সম্প্রীতির বাংলা। সমন্বয়ের বাংলা। লোকায়ত বাংলা। চিরায়ত বাংলা। বিশ্বায়নের যুগে, অবক্ষয়ের ধ্বান্ত প্রহরে তাকে পুনরুজ্জীবনের অম্লজান যোগাচ্ছে মা – মাটি – মানুষের সরকার। জননেত্রীর ঐকান্তিক চেষ্টায় বাংলার কৃষ্টি আপন অস্মিতার প্রহর খুঁজে নিচ্ছে। লিখছেন বহরমপুর গার্লস কলেজের অধ্যাপক ড. মধু মিত্র
বাংলা ও বাঙালির অন্যতম পরিচায়ক তার লোকশিল্প ও লোকসংস্কৃতি। সেই কবে ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ নামক বাংলা রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাস বলেছিলেন – ‘লোক বুঝাইবার তরে কৃত্তিবাস পন্ডিত’। – আসলে এই ‘ লোক ‘অর্থাৎ তৃণমূল স্তরের আমজনতার যুথবদ্ধ জীবনযাপন এবং সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি ধরা পরে বাংলার লোকসংস্কৃতির মধ্যে। সম্প্রীতির বাংলা – সমন্বয়ের বাংলা গড়ে উঠেছে তো আবহমান কাল থেকে লোকায়ত বাংলার অন্দরমহলে।
আরও পড়ুন-ডঃ বি আর আম্বেদকরের মৃত্যুদিনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য
বিগত বাম আমলে ‘ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র’ স্থাপিত হলেও তার ক্ষেত্র ছিল সীমাবদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই ‘লোকশিল্পের পুনরুজ্জীবনে’ ও লোকসংস্কৃতির প্রসারে জোর দিলেন। আসলে হাওয়াই চটির স্পর্ধা এবং একজন আটপৌরে বঙ্গনারীর জননেত্রী হয়ে ওঠার পরিক্রমাই তো লোকায়তের লড়াই। তথাকথিত রাজনৈতিক কৌলীন্য না থাকা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উত্থান এক হিসেবে লোকায়তের উদ্যত প্রহার।
আরও পড়ুন-বাংলাই রোল মডেল
তাইতো জননেত্রী সচেতনভাবে রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কেন্দ্রকে মহাকরণ থেকে ‘নবান্ন’ এ উত্তরণ ঘটান। নবান্ন তো বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধানের উৎসব। ‘রূপসী বাংলা’ র কবি জীবনানন্দ দাশ তো নবান্নের মধ্যে আবহমান কালের বাংলাকে খুঁজেছিলেন – ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে /…. এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। আর, একুশ শতকে সেই আবহমানকালের লোকায়ত বাংলাকে সচেতনভাবে জননেত্রী প্রতিষ্ঠা দিলেন কলকাতা নামক নাগরিক ভরকেন্দ্রে।
আরও পড়ুন-Suvendu Adhikary: পুরভোটে উধাও, দলীয় বিধায়করাও অসন্তুষ্ট, বিজেপিতে কোণঠাসা এবার শুভেন্দু
এখন মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের ওয়েবসাইটের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ – ‘লোকশিল্পের পুনরুজ্জীবন’ ।আমরা দেখলাম, প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় রাজ্য জুড়ে কয়েক লক্ষ লোকশিল্পীকে পরিচয়পত্র দেওয়া হলো। ২০১৮ সালের তথ্য বলছে, প্রায় দু’ লক্ষ লোকশিল্পীদের নাম নথিভুক্ত করে তাদের সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা হয়েছে। সারা ভারতে এ দৃষ্টান্ত বিরল। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৬ হাজার লোকশিল্পী মাসিক ১০০০ টাকা বহাল ভাতার আওতায় এসেছেন।
আরও পড়ুন-চোটে জেরবার ইস্টবেঙ্গল
বর্ষীয়ান ও দুঃস্থ লোকশিল্পীদের মাসিক পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে তাদের যুক্ত করে ন্যূনতম উপার্জন নিশ্চিত করা হয়েছে। বস্তুত, জননেত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত ‘লোকপ্রসার প্রকল্পে’ র মাধ্যমে লোকশিল্পীদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারটি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন-চোটে জেরবার ইস্টবেঙ্গল
অতএব, মূল ধারার সংস্কৃতির সঙ্গে লোকসংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে ‘লোক প্রসার প্রকল্প’। বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকশিল্প এবং লোকসংস্কৃতি এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে তার বিভিন্ন লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। শিষ্ট নাগরিক পরিসরে লোকশিল্পীরা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন – তা পরিণামে বিশ্বায়নের যুগে লোকসংস্কৃতিকে লড়াই করবার সাহস যোগাচ্ছে। দোলন মাহালি নামক একজন ঝুমুর শিল্পীর বয়ান প্রসঙ্গত দেখা যায় – ‘উপার্জন কমে আসায় অনেক শিল্পী ঝুমুর চর্চা ছেড়ে দিয়েছিল। সরকারী ভাতা ও বিভিন্ন মেলার অনুষ্ঠান তাদের অনেককে আবার ঝুমুরের দিকে ফিরিয়ে এনেছে।’
এমনকি, আদিবাসী সংস্কৃতির প্রতীক ‘ধামসা মাদল’ কেনার অর্থও প্রদান করা হচ্ছে এখন। শহরের বুকে লোকশিল্পীদের যে এখন অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি – তার পেছনেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘লোকমুখীনতা’ র কার্যকারণসূত্র সক্রিয়। এ সম্পর্কে একজন ছৌ লোকশিল্পীর বক্তব্য – ‘এখন সরকারী ভাতা পাচ্ছি। অনুষ্ঠান অনেক বেড়েছে। আমরা ভালো আছি।’ – অতএব, ‘আমরা ভালো আছি’ আর নিছক সরকারী প্রচার নয় ; বাস্তব সত্য। তাইতো, মুর্শিদাবাদ – বীরভূম – বর্ধমানের ‘রাঁইবেশে’ দলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ছৌ একাডেমী, যাত্রা একাডেমী, যাত্রা উৎসব, পৌষ উৎসব, বর্ষবরণ উৎসব, হস্তশিল্প মেলা – র মাধ্যমে এ পর্বে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলার মুখ – বাংলার লোকসংস্কৃতি।
আরও পড়ুন-পথ খোলা, দল ছাড়ার সম্ভাবনা উসকে দিয়ে বললেন গুলাম নবি
২০২০ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগেই ‘বিশ্ব বাংলা লোকসংস্কৃতি উৎসব’ বাংলা লোকসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক উড়ানকথার সূচনা করেছে। তাছাড়া, এই সময়ে লোকশিল্পীদের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারও হচ্ছে ‘এগিয়ে বাংলা’ পোর্টালে। অর্থাৎ, আধুনিক ডিজিটাল পৃথিবীর সঙ্গে বাংলার লোকশিল্প – লোকসংস্কৃতির সংযুক্তি ঘটাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাংলা লোকশিল্পের এই আন্তর্জাতিক সম্ভাবনাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে কেউ এভাবে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করেননি।
তাছাড়া, এই সরকারের আমলে লালন পুরস্কার, বীনা দাশগুপ্ত পুরস্কার, সুধী প্রধান পুরস্কার চালু হয়েছে – যা লোকশিল্পীর সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। লোকশিল্পীদের স্বাস্থ্যের কথাও ভেবেছেন জননেত্রী। তাইতো, হারিয়ে যেতে বসা ডোকরা, ছৌ শিল্পীরাও ‘স্বাস্থ্য সাথী’ প্রকল্পের আওতায় এসেছেন। লুপ্তপ্রায় লোকবাদ্য দোতারা, সারেঙ্গী প্রস্তুতকারীরা এখন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে অনেক বেশি বিপণনে সফল – ‘এখন দোতারা, সারেঙ্গী বিক্রি হচ্ছে প্রচুর। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোগানো যাচ্ছে না।’
আরও পড়ুন-রোহিতের নেতৃত্বের প্রশংসা শচীনের
স্বাভাবিক ভাবেই নাগরিক সমাজে লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সরকারী প্রকল্পগুলির ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। প্রসঙ্গত, এশিয়ার বৃহত্তম লোকশিল্প সংগ্রহশালা গুরুসদয় মিউজিয়ামের পুনরুজ্জীবনে বর্তমান সরকারের ভূমিকা স্মরণযোগ্য। ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেবার পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ এস সি এস টি ওবিসি উন্নয়ন ও অর্থনিগমের আর্থিক সাহায্যে এখানে এখন নিয়মিতভাবে নানা ধরনের কর্মশালা হচ্ছে। কর্মশালা আয়োজন ও বিপণনে সরকার এগিয়ে এসেছে। এভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যে বাংলার লোকঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে-বাংলা লোকসংস্কৃতির আন্তর্জাতিক উড়ানকথা রচিত হচ্ছে প্রতিদিন।