিয়া কোলাই, যা প্রকৃতিতে পাওয়া সহজ এবং এটি সহজেই পরিবর্তনযোগ্য।

আরও পড়ুন-বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির ফাঁসে জেরবার এদেশের আমজনতা

ব্যাকটেরিয়াকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়
গবেষকরা ব্যাকটেরিয়াতে কৃত্রিম জিন নিয়ন্ত্রক নেটওয়ার্কগুলি এমনভাবে তৈরি করেছেন যাতে প্রতিটি ব্যাকটেরিয়া একটি কৃত্রিম স্নায়ুসন্নিধি হিসেবে কাজ করতে পারে। এইভাবে, জিন প্রযুক্তিগত কৌশল দ্বারা ১৪টি ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা হয়েছিল, যাদের প্রতিটি একটি কৃত্রিম স্নায়ু বা নিউরোনের মতো কাজ করে, যাকে ‘ব্যাকটোনিউরোন’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। যখন এই ব্যাকটোনিউরোনগুলিকে একটি টেস্ট টিউবে একটি তরল কর্ষণ মাধ্যমে মেশানো হয়, তখন তারা একটি কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা গণনাগত সমস্যাগুলি সমাধান করতে পারে। ‘LEGO-এর মতো’ এই ১৪টি ব্যাকটেরিয়া কোষ (LEGO ব্লক) ছোট ছোট টুকরোর মতো কাজ করে ঠিক জিগস অব পাজল- এর মতো এবং এই টুকরোগুলো বিভিন্ন রীতিতে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে চাহিদা অনুযায়ী ১২টি নির্দিষ্ট গণনাগত সমস্যা সমাধান করতে পারে।

কীভাবে ব্যাকটেরিয়া
তাদের উত্তর দেয়
ব্যাকটেরিয়াদের উত্তরদানের প্রক্রিয়ায় সাধারণত বাইনারি সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। যেখানে হ্যাঁ বা না ভিত্তিক উত্তর দিয়ে থাকে ব্যাকটেরিয়া। আর এখানে হ্যাঁ হলে ‘এক’ এবং না হলে ‘শূন্য’ ধরা হয়। এরকম ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়াকে (এক) যোগ করে এবং (শূন্য) যোগ না করে একটি রাসায়নিক মাধ্যমে রেখে যেখানে চারটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থ উপস্থিত, প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ‘তিন’ মূল সংখ্যা কিনা। ব্যাকটেরিয়া কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক ডেটা বিশ্লেষণ করে এবং বিভিন্ন ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন তৈরি করে প্রতিক্রিয়া জানায় ‘হ্যাঁ’, এক্ষেত্রে এটি সবুজ রং-এর ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন ব্যবহার করেছিল।। একইভাবে, যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে ‘চার’ মূল সংখ্যা কিনা, তখন ব্যাকটেরিয়া লাল রং-এর ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন ব্যবহার করে জানান দিল ‘না’।

বায়োকম্পিউটার-এর
বাস্তব প্রয়োগ
মানুষের চুলের ব্যাসের কুড়িভাগের এক ভাগ হল এই ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া। সিলিকন কম্পিউটার এত ছোট তৈরি করা সম্ভব নয়, তাই ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এই ছোট কম্পিউটার তৈরি করলে মাইক্রোস্কেল কম্পিউটার প্রযুক্তিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। এর ব্যবহার নতুন চিকিৎসা প্রযুক্তি থেকে মহাকাশ প্রযুক্তি পর্যন্ত প্রসারিত হবে বলে আশা করেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহে একটি মানব গবেষণা ভিত্তিক ইন সিটু রিসোর্স ব্যবহার পরিমাপের জন্য জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করার প্রস্তাব করেছেন। এখন এমত অবস্থায় স্থানীয় অবস্থার উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করার জন্য প্রতিটি জীবকে দূর থেকে নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। তবে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড ব্যাকটেরিয়াগুলি একটি বায়োকম্পিউটার হিসেবে কাজ করে, একে অপরের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে কোনওরকম মানব হস্তক্ষেপ ছাড়াই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে।
মৌলিক বিজ্ঞানেও এই কাজের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা জানি যে মৌলিক সংখ্যা বা স্বরবর্ণ শনাক্তকরণ শুধুমাত্র মানুষ বা কম্পিউটার দ্বারাই করা যেতে পারে— কিন্তু এখন জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড ব্যাকটেরিয়াও এই একই কাজ করছে। এই ধরনের পর্যবেক্ষণগুলি ‘বুদ্ধিমত্তা’-র অর্থ সম্পর্কে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করে।
পরবর্তী পরিকল্পনা
বিজ্ঞানীরা মাল্টিটাস্কিং ক্ষমতা-সহ আরও জটিল গণনাকাজ সম্পাদন করতে আরও জটিল বায়োকম্পিউটার তৈরি করতে চায়। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান ব্যাকটেরিয়া তৈরি করা।

Latest article