কোথায় হে কথায় কথায় সংস্কৃতির ধ্বজা ধরা বুদ্ধিজীবীগণ, শূন্য হয়েও গর্বিত বামপন্থীগণ, ইদানিংকালে গজিয়ে ওঠা ফেসবুকের নববিপ্লবীগণ ও সর্বাগ্রে আমাদের বাংলার কৃষ্টি সৃষ্টিকে দু’হাত দিয়ে আগলে রাখা গান কবিতা নাট্যজগতের নামীদামি দিকপালগণ… আপনারা সব কোথায়? আপনাদের বিবেকের বিসর্জন অনেককাল আগেই সম্পন্ন হয়েছে সেটা জানি কিন্তু আবেগেরও যে সলিলসমাধি হয়ে গেছে সেটা বুঝলাম প্রতুল মুখোপাধ্যায় মৃত্যু-পরবর্তী সভ্যতাহীনতায়।
আরও পড়ুন-রেকর্ড রান তাড়া করে জয়ী স্মিথরা
নকশালবাড়ি আন্দোলন যাঁর গানের ধাত্রীমা… গণসঙ্গীত যাঁর পরিচিতি… সেই মানুষটির মৃতদেহ রবীন্দ্রসদনে দুপুর দুটো থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা অবধি শায়িত থাকল অথচ আপনাদের কারও টিকিটিও দেখা গেল না। কেউ কেউ নাকি শুনলাম, খুব ইচ্ছে থাকলেও শো আছে বলে আসতে পারেননি।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় একজন আদ্যন্ত কবি, গায়ক, সাহিত্যপ্রেমী। একটা বিশাল সময়কাল ধরে তাঁর গান ইতিহাসের অংশ হিসাবে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখবে আগামিদিন। তিনি চূড়ান্ত রাজনীতি সচেতন হলেও কখনওই রাজনৈতিক কারবারি ছিলেন না। আদ্যন্ত সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা, বিপ্লবের চেতনা থেকে জন্ম নেওয়া এক গানের ফেরিওয়ালা। যিনি বাংলার আনাচে কানাচে শুনিয়ে ফিরেছেন ‘‘যতদূর জ্যোৎস্না পড়েছে সবাই সবার আত্মীয়।’’… সেই মানুষটিকে দিব্য এড়িয়ে গেলেন? আপন আপন ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলেন না? কোন শিক্ষা সংস্কৃতির গর্ব মেখে রাখেন মুখে সেটা কোনওদিন আয়নায় দেখেছেন? লজ্জাও বোধহয় লজ্জা পেয়েছে আপনাদের এহেন ন্যক্কারজনক আচরণে! আচ্ছা এত সর্বদেশে বিদিত যে সংস্কৃতির কারবারিরাই ধরে রাখে ইতিহাস ঐতিহ্য। সেখানে প্রতুলদা ছিলেন বাঙালির অন্যতম কিংবদন্তি। বাংলায় তাঁর কণ্ঠ জোয়ার এনেছিল আন্দোলনের, প্রতিবাদের। সেই আজন্ম বিপ্লবী মানুষটির প্রতি এত অসৌজন্য, এত অনাগ্রহ না দেখালেই পারতেন। কাঁকড়ামি করতে করতে আপনারা সরীসৃপ হয়ে গিয়ে যেভাবে হামাগুড়ি দিচ্ছেন আর গা জোয়ারি সভ্যতার নিদর্শন রাখছেন তার ফলশ্রুতিতে আপনারা নিজেরাও দিনে দিনে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হবেন এ আর বলার কী আছে?
এদিকে বঙ্গ সিপিএম ও তার চোদ্দো গুষ্টি চিরকাল অতি বাম সমর্থক প্রতুলদার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধারণত্বকে কমিনিজম মনে করাটা বিরাট অপরাধ বলে গণ্য করে শ্রদ্ধা জানানো তো দূরের কথা, তাঁর শিল্পীসত্তাকেও হাড়িকাঠে তুলে সমানে কালি ছেটাচ্ছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়! সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই প্রতুলদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বারেবারেই বলেছেন, ‘‘গরিব মানুষের জন্য তো শুধু এই মেয়েটাই ভাবল।” … এবার নিজেদের দুষ্কর্মের জন্য আত্মসমালোচনা না করে যদি প্রতুল মুখোপাধ্যায় বামপন্থী কি না সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া চালায় বামেরা তাহলে বিরক্ত লাগে বইকি?
এতেই শেষ নয়… প্রতুলদা ভর্তি থাকাকালীন… ‘‘এই যে মালটা দেখছিস… ভিভিআইপি… গান গায়। কিন্তু আমাদের মঞ্চে আসেনি কখনও। সরকারের লোক।”… একথা অবলীলায় বলেছে এসএসকেএম হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তারি পড়ুয়া। ওরা ভেবেছিল প্রতুলদা ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু উনি সবটাই শুনেছিলেন এবং ওনার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘‘আরজি কর-কাণ্ডে মেয়েটির (মুখ্যমন্ত্রীর) কী দোষ? ওরা যে ওকে গালি দিচ্ছে।’’
আরও পড়ুন-ট্রাকশন মোটর খুলে বিপত্তি এনজেপি-চেন্নাই সুপারফাস্টের
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাদের অপছন্দের ব্যক্তি হতেই পারে কিন্তু প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বকে মাল বলে সম্বোধন করে তথাকথিত মেধার বিজ্ঞাপনটা কতটা ঠুনকো সেটা আরও একবার নিজেরাই প্রমাণ দিয়ে দিলেন। আসলে বিপ্লবীরা জানে না যে ক্লাসে কোনওদিন দ্বিতীয় না হওয়া প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী প্রতুলদার থেকেও নিজেদের বেশি সমাজবোদ্ধা মনে করাটা একটা শুদ্ধ বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। এইসব আবোলতাবোল বলে অসভ্যতামির বিজ্ঞাপনকে গলার শির ফুলিয়ে বিপ্লব বলে চালিয়ে গেলেও প্রতুল মুখোপাধ্যায় নামক বিপ্লবীকে বোঝার মতো শিক্ষা আপনাদের কোনওদিনই হবে না।
আপামর বাংলার কাছে প্রতুলদা দিগন্ত বিস্তৃত এক চিন্তাধারার জয়গান গেয়ে আমাদের ঋণী করে গেলেন চিরজীবনের মতো যার দায়ভার একদিন সকলকেই নিতে হবে। ততদিনে এই বাংলার স্বঘোষিত শিক্ষিত এলিট বাঙালি সমাজকে গ্রাস করে ফেলবে মরুভূমির রুক্ষতা।
ভাবছেন তো আমার গরজ কিসের এত? নবান্নের মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে কাজ করার আনুগত্য বলবেন জানি। কিন্তু এই মুখ্যমন্ত্রীকে আমি আশির দশক থেকেই চিনি, জানি, দেখছি। তখনই আমার মনে হয়েছিল এই মেয়েটি কিছু করে দেখাবে। তাই প্রতুলদার স্নেহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি থাকবেই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
প্রতুলদা গুরুতর অসুস্থ হওয়ার আগে যতদিন হাসপাতালে ছিলেন দেখতাম বেডের পাশে ওনার স্ত্রী বেশ রাগত স্বরে মাঝেমধ্যেই বলতেন, ‘‘এরকম করে আর কতদিন থাকবে। ওঠো… কাজগুলো তো তোমাকেই করতে হবে। এসব আমাদের দরকার নেই। বাকি যা আছে দিয়ে দাও।”
প্রতুলদা বলতেন, ‘‘ও সব লেখাই আছে। তোমার চিন্তা নেই। মেয়েটা তো মানুষের জন্য ভাবে। ও ঠিক ব্যবস্থা করে নেবে।”
আরও পড়ুন-হিমাচলের ৪৫% এলাকাই বিপজ্জনক : রিপোর্ট
আমি প্রথম প্রথম বিষয়টা না বুঝলেও পরে জানলাম যে, প্রতুলদা ও ওনার স্ত্রীর যাবতীয় সম্পত্তি ওঁরা দান করে দেবেন। আগেও অনেককিছু দিয়েছেন। বাকি যা আছে সেটাও যাতে মানুষের কাজে লাগে তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলে ব্যবস্থা নেওয়ার আলোচনা চলত দু’জনের মধ্যে।
প্রতুলদা যেদিন মারা গেলেন সেদিন আমার বন্ধু জ্যোতি ওনার স্ত্রীকে হলুদ ট্যাক্সি করে পিজিতে নিয়ে গেছিল। ওঁদের কি একটা গাড়ি কেনার ক্ষমতা নেই? যথেষ্ট আছে। কিন্তু ওঁরা সেটার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ প্রতুলদা এতটাই মাটির মানুষ যে গুটি গুটি পায়ে সংসার আর সমাজকে একাত্ম করে এগিয়েছেন। যেখানে দেশের কথা, ভাষার কথা, মানুষের কথাই ছিল মহামূল্যবান। বাকি জাগতিক যা কিছু সবটাই ওই বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার ওটুকুই।
আজকের দিনে ভাবতে পারেন… প্রতুলদার বাড়িতে আসবাব বলতে আছে সাধারণ একটা তোক্তপোষ, তার থেকেও সাধারণ একটা সোফা…. আর একটাই টেবিল। যাতে ওঁরা পড়াশোনা করেন আবার খাবারও খান। দুই মানুষের সারাদিনের খাদ্য বলতে একবার সিদ্ধ ভাত আর বাকি সময় মুড়ি চানাচুর। আমার নিয়ে যাওয়া হলদিরামের চানাচুরের কৌটোটা মুসুর ডাল রাখতে কাজে লাগবে বলে যারা খুশি হয় তাদের সেই তিতিক্ষা আসে জীবনবোধের সহজতা থেকে। যা বামপন্থার প্রথম পাঠ। বই ছাড়া ওই বাড়িতে সম্পদ বলতে কিছুই নেই।
একে একে নিভিছে দেওটির মতো মাথার উপর থেকে ছাতাগুলো সবাই ছেড়ে চলে যাচ্ছে। জানি কোনও শোকই স্থায়ী হয় না। সময়ের পরতে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠবে শুধু কখনও কখনও। প্রতুল মুখোপাধ্যায় তো মানুষের মুষ্টিবদ্ধ সেই হাত যা জীবনের প্রতিনিধি হয়ে আমাদের ডিঙা পার করে দেন। তাঁর বিশালতার সীমানা নির্ধারণ করার আমি কেউ নই।
আরও পড়ুন-রাজ্যের উদ্যোগে উত্তর দিনাজপুরে মোবাইল ফুড টেস্টিং ল্যাবরেটরি
ফলত প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের আন্দোলন, পড়াশোনা, ভাষা, সাহিত্য বোঝার মতো জ্ঞানী নই। আমার কাছে শুধু ওনার গান শোনাটাই ভীষণ ভাললাগার ছিল। সম্পর্কটা পারিবারিক হয়ে গেছিল বলেই কিংবদন্তি শিল্পীর থেকেও অনেক বেশি সহজ সরল মাটির মানুষটির চলে যাওয়াটা একজন অভিভাবক হারানোর সমান মনে হচ্ছে।
প্রতুল মুখোপাধ্যায় জীবৎকালেই তাঁর গান দিয়েই বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন গোটা সমাজ অসার চেতনায় পঙ্গু। যা তাঁর মৃত্যুতেও আর একবার স্পষ্ট হতে দেখে কষ্ট পেয়েছি….
“স্লোগান দিতে গিয়ে আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন।
স্লোগান দিতে গিয়ে আমি বুঝতে শিখি কে ভাই কে দুশমন।।”