প্রকৃতি টানে বহু মানুষকেই। কেউ পছন্দ করেন জঙ্গল, কেউ সমুদ্র, কেউ পাহাড়। প্রাণপণে শুষে নেন সৌন্দর্যের গন্ধ। এ এক বিরাট সঞ্চয়। দূর করে দেয় শরীর এবং মনের ক্লান্তি। কিছু মানুষ পছন্দ করেন ঐতিহাসিক এবং পুরাতাত্ত্বিক স্থান। ঘুরে দেখেন প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ। অনুভব করেন রোমাঞ্চ। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পছন্দ করেন, এমন পর্যটকদের জন্য আদর্শ বেড়ানোর জায়গা বাণগড়। আমাদের রাজ্যের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরে অবস্থিত একটি সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্থান।
দুই বাংলার উপর দিয়েই বয়ে গেছে তিনটি নদী— টাঙ্গন, পুনর্ভবা, আত্রেয়ী। বুনিয়াদপুর থেকে জাতীয় সড়ক ধরে বালুরঘাটের দিকে গেলে তিনটিই একে একে এসে ধরা দেবে আপনার দৃশ্যপথে। ইতিহাসের চোরাস্রোতে তলিয়ে যাওয়া বিচিত্র গল্প শোনাবে। গঙ্গারামপুর থেকে শিববাটির রাস্তা উত্তরে পুনর্ভবার গা-ঘেঁষে চলে গিয়েছে সীমান্তের দিকে। সেই পথে সামান্য এগোলেই আর্কিওলজিকাল সার্ভের নীল সাইনবোর্ড জানান দেয়— বাণগড়।
কিছু বিক্ষিপ্ত প্রাচীর নির্দেশ করছে ক্ষেত্রসীমা। সেই ধার-বরাবর পরিখার অস্তিত্ব স্পষ্ট বোঝা যায়। মাঠে চোখে পড়ে ছোট-বড় নানা আকারের ঢিপি। তারই কয়েকটায় হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পুরাতাত্ত্বিক খননের কাজ। জেগে উঠেছে পোড়ামাটির ইটের তৈরি সমস্ত জ্যামিতিক কাঠামো। দীর্ঘ তিন বছরের খননকার্যে পাওয়া গেছে প্রাচীন মুদ্রা, বিভিন্ন দেব-দেবী এবং নর-নারীর মূর্তি। এখানে দেখা মেলে পদ্ম আকৃতির এক বিশেষ কুণ্ডের। কুণ্ডের পদ্মের পাপড়ির ন্যায় প্রতিটি গঠনে ছিল আদতে জল নিকাশি ব্যবস্থা। এই বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হত বাতাসের তাপমাত্রা। এমনকী এখানে পাওয়া যায় ওয়াচটাওয়ার এবং পাতকুয়োও। মাটি খোঁড়ার ফলে একে একে জেগে উঠেছে নানান লুকোনো ইতিহাস। পাওয়া গেছে গ্রানাইটের এক বিশেষ নিদর্শন।
ঢালদিঘি লেকের পাশে অবস্থিত আতা শাহ-র দরগা। মনে করা হয়, চতুর্দশ শতাব্দীতে পাল যুগে নির্মিত হয়েছিল মোল্লাহ আতর-উদ্দিন বা শাহ আতার কবরস্থানটি।
মৌর্য থেকে তুর্কি পর্যন্ত কমবেশি দেড় হাজার বছর সময়কালের মধ্যে পাঁচটা শাসনযুগের সাক্ষ্য বহন করছে জায়গাটা। গুপ্তযুগে বৃহত্তর পৌণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ শাসনবিভাগ বা বিষয় ছিল কোটিবর্ষ। পূর্ববর্তী মৌর্য শাসনকালে এই কোটিবর্ষের নাম ছিল দেবীকোট বা দেবকোট। ঐতিহাসিক মতে, বাণগড় ছিল কোটিবর্ষের রাজধানী। বাণগড়ের প্রাচীরঘেরা ক্ষেত্রটাই প্রাচীন দেবীকোট বা কোটিবর্ষের অন্যতম প্রধান শাসনকেন্দ্র।
আরও পড়ুন-খোলার আগেই জগন্নাথ মন্দিরের সার্বিক নিরাপত্তা খতিয়ে দেখা হল
বাণগড় অঞ্চলটি অনেক বড়। তবে এই স্থানেই মূল ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। খননের সময় দুর্গ-সদৃশ এই এলাকায় শহরকেন্দ্রিক জীবনধারার নানা ছবি ধরা পড়েছে। মাটির কেল্লা সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে ক্রমে ইটের গড় হয়ে শক্তিবৃদ্ধি করেছে। দেখে বোঝা যায়— শস্যাগার, পয়ঃপ্রণালী, জল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল আধুনিক। তবে এর সবই মূলত খনন করা ঢিপিগুলো থেকে পাওয়া নিদর্শন। আরও অনেকগুলো ঢিপি রয়ে গেছে অবিকৃত, অনাবিষ্কৃত অবস্থায়। সেগুলোর মাথায় পোড়ামাটির আভাস স্পষ্টই জানান দিচ্ছে আরও অজানা ইতিহাস, ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে গভীরে, অন্ধকারে। ভবিষ্যতে হয়তো দেখবে আলোর মুখ।
জানা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় সেন বংশের রাজাদের পরাজিত করে বাংলায় মুসলমান শাসনের পত্তন করেন তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খলজি। তখনও এখানে বসতি ছিল। বখতিয়ার পরে এই অঞ্চলের কাছাকাছিই গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন এবং পুনর্ভবার তীরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
ঐতিহাসিক তথ্যের স্বল্পতার কারণে বাণগড়কে জড়িয়ে নানা পৌরাণিক গল্প এবং ভেসে বেড়ানো কিছু মিথ তৈরি হয়েছে। শোনা যায়, এখানে নাকি রাজত্ব করতেন বাণরাজা। রাজার নামেই তাঁর রাজ্য। শ্রীকৃষ্ণের প্রপৌত্র অনিরুদ্ধ রাজার কন্যা ঊষাকে বাণগড় থেকেই হরণ করেছিলেন। সেই কারণেই স্থানীয় একটা রাস্তার নামও নাকি ঊষাহরণ রোড। ‘পাথরের কলাগাছ’-এর গল্পও শোনা যায় মুখে মুখে। পাথর বটে, রীতিমতো গ্র্যানাইটের, তবে কলাগাছ নয়। আসলে চারটে স্তম্ভ। সম্ভবত কোনও প্রাচীন বিষ্ণুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের আবেদনকে মান্যতা দিয়ে স্থগিতাদেশ, আদালতে আটকে গেল লিগ চ্যাম্পিয়নের ঘোষণা
বাণগড় একটি সংরক্ষিত এলাকা। তবে এখানে মানুষ এবং ইতিহাসের অবাধ সহাবস্থান দেখা যায়। মাঠে ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশেই জমিয়ে হচ্ছে চাষবাস। চরছে গরু, ছাগল। সবমিলিয়ে অসাধারণ একটি জায়গা বাণগড়। ইতিহাস এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনের প্রতি আগ্রহ থাকলে সপরিবারে ঘুরে আসতে পারেন। আশেপাশেও আছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান। সেগুলোও ঘুরে আসা যায়।