মেয়েদের হার্টের অসুখ

জানেন কি? মেয়েদের হার্ট অ্যাটাকের (Heart Attack) সময় বুকে ব্যথা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম তীব্র হয়। তাই বুকে ব্যথা হালকা হলেও সচেতন থাকুন। বাড়ছে মহিলাদের হৃদরোগ। কিন্তু কেন? কীভাবে সুরক্ষিত থাকবেন? জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

নারী চরিত্র বেজায় জটিল। ওরা কোন ল মানে না। কী করে ল মেনে চলবেন মেয়েরা! এখন তাঁদের আকাশ থেকে পাতাল— সর্বত্র অবাধ বিচরণ। কেউ আর শুধুই গৃহবধূ নন। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে প্রায় সব্বাই স্বাবলম্বী। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সবটাই তাঁদের পেশা। বিশেষ করে রান্না আর খাওয়া। হেঁশেলকে হাতিয়ার করে মেয়েরা তরতরিয়ে বাড়িয়ে ফেলছেন ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। খাওয়াদাওয়া হোক বা রান্না। ফুড ব্লগ হোক বা ফুড রিভিউ পাক্কা ব্যবসায়ী হয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। পাশাপাশি ঘরকন্না, পরিবার, সন্তান তো আছেই।

আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যে নেপালি ছাত্রীর রহস্যমৃত্যু, ভুবনেশ্বরে দিল্লির দূতাবাসের কর্তারা

কিন্তু এত ধকল কি আর তাঁদের ছোট্ট হৃদয়ের সইবে? তাই যুগ যুগ ধরে যে হার্টের রোগে শুধু পুরুষের আধিপত্য ছিল এখন তা মহিলাদের মধ্যেও রমরমিয়ে বাড়ছে। ভারতবর্ষের যত মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে ২৫% শতাংশ হৃদরোগের কারণে হয়। সবচেয়ে দুশ্চিন্তার হল এঁদের মধ্যে মহিলাদের পরিসংখ্যান অনেকটাই বেশি। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে হার্টের অসুখে মহিলাদের মৃত্যু ঘটে প্রায় ১৮% যা স্তনক্যানসার বা অন্যান্য ক্যানসারের চেয়ে অনেকটাই বেশি। আমেরিকান কলেজ অফ কার্ডিওলজির জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে, বয়সের ওপর নির্ভর করে ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে করোনারি আর্টারি রোগের প্রকোপ ৩% থেকে ১৩% পর্যন্ত। ভারতীয় মহিলাদের হৃদরোগ উন্নতদেশের মহিলাদের চেয়ে অনেকটাই কমবয়স থেকে শুরু হয়।
মেয়েদের হার্টের অসুখের মধ্যে রয়েছে
করোনারি আর্টারি ডিজিজ
হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলি সংকীর্ণ বা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এটি হার্টের পেশিতে রক্তপ্রবাহ কমায় ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

করোনারি ধমনিতে খিঁচুনি
করোনারি ধমনিতে খিঁচুনি হতে পারে, অস্থায়ীভাবে হৃদপিণ্ডের পেশিতে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয় এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

করোনারি মাইক্রোভাসকুলার ডিজিজ
হৃৎপিণ্ডের ছোট রক্তনালিগুলিকে প্রভাবিত করে এবং হৃৎপিণ্ডের পেশিতে রক্তপ্রবাহ কমায়। বড় ধমনিতে হয়তো কোনও ব্লকেজ নেই তাও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

আরও পড়ুন-৪ বছরের শিশুকন্যাই ঘুরিয়ে দিল তদন্তের মোড়, ছবি এঁকে পুলিশকে জানাল, মাকে খুন করেছে বাবাই

ব্রোকেন হার্ট সিন্ড্রোম
একে স্ট্রেস-ইনডিউসড কার্ডিওমায়োপ্যাথিও বলে। তীব্র মানসিক বা শারীরিক চাপের প্রতিক্রিয়ায় ঘটতে পারে। এটি বুকে ব্যথা এবং শ্বাসকষ্ট-সহ হার্ট অ্যাটাকের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া মহিলাদের হার্টের রোগে রয়েছে আরও বেশকিছু কারণ।
কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল
আসলে যে কোনও কিছুর ওপরেই ক্রমাগত যদি বোঝা বা চাপ বাড়তে থাকে তবে একদিন না একদিন তা চঞ্চল হবেই। মনে বেশি চাপ থাকলে যেমন মন অস্থির, চঞ্চল হয়। শরীরে বেশি চাপ থাকলে শরীর খারাপ হয়, অস্থির হয়ে পড়ে ঠিক তেমনই হার্টে চাপ বাড়লে হার্টও আর শান্ত থাকে না।
বেশিরভাগ ভারতীয় মহিলার জীবনযাত্রা, রহনসহন, খাওয়াদাওয়ার মান কিন্তু আজও উন্নত নয়। তাঁরা হয় অপুষ্টির শিকার, না হয় বেশি পুষ্টির। তাঁরা হয় রোগা, না হয় মোটা। এদেশের গড় মেয়েদেরই ওজন বেশি। এর পাশাপাশি মেয়েদের ওপর থাকে নানা সামাজিক, পারিবারিক চাপ। দায়-দায়িত্বের চাপ আর এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোজগারের চাপও। তারা রোজগার করতে বাইরে বেরলেও বাড়ির দায়িত্ব কিন্তু কমেনি, ওটা একই রয়ে গেছে ফলে সবার সব এক্সপেক্টেশন পূরণ করতে গিয়ে আজও নিজের অবহেলা করেন ফলে দিনে দিনে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি।
এ-ছাড়া গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতা, যেমন— ডায়াবেটিস, গর্ভকালীন উচ্চরক্তচাপ, মেনোপজ ইত্যাদি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। মেনোপজের সময় মহিলাদের হরমোনের একটা বড় পরিবর্তন আসে সেই কারণে ওই সময় থেকে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়তে শুরু করে।
অটোইমিউন রোগ থাকলে, থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে, পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ বংশে এই রোগ হয়ে থাকলে মেয়েদের হার্টের রোগের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
মেয়েদের হৃদরোগের রিস্ক বাড়ার অন্যতম কারণ স্থূলতা।

আরও পড়ুন-শাহের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বই? এনসিইআরটির বিবেচনায় প্রস্তাব

উপসর্গ
যে উপসর্গগুলোকে আমরা গুরুত্ব দিই না। যেমন— প্রায়শই ক্লান্তি, মাথাঘোরা, বমি-বমি ভাব, অ্যাসিডিটি, পেটখারাপ বা শ্বাসকষ্ট এগুলো সবই হৃদরোগের লক্ষণ হতে পারে।
বুকে ব্যথা এবং পিঠে ব্যথা। বুকে বা পিঠের উপরের অংশে পেশিতে টান লাগার মতো অনুভূতি।
মেয়েরা অতিরিক্ত টেনশন করেন, ভাবেন— ফলে যে-কোনও রোগই আগে ধরে, হার্টের অসুখ তো বটেই।
ধূমপান, মদ্যপানের অভ্যেস, বেশি কোলেস্টেরল, অত্যধিক স্ট্রেস থাকলে হার্ট বিপদে পড়তেই পারে।
কী করবেন
প্রযুক্তি আমাদের কুড়ে বানিয়ে দিচ্ছে। সাঁতার কিন্তু হার্ট সুস্থ রাখতে খুব ভাল ব্যায়াম। কিন্তু সাঁতারকাটার সময় ক’জন মহিলা পান? তাই নিয়মিত ঘাম ঝরিয়ে জোরে হাঁটার অভ্যেস করুন। এতে শুধু হৃদয়ই নয়, শরীরের সব যন্ত্র ভাল থাকবে।
বুকে চাপ লাগলে সেটা গ্যাস-অম্বলের ব্যথা বলে উড়িয়ে দেবেন না। যদি হজমের ওষুধ খেয়েও অস্বস্তি না কমে, ডাক্তারের কাছে যান।
বুকের মাঝখানে বা বাঁ-দিকে ব্যথা, চোয়ালে-হাতে-গলায় ব্যথা হচ্ছে মানেই কিন্তু হার্টের সমস্যা হতে পারে।
হাঁটতে গেলে হাঁপ লাগছে, দাঁড়িয়ে বা বসে পড়লে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মানেও বিপদ ওঁৎ পেতে আছে।
একটা কথা জানবেন, আপনি ভাল থাকলে, সুস্থ থাকলে তবেই পরিবারের সকলকে ভাল রাখতে পারবেন। তাই স্ট্রেস কমাতে যোগাভ্যাস, প্রাণায়াম করুন নিয়মিত।
নিয়মিত চেক-আপ করান। রক্তে চিনি, প্রেশার, কোলেস্টেরল বেশি থাকলেই চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খেয়ে ওগুলি আয়ত্তে রাখুন।
রোজ পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোন। টাইম ম্যানেজমেন্ট করুন। সময় মেনে খাওয়াদাওয়া কিন্তু মাস্ট।
বাড়তি ওজন বাড়িয়ে তোলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা। মোটাদের হার্টের রোগ ছাড়া আরও অনেক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
মানসিকভাবে সুস্থ থাকুন। মানসিক উদ্বেগ এবং অবসাদ হৃদযন্ত্রকে অস্থির করে তোলে। ব্যস্ততা, কাজের চাপ সমস্যা বাড়াতে পারে। তাই উদ্বেগমুক্ত থাকার চেষ্টা করুন। চব্বিশ ঘণ্টা সময়টাকে ছোট ছোট করে ভাগ করে নিন গুরুত্ব অনুযায়ী। কাজের ফাঁকে খাওয়া বাদ দেবেন না।
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া জরুরি। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার-সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খান। বাড়ির সহজপাচ্য খাবার খান। চিনি, তেল, ঘি, মাখন বাদ দিন। ফল, সবজি রোজ খান। রেডমিট এড়িয়ে চলুন। ডায়েটে মাংসের বদলে মাছ বেশি রাখুন।

Latest article