মিসেস

আজকাল ভাল ভাল ছবি শুধুমাত্র হল-এ রিলিজ হয় না, বহু ব্যতিক্রমী পর্যায়ের ছবি ওটিটিতেও মুক্তি পাচ্ছে। যেমন জি ফাইভে সদ্য মুক্তি পেয়েছে পরিচালক আরতি কাদভ-এর ছবি ‘মিসেস’। নীরব পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক নারীর প্রতিবাদের গল্প। মুখ্য ভূমিকায় সানিয়া মালহোত্রা। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সানিয়া মালহোত্রা অভিনীত ছবি ‘মিসেস’ (Mrs.) এই মুহূর্তে চর্চিত এবং বিতর্কিত। সম্প্রতি জি ফাইভে মুক্তি পেয়েই আলোড়ন ফেলে দিয়েছে এই ছবি। বলা হচ্ছে রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমাল’ যেমন উগ্র পুরুষবাদকে প্রশ্রয় দেয়, ঠিক তেমনই নাকি ‘মিসেস’ উগ্র নারীবাদকে। এমনকী ‘মিসেস’-ছবিটির ওপর বিষাক্ত নারীবাদের ছবির তকমাও এঁটেছেন সমালোচকেরা। মহিলা পরিচালিত ছবি যাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন নারী ফলে ‘প্রোপাগান্ডা’ ছবির অভিযোগও উঠেছে। পুরুষ অধিকার সংগঠনগুলি কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে নিজেদের সপক্ষে যুক্তি দিতে। ঘরের কাজ করার সময় মহিলারা কী আদৌও মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যান? এই প্রশ্নও তুলেছেন তাঁরা। এমন ছবি ডিভোর্সে ইন্ধন জোগাবে এমন মন্তব্যও করেছেন অনেকেই।

কিন্তু কেন এত বিতর্ক? ছবিটা দেখতে বসলে আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ সাদামাটা একটা গল্প বলেই মনে হবে। কিন্তু আদতে তা নয়। ‘মিসেস’ এই সমাজের হাজার হাজার মেয়েদের, মায়েদের এবং শাশুড়িদের গল্প। সংসারের জোয়ালটানা, সন্তানের দেখভাল এবং স্বামীর সেবাযত্ন করা সংসারী, কেজো মেয়েদের গল্প। এটা আমার এবং আপনার জীবনেরও গল্প। শাশুড়ি, শ্বশুর, স্বামী নিয়ে ছোট্ট সংসার রিচার। সে একজন নৃত্যশিল্পী। নাচের একটা গ্রুপ রয়েছে। ননদের বিয়ে হয়ে গেছে। বর এবং শ্বশুর ডাক্তার। অর্থ, প্রতিপত্তি, বাড়ি, গাড়ি তথাকথিত ভদ্র পরিবার। নতুন জীবন, স্বামীকে চেনার আগ্রহ, প্রথম রাতের রোমাঞ্চ, হেঁশেলে হাতেখড়ি— সব ঠিকই ছিল কিন্তু যত দিন গেল পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে চলা শ্বশুরবাড়ির কদর্যতা একটু একটু করে পরিষ্কার হতে থাকল রিচার চোখে। রান্নাঘরের বাইরে মেয়ে হিসেবে যে তার কোনও আলাদা অস্তিত্ব নেই সে বুঝতে পারল। শ্বশুরবাড়ির অতি ভদ্রতার আড়ালে প্রতিনিয়ত অপদস্থ ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে থাকল সে। যত অসুবিধেই থাক বাইরে পরিশ্রম করে আসা স্বামীর পাতে গরম-গরম ফুলকো রুটিটাই তুলে দিতে হত। দুনিয়া উল্টে গেলেও রাতে স্বামীর শারীরিক চাহিদার তৃপ্তি না করে রেহাই মিলত না। মিষ্টভাষী শ্বশুর ভাল রান্নাকে কৌশলে ইগনোর করে ত্রুটিকেই বেশি করে তুলে ধরতেন। ধনেপাতার চাটনি শুধু শিলে বাটা হয়নি বলে অনায়াসে তা বাতিল করে দেন। রান্নাঘরের ফুটো পাইপ থেকে টপটপ করে পড়তে থাকা নোংরা জল বন্ধ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকলেও জন্মদিন-পার্টি, ফুর্তি সবটাই কিন্তু চলে নিয়মিত। শুধুমাত্র স্বামী-শ্বশুরের প্রতিপত্তি রয়েছে বলেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কেরিয়ার— সব বিসর্জন দিয়ে লক্ষ্মী বৌ হয়ে সকাল থেকে রাত রান্নাঘরে ঢুকে তাঁদের রসনার হাভাতেপনা মেটানোকেই জীবনের ধর্ম কর্ম মনে করে এগিয়ে চলার পরামর্শও দেওয়া হয় তাঁকে।
উঁচুগলায় একটা কথাও না বলে, গায় হাত না তুলে প্রত্যেকদিন কারও আত্মসম্মানে ঘা মারা যায়, শুধু ব্যক্তি বিশেষকে নয় গোটা নারীজাতিকেই হেয় প্রতিপন্ন করা যায় এর জলন্ত উদাহরণ হল পরিচালক আরতি কাদভের ‘মিসেস’।

আরও পড়ুন- বিজেপির নতুন নাম এখন গেরুয়া কমরেড

‘মিসেস’ (Mrs.) ছবিটা আমাদের সমাজের পঞ্চাশ শতাংশ নারীর জীবনের কঠিন এবং রূঢ়বাস্তবকে তুলে ধরে। পঞ্চাশ শতাংশ বললাম কারণ এই সমাজে মেয়েদের অবস্থান বদলেছে। স্ত্রী মানেই আজ আর বিনা মাইনের কাজের লোক নয়। সমাজ মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে শিখেছে। তাই পঞ্চাশ শতাংশ। কিন্তু বাকি পঞ্চাশ শতাংশ একই রয়ে গেছে। ‘মিসেস’ ছবির ‘রিচা’ দুর্ভাগ্যবশত সেই বাকি পঞ্চাশ শতাংশ মেয়েদের মধ্যে পড়ে যায়। বিয়ের পর সংসারের জাঁতাকলে আটকে কেমনভাবে নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছেকে গলা টিপে হত্যা করতে হয় বেশিরভাগ মেয়েদের, সেই কথা বারবার মনে করিয়ে দেয় এই ছবি। আসলে এই ছবি যত না ব্যাখার তাঁর চেয়েও বেশি অনুভবের।
পরিচালক আরতি কাদভ এই ছবি পুরুষতন্ত্রের খুব নোংরা অথচ স্বাভাবিক ছবিটাই তুলে ধরেছেন। ডিটেলিং রয়েছে প্রতিটা দৃশ্যেই। সবচেয়ে বড় ছবিটা দেখতে বসে প্রতিটা মেয়ে নিজেকে রিলেট করতে পারবে। যদিও এটি মালায়ালম ছবি ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’-এর হিন্দি রিমেক। তাও ‘মিসেস’ কিন্তু ব্যতিক্রমী জায়গা করে নিয়েছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জি ফাইভে মুক্তি পাবার আগে বিগত বছরে ‘তালিন ব্ল্যাক নাইট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ‘ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’, ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অফ মেলবোর্ন, পাম ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রশংসিত হয়েছে এই ছবি। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ অভিনেত্রী সানিয়া মালহোত্রা পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারও।

ছবিতে (Mrs.) অনবদ্য ভূমিকায় তিনজন— রিচার চরিত্রে সানিয়া মালহোত্রা, রিচার স্বামী দিবাকর কুমারের চরিত্রে নিশান্ত দাহিয়া এবং শ্বশুর অশ্বীন কুমার-এর চরিত্রে কানওয়ালজিৎ। সানিয়ার প্রাণবন্ত অভিনয় এই ছবির প্রাণ। রিচার চরিত্রের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্বটা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। দিবাকরের ভূমিকায় নিশান্ত দাহিয়া সেই পুরুষতন্ত্রের ধারক যা আমাদের মেয়েদের ভীষণ চেনা। কোথাও এতটুকু অতিনাটকীয় মনে হয়নি। গায়ে হুল ফোটানোর মতো চরিত্রে রয়েছেন কানওয়ালজিৎ। এখানেই ছক ভেঙেছেন পরিচালক। অসম্ভব মিষ্টভাষী বৃদ্ধ শ্বশুর যাকে দর্শকদের খানিকক্ষণ সহ্য করাও দুষ্কর হবে। তাকে দেখে পাষণ্ড ছাড়া আর কোনও বিশেষণ মাথায় আসে না। ঠান্ডামাথায় খুনও করতে পারেন। অভিনেতা কানওয়ালজিৎ-এর এখানেই সার্থকতা। ভোর ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত নিঃশ্চুপে কাজ করে চলা শাশুড়ি একটা পরিবারে ছেয়ে থাকা পিতৃতন্ত্রকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। ছবির ভূমিকা তৈরি করেছেন তিনিই। তথাকথিত ভিলেন নেই কেউ অথচ রিচার জীবনে এরাই ভিলেন। এরা ছাড়া ছবির বাকি সব চরিত্রই ভীষণ বাস্তবসম্মত। আসলে ভাল পরিচালক ভাল অভিনয়টা বের করে নিতে জানেন। শেষটা না-ই বা বললাম তবে ছবিটা দেখতে বসলে রেশ রয়ে যায় মনে বহুক্ষণ এটুকু বলতে পারি।

Latest article