তফাত ছিল, তফাত আছে, তফাত থাকবে

কেন্দ্রের বাজেট আর রাজ্যের বাজেট। প্রথমটি স্বপ্ন দেখানোর বাজেট, পরেরটি স্বপ্ন পূরণের বাজেট। প্রথমটি ফাঁপা বুলির নথি, পরেরটি প্রকল্প রূপায়ণের ছবি। উভয় বাজেটের বিশ্লেষণে বারাসত কলেজের অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

বাজেট বলতে আমরা বুঝি আয় ও ব্যয়ের সুবিন্যস্ত হিসাব। নির্বাচিত সরকারকে যখন দেশের বা রাজ্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়, সরকার তখন জনগণের ভবিষ্যৎ গড়ার আগাম কিছু পরিকল্পনা করে বাজেট রচনার মাধ্যমে। যে বাজেটে সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত থাকে সেটি সাধারণত তিনটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়, সেগুলো হল উন্নয়ন, কল্যাণ ও উৎপাদন। যে কোনো উন্নত দেশ হোক বা রাজ্য তাদের বাজেট নির্ধারণের মূল চালিকা শক্তি হল সেখানকার জনগণ। আর জনগণের সার্বিক উন্নয়ন হবে সেটাই বাজেটের এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য। সাম্প্রতিক কালে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে শুধু ভাঁওতাই নয়, তার সঙ্গে আছে হতাশাও। ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষ মধ্যবিত্ত পরিবারের এবং কিছু মানুষ দরিদ্রসীমার নীচেও বসবাস করে। যখনই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য বাজেট ঘোষণার সময় আসে, তখন তারা চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে।

আরও পড়ুন-ঘুরে আসুন বাণগড়

কারণ তাদের কিছু আশা জাগে কয়েকটি ক্ষেত্রকে ঘিরে, যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমবে কিনা? সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নতুন কোনও দিক খুলবে কিনা? নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর ভর্তুকি বাড়বে কিনা? কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে কিনা? বেতনের ওপর কর ছাড় পাওয়া যাবে কিনা? আর যারা প্রান্তিক মানুষ তাদের আশা জাগে, যে এই বর্ষার আগে মাথার ওপর পাকা ছাদটা হবে কিনা? সরকারি কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে কিনা? ইত্যাদি। সুতরাং বাজেট হল একরাশ আশা ও স্বপ্ন পূরণের চাবিকাঠি। সুতরাং সরকার যখন বাজেট তৈরি করে তখন এই সমস্ত বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখে। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে দেখা যাচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে বাজেটে বরাদ্দ ১৬% কমেছে, মাথার ওপর ছাদের ভরসায় যারা বসে আছে তাদের স্বপ্ন পূরণের মাঝে যে অর্থাভাব আসবে সেটাই স্বাভাবিক। গৃহ নির্মান প্রকল্পে ২৪-২৫-এ বরাদ্দ ছিল ৮১,৫৮৫ কোটি টাকা, ২৫-২৬-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪,৮৩২ কোটি টাকা। সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো অর্থাৎ এসসি, এসটি তাদের বাজেটে বরাদ্দ ৩% এর বেশি কমেছে। দরিদ্র মানুষ যারা বিনামূল্যে রেশন পাওয়ার অধিকারী তাদের খাদ্যে ভর্তুকি যে বাড়বে সেটাই আমরা জানি, কিন্তু বাজেটের চিত্রটা ঠিক উল্টো, খাদ্যতে ২৪-২৫-এ ভর্তুকি ছিল ২.০৫ লক্ষ কোটি টাকা, ২৫-২৬-এ তা কমে হয়েছে ২.০৩ লক্ষ কোটি টাকা। যুবক-যুবতীদের বাজেটে তেমন কোনও আশার আলো নেই, কৃষকদের জন্য নতুন কোনও বরাদ্দ নেই। পি এম ফসল বিমায় ২৪-২৫-এ বরাদ্দ ছিল ১৪৬০০ কোটি টাকার মতো, ২৫-২৬-এ তা কমে হয়েছে প্রায় ১২২৪২ কোটি টাকার মতো। কেন্দ্রীয় সরকারের মতে বাজেটের লক্ষ্য ২০৪৭, এখনকার যুবক যুবতীরা ততদিনে কতটা যুবক-যুবতী থাকবে সেটা কিন্তু ভাববার বিষয়। অপর দিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, যেই সরকারের ভিত মা-মাটি-মানুষের আশীর্বাদের ওপর গড়ে উঠেছে তাদের বাজেট যে মানুষের জন্যই হবে সেটা বিরোধীরাও জানে, সেই আঁচ পেয়েই বাজেট সেশন শেষ হওয়ার আগেই বিধানসভা ছেড়ে চলে গেছেন। আসলে সাধারণ মানুষের যে মৌলিক অধিকার, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান এছাড়াও উন্নত রাস্তা, পানীয় জল, স্বাস্থ্য এই সবক্ষেত্রে একই বাজেটে বরাদ্দ করা শুধু নয়, বাজেটে বরাদ বৃদ্ধি করা যে অসম্ভব সেটা সবাই জানে। কিন্তু এই অসম্ভব কাজকে একমাত্র সম্ভব করতে পারেন ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জনদরদি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষের মনের মতো বাজেট তৈরি করে সকলকে এক সুতোয় গেঁথে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। খাদ্য সরবরাহ থেকে স্বাস্থ্য, বাসস্থান থেকে জনকল্যাণ, পিছিয়ে পড়া মানুষজন থেকে শিল্প সর্বক্ষেত্রে অদ্ভুত এক নজির গড়লেন। এবার একটু ২০২৫-এর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বাজেটের কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক, খাদ্য ও সরবরাহ ক্ষেত্রে ২০২৪ সালে বরাদ্দ ছিল ৯৮৫৮.১৭ কোটি টাকা, সেটা ২০২৫-এ বেড়ে দাঁড়াল ৯৯৪৪.৩৭ কোটি টাকা। আগের বছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণে বরাদ্দ ছিল ১৯৮৫৭.৭৩ কোটি টাকা এবারে তা করা হয়েছে ২১৩৫৫.২৫ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের আবেদনকে মান্যতা দিয়ে স্থগিতাদেশ, আদালতে আটকে গেল লিগ চ্যাম্পিয়নের ঘোষণা

জনস্বাস্থ্য ও কারিগরি বিভাগে বরাদ্দ দিগুণের ও বেশি হয়েছে। আগের বছর যা ছিল ৪৫৭৬.৮৭ কোটি টাকা এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৬৩৬.৯২ কোটি টাকা। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বদা পিছিয়ে পড়া মানুষের সঙ্গে ছিল, তার প্রমাণ দেখা গেছে বাজেটে, গতবার এই বিভাগে যেখানে বরাদ্দ ছিল ১২০৩.৮২ কোটি টাকা এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২১০.১৩ কোটি টাকা। কৃষকদরদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কৃষকদের প্রতি সহানুভূতিশীল সেটাই স্বাভাবিক, আগেরবারে যেখানে এই বিভাগের জন্য ব্যয়-বরাদ্দ ছিল ৯৮৫৭.০১ কোটি টাকা এবারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০০০০.৭১ কোটি টাকা। সুতরাং বছর বছর বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাবে সেটাই তো সকলে আশা করে, কিন্তু বাজেটে বিভিন্ন বিভাগে বরাদ্দ কমবে সেটা হয়তো সাধারণ মানুষের ভাবনার বাইরে। বাজেটের আরও কয়েকটি দিক যেখানে দেশ বা রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নত হচ্ছে কিনা তা জানান দেয়, তার কিছু পরিসংখ্যান আমরা দেখে নিই, যেমন শিল্প ক্ষেত্রে রাজ্যে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৭.৩ শতাংশ, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তা ৬.২ শতাংশ। কৃষি ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে রাজ্যের বৃদ্ধির হার ৪.২ শতাংশ, জাতীয় ক্ষেত্রে তা ৩.৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় বাজেটে যেখানে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর কোনও দিশা নেই, ফলে আগামী দিনে জিনিসপত্রের দাম যে আরও বাড়বে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ফলে মানুষের আয় বাড়লেও সঞ্চয় যে তলানিতে ঠেকবে তা হলফ করে বলা যায়। ঠিক উল্টো দিকে ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৯২ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছিল, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৭২ কোটি মানুষ। সরকারের এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বাংলার বাড়ি প্রকল্পে বরাদ্দ। বাংলায় আরও ১৬ লক্ষ বাড়ি নির্মাণ হবে যার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৯৬০০ কোটি টাকা। সাধারণ মানুষ যখন পাকাবাড়ি, রাস্তাঘাট, পরিস্রুত পানীয় জলের অভাবের মতো মৌলিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, সেইসময় পশ্চিমবঙ্গ সরকার সর্বাত্মকভাবে সেই আসীন সমস্যা সমাধানের জন্য সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারই ফলস্বরূপ বাজেটে তার প্রতিচ্ছবি। সুতরাং এ যেন এক স্বপ্ন পূরণের বাজেট।

Latest article