ঘটনা এক : বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরতা রূপসার মনে আনন্দের পাশাপাশি চিন্তার মেঘ।
মা হতে চলেছে রূপসা। সেই কারণে আনন্দ তো বটেই, পাশাপাশি নানা উদ্বেগ অনিশ্চয়তা তাকে ঘিরে রাখে যেন সবসময়।
বাড়ির গুরুজনেরা এবং চিকিৎসকও বলেছেন এ সময় দুশ্চিন্তা না করতে, মন ভাল রাখতে। কিন্তু পারছে কই?
বিয়ের বেশ কয়েক বছর বাদে পরিবারের এবং নিজেরাও যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল এ-বিষয়ে তখনই এই সুসংবাদ।
এই কারণে আরও দুশ্চিন্তা রূপসার।
সব ঠিকঠাক হবে তো? পারবে তো সে একজন পরিপূর্ণ সুস্থ নবজাতকের জন্ম দিতে?
বহুজাতিক সংস্থার কর্মী হিসেবে অফিস ট্যুর তার লেগেই থাকে। রূপসা ঠিক করেছে সে ন’মাস অব্দি চাকরি করবে। মাতৃত্বকালীন ছুটি পরে নেবে, তাহলে বাচ্চাকে সময় দেওয়াও হবে, পাশাপাশি তার শরীরও সারবে।
এই নিয়ে তার আরও দুশ্চিন্তা। সবটা ম্যানেজ করতে আত্মজনেরাই বা কীভাবে দেখবে তার এই অবস্থায় অফিস ট্যুরে যাওয়াটাকে।
যাতায়াত বা পরিশ্রমের কারণে বাচ্চাটার কোনও ক্ষতি হবে না তো?
নানা আশঙ্কা তাকে ঘিরে থাকে সবসময়।
আরও পড়ুন-১০ মার্চ শুরু বিধানসভা
ঘটনা দুই : এক-এক সময় বাড়ির মা-কাকিমাদের ওপর রাগে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কথা বলতে ইচ্ছা করে মেখলার। মেখলা মা হতে চলেছে এই খবরটা তাঁদের কানে যাওয়ার পর থেকেই হাজারো নিষেধাজ্ঞা!
স্নান করে উঠে শাড়িতে গিঁট দিতে হয় মেখলা, এখন এক বছর প্রায় চুল কাটা যাবে না মেখলা, দৌড়ে দৌড়ে হাঁটা যাবে না, সন্ধ্যেবেলা বেড়ানো যাবে না।
মেখলার সবথেকে প্রিয় ফল আনারস, আতা, পেঁপে। এই সব খাওয়া যাবে না নাকি প্রায় এক বছর!
শুধু না আর না…
উফ্! হাঁফিয়ে উঠছে মেখলা।
শ্বশুরবাড়ি থেকে ফোনে আবার শাশুড়ি-মায়ের পাঠানো হাজারো ফরমান। চিত হয়ে শোবে না, ঠান্ডা লাগাবে না, চুল খুলে কোথাও বেরবে না। বেণী বাঁধবে সবসময়। এতো প্রায় ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। তার অমন সুন্দর পালিশ করা স্ট্রেটনিং চুলে বেণী!
কী করে মেখলা বোঝায় মা-কাকিমা-দিদিমাদের যুগ আর নেই। সময়টা বদলেছে।
কর্মরতা সে। এখন এই মধ্যযুগীয় নিয়মকানুন চলে নাকি?
ঘটনা তিন : মনের সন্দেহটা যখন সত্যিই হল তখন থেকেই আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই নন্দিনীর।
কত যে আদরযত্ন পাচ্ছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
মা বিকেলে মাংসের কিমার ঘুগনি পাঠাচ্ছে তো, শাশুড়ি-মা লইট্টা মাছের ঝুরি খাওয়াচ্ছেন তার আবদারে দুপুর বেলায়। নীলয় তো অফিস-ফেরতা একদিন ডিমের ডেভিল তো পরের দিন ফিশ কবিরাজি বা গরমাগরম পেঁয়াজি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। আত্মজনেদের কাছ থেকে এত স্পেশাল খাতির-যত্ন পেয়ে মন একেবারে আনন্দে আত্মহারা। নিজেকে যে কী ভীষণ দামি মনে হচ্ছে তা বলার নয়। পাশাপাশি একথাটাও ঠিক, যে-যেমন পারছে তাকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। শাশুড়িদের দল থেকে শুরু করে জা, ননদ, মা, কাকিমা— কেউ বাদ যাচ্ছে না।
তাকে দেখলেই উপদেশ শুনিয়ে যাচ্ছে এটা কোরো না, ওটা কোরো না, এভাবে বোসো না, এভাবে চলো না, এভাবে খেয়ো না…।
শুনে মনে-মনে মুচকি-মুচকি হাসে নন্দা।
আরও পড়ুন-আধ কাঠা জমিতেও বাড়ির অনুমোদন দিচ্ছে পুরসভা
এই যে ওপরের ঘটনাগুলো লিখলাম এর থেকে কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট যে, মেয়েরা যখন প্রথমবার মা হতে যায় তখন এই উত্তর আধুনিক সময় দাঁড়িয়েও কিন্তু নানাবিধ সংস্কার, টোটকা বা বিধিনিষেধ তাদের মেনে চলতেই হয়। এ যেন এক আবহমানকালের নিয়ম। শাশুড়ি, মা, কাকি, জেঠি যতই আধুনিকমনস্ক হন না কেন সংস্কার মানেন নিষ্ঠাভরেই।
প্রথম প্রসূতি যারা, তারা এমনিতেই একটু ভয়ে, দুশ্চিন্তায় থাকে। তাদের মনে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। এই নিষেধাজ্ঞা না মানলে যদি কোনও বড় ক্ষতি হয়?
মন সায় না দিলেও, বিরক্ত লাগলেও অনেক সময় ভয় এবং দ্বিধার কারণে তারা মেনে নেয়।
এই সমস্ত অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারের ট্রাডিশন চলছে চলবে…
সংস্কার কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেখে নেওয়া যাক গর্ভধারণ বিষয়ে দু-চার কথা—
গর্ভধারণ যে কোনও নারীর জন্য সুন্দর একটা সময়।
অনাগত সন্তানের সুস্থতার জন্য সব ধরনের মনোযোগ দেন একজন গর্ভবতী মা। যথেষ্ট সচেতন থাকেন তাঁরা। সেইজন্য তাঁরা মেনে চলেন নানা ধরনের নিয়মকানুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও বহু নারী এমন কিছু রীতিনীতি মেনে চলেন যেগুলো বংশ-পরম্পরায় কিংবা সামাজিকভাবে আবহমান কাল ধরে এই সমাজমানসে প্রোথিত।
একজন গর্ভবতী নারী গর্ভাবস্থায় কী করতে পারবেন বা কী খেতে পারবেন না এ-নিয়ে নানা ধরনের ধারণা বা বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে।
যদিও চিকিৎসক বা বিজ্ঞানীদের মতে এই সব ধারণা বা বিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক নেই।
এখন দেখে নেওয়া যাক, যুগ যুগ ধরে সেই ধারণা বা বিশ্বাসগুলো কী কী?
গ্রহণের বিধিনিষেধ
চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সময় হাঁটাহাঁটি করতে হবে। খাওয়াদাওয়া করা যাবে না। কোনও কিছু কাটাকুটি করা যাবে না, ধরা যাবে না ইত্যাদি। শুয়ে বা বসে থাকলে নাকি বাচ্চার ক্ষতি হয়।
গর্ভবতী মা যদি এই সময় কোনও কিছু কাটাকাটি করেন তাতে নাকি সন্তান ঠোঁট বা কানকাটা অবস্থায় জন্ম নেবে।
সন্তানের সৌন্দর্য
সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে এর উপরেই নাকি মায়ের সৌন্দর্য নির্ভর করে।
মায়ের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে মেয়েসন্তানের জন্ম হয় বলে গর্ভাবস্থায় মায়েদের চেহারা সুন্দর হয়ে যায় এটি একটি বহুল প্রচলিত ধারণা।
আবার পুত্রসন্তান গর্ভে থাকার সময় মায়ের সৌন্দর্য কমে যায়, গর্ভাবস্থায় ঘাড় কালো হওয়া না মোটা হয়ে যাওয়া মানেই আগত সন্তান পুত্র হবে।
অনেক সময় আবার এও বলা হয় গর্ভে পুত্র না কন্যাসন্তান রয়েছে তা গর্ভবতীর পেট দেখে বোঝা যায়।
এটিও একটি চিরাচরিত ধারণা। সন্তান ছেলে হলে পেট উপরের দিকে উঠে ছুঁচলো হয়ে যাবে, আবার কন্যাসন্তান হলে তলপেটের দিকে গোল থাকবে।
বাড়ির মা-কাকিমা-জেঠিমা গর্ভবতীকে সবসময় নির্দেশ দেন যে পেটিকোট বা সালোয়ারের দড়ি পেটের ওপরে শক্ত করে বেঁধে রাখার জন্য।
এতে নাকি স্বাভাবিক প্রসব হবে।
কোনওভাবেই সি সেকশন হবে না।
যদিও এই ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
খাবারে নিষেধাজ্ঞা
এবার আসা যাক গর্ভবতী মায়ের খাবারদাবারের দিকে। গর্ভবতী মায়ের খাবার-দাবারের ওপরে নির্ভর করে নাকি তার আগত সন্তানের গায়ের রং।
এমন ভুল ধারণাও প্রচলিত এই সমাজে সংসারে আজও।
গর্ভাবস্থায় অনাগত সন্তানের মা দুধ, দই, কেশর, গাজর, টম্যাটো কিংবা ডাবের জল খেলে সন্তানের গায়ের রং ফর্সা হয়।
আবার কফি খেলে নাকি পেটে থাকা সন্তানের রঙ কালো হবার সমূহ সম্ভাবনা।
আবার পেটের সন্তান বেশি নাড়াচাড়া করলে সেটি পুত্র এবং কম নাড়াচানা করলে সেটি কন্যা। এমন ধারণাও অনেকেই বলে থাকেন।
যদিও চিকিৎসকেরা এই ধরনের প্রচলিত অবাস্তব ধারণাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেন।
এইসব ধারণার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। দুধ দই বা অন্যান্য খাদ্য উপাদানে প্রোটিন থাকে যা শরীর গঠনে সহ-ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে সন্তান ফর্সা হওয়ার কোনও সংযোগ নেই।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে স্বনির্ভর বাংলা, রেকর্ড উৎপাদন, রাজ্যে প্রথম পেঁয়াজ সংরক্ষণ
বিধি ও নিষেধ
পেঁপে, আনারসের মতো কিছু কিছু খাবারে গর্ভপাতের আশঙ্কা থাকে বলে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে।
আবার মাছের মধ্যে ট্যাংরা মাছ খেলে বাচ্চার পেট বড় হবে কিংবা কলমি শাক বা পুঁই শাক খেলে বাচ্চার এনার্জি বাড়বে বলে এগুলো এড়িয়ে চলতে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা সবসময়ই পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এখানেও চিকিৎসকদের মতে ব্যক্তিবিশেষে নির্দিষ্ট খাবারের কোনও সংবেদনশীলতা না থাকলে গর্ভাবস্থায় আলাদা করে এর কোনও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই।
এছাড়াও আরও হাজারো বিধিনিষেধ নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজনদের বিধিনিষেধ চলতেই থাকে।
যেমন গর্ভাবস্থায় চুল কাটলে পেটের সন্তান জন্মানোর পর চোখে কম দেখে তাই গর্ভাবস্থায় চুলকাটা যাবে না।
আরও একটি ভুল ধারণা হল সন্তান আগমনের খবর সবার থেকে লুকিয়ে রাখা।
বাইরের লোকজন জানলে কুনজরের সম্তাবনা তাই কাউকে জানানো বারণ।
পায়ের আঙুলে আংটি পরা, চুলের আগায় আর শাড়ির কুঁচিতে সবসময় গিঁট বেঁধে রাখা, শত্রুপক্ষ জাতীয় কোনও মহিলাকে দেখলেই সরে থাকা।
‘নজর খরা’ অর্থাৎ কোনও মহিলার কুনজর পড়ে গেছে সন্দেহ হলেই গায়ে লোহা পুড়িয়ে তাপ দাও। এমন হাজারো অনুশাসন চলে প্রায় প্রতিটা পরিবারে।
প্রসূতির দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এতে যে কতটা ব্যাহত হয়, একজন হবু মায়ের রোজনামচায় কতটা যে চাপ ফেলে এই সমস্ত অন্তঃসারহীন উপদেশাবলি তা বলার নয়।
সন্তান-প্রত্যাশী যে কোনও নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ক্রান্তিলগ্ন হচ্ছে তার গর্ভধারণের সময়।
পরিবারে নতুন অতিথি আগমন, নিজের মাঝে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকা নতুন প্রাণের অস্তিত্ব, মা হিসেবে নতুন একটি পরিচয় তৈরি হওয়া— সব মিলিয়ে গর্ভবতী নারীর মন একদিকে যেমন আনন্দ, উৎকণ্ঠায় উদ্বেলিত হয়ে থাকে, অপরদিকে, সন্তান জন্মদান, তার সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত করা এবং মাতৃত্বের গুরুদায়িত্বের কথা ভেবে অস্থিরতা উদ্বেগ কিংবা শঙ্কাও কম হয় না।
আরও পড়ুন-এমএলএ সুপার গোল্ড কাপ
গর্ভবতী মায়ের করণীয়
কথায় বলে ‘শিশুর হাসিতে মায়ের খুশি’ আর এই হাসি দেখতে হলে মাকে গর্ভকাল থেকেই থাকতে হবে হাসিখুশি ও দুশ্চিন্তা মুক্ত। এখন প্রশ্ন হল সেটা কীভাবে?
গর্ভবতী মায়ের নিজের প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর জন্য বাড়তি খাবারের প্রয়োজন হয় তাই গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন খাবারের তালিকায় ভাত-মাছ সম্ভব হলে মাংস-ডিম-দুধ ঘন ডাল ইত্যাদি খেতে হবে।
এ ছাড়া গাঢ় সবুজ-হলুদ রঙের শাকসবজি, তাজা ফলমূল, পাকা আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নানা ধরনের শাক, মিষ্টি কুমড়ো— এসবই ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।
আবার অন্যদিকে আমলকী পেয়ারা, বাতাবি লেবু, কামরাঙা, পাতিলেবু, কাগজি লেবু, কুল ইত্যাদি খেলে সহজেই ভিটামিন সি-র অভাব পূরণ হবে।
যা গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য ক্যালসিয়ামও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যালসিয়ামের অভাবে উচ্চরক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই দুধ-ঘি-মাখন ডিমের কুসুম, ছোটমাছ, ডাল, মাংস এবং সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করা সম্ভব না হলেও বাড়িতে তৈরি স্বাভাবিক খাবার যেমন একটু বেশি ভাত, বেশি পরিমাণে ঘন ডাল, তরকারি এবং পর্যাপ্ত ফলমূল খেলে এই প্রয়োজন মিটবে।
গর্ভাবস্থায় মাকে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার যেমন মাংস, ডিম, মেটে, কাঁচকলা, কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাকও প্রতিদিন বেশি করে খেতে হবে। এসব ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খেলে ভিটামিন এ শরীরে আয়রন তৈরিতে সাহায্য করবে।
আয়োডিনযুক্ত নুন এবং সামুদ্রিক মাছ ও সামুদ্রিক মাছের তেল খেলেও আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয়।
প্রতিদিন দশ ঘণ্টা ঘুম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং প্রচুর জল খাওয়া দরকার।
একটি শিশুর সঙ্গে জন্ম হয় একজন মায়েরও।
তাই পরিবারের প্রত্যেকের উচিত গর্ভবতী নারীটির উপর শারীরিক ও মানসিক কোনও নিয়ম-নিষেধের চাপ না দিয়ে অসীম ভালবাসা, স্নেহ-যত্ন দিয়ে সুস্থ রাখা।