প্রত্যেক প্রাণী বা উদ্ভিদের একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য এটাই যে এরা নিজেদের মতো জীব উৎপাদন করতে পারে। এই কাজটা পারে বলেই প্রত্যেকটা জীব তার বংশবিস্তার করবার মধ্যে দিয়ে নিজেদের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখে। বংশবিস্তারের এই কাজটা জীব করে থাকে নানা উপায়ে— কখনও মাতৃগর্ভে সন্তান উৎপাদন ও প্রসবের মধ্যে দিয়ে, কখনও বা ডিম থেকে নতুন সন্তানের জন্ম দিয়ে। যেভাবেই করুক, সন্তান জন্ম দেওয়ার কাজটা মোটেই সহজ ব্যাপার নয়, এবং এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মায়েদেরই।
মাতৃগর্ভ থেকে সরাসরি জন্ম নেয় যেসব প্রাণীর সন্তান, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ নিষেক ঘটা। নিষেকের পর ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনে তৈরি হয় জাইগোট। সেটাই নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় ভ্রূণ। এই ভ্রূণই পরে মাতৃগর্ভে সন্তানের রূপ নেয়, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর সেই সন্তান প্রসব করে মায়েরা। জটিল এই প্রক্রিয়ার অনেকটাই এখন মানুষের কাছে পরিষ্কার, তবে প্রত্যেকটা ধাপই যে মানুষ বুঝে গিয়েছে এমনটা নয় কিন্তু। এখনও অনেকটা অংশই রয়ে গিয়েছে অধরা। প্রাণের উদ্ভব ঘটবার গোটা প্রক্রিয়ার অনেকটাই এখনও রহস্যের অন্তরালে।
নতুন প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি আরও একটা রহস্যময় ব্যাপার দেহের বিভিন্ন অংশের মূল যে একক, সেই কোষ (ইংরেজিতে cell) জিনিসটা। একজন মানুষের দেহে কত যে কোষ থাকে, সেটা বলা খুব মুশকিল। একটা তথ্য বলি, শুধু আমাদের মাথার খুলির মধ্যে থাকা প্রায় দেড় কিলো ওজনের মস্তিষ্কের মধ্যেই থাকে প্রায় ছিয়াশি বিলিয়ন (মানে আট হাজার ছ’শো কোটি) স্নায়ু কোষ। অন্যান্য কোষের কথা যদি বাদই রাখি, এই তথ্য থেকেই আন্দাজ পাওয়া যবে আশা করি যে গোটা দেহে কত কোষ থাকতে পারে।
আমাদের দেহের (বা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও) কোষের মধ্যে কিছু উপাদান থাকে, যেমন নিউক্লিয়াস, লাইসোজম, রাইবোজম, গলজি বস্তু বা মাইটোকনড্রিয়া। আমাদের দেহের যাবতীয় কাজকর্ম ঘটে মূলত কোষের মধ্যেই, আর সেগুলোর জন্য দায়ী এই কোষীয় অঙ্গাণুগুলোই। ওইটুকু একটা ছোট্ট জিনিস, যাকে মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখাই যায় না, তার মধ্যে যে কত সব প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে, জানলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। এই কোষের মধ্যে আবার সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস অবশ্যই নিউক্লিয়াস, ডিমের ক্ষেত্রে কুসুম বলে যেটার পরিচয় দিয়ে থাকি আমরা। এটা আমাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে ডিম একটা গোটা কোষ, ওটা দেখলে কোষের ব্যাপারে বেশ কিছু আইডিয়া পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন-একই নম্বরের এপিক কার্ড একাধিক রাজ্যে, বাংলার ভোটার তালিকায় গুজরাত-হরিয়ানার ভোটার!
কোষ প্রতিনিয়ত বিভাজিত হয়। একটা কোষ থেকে তৈরি হয় দুটো অপত্য কোষ। এটা আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে প্রত্যেকটা প্রাণীর দেহই কিন্তু তৈরি একটা কোষ থেকেই। বিভাজিত হতে হতে একসময় সেটা গোটা একটা জীবদেহে রূপান্তরিত হয়। আর এই গোটা প্রক্রিয়াটা সম্ভব হয় কোষ বিভাজন হতে পারে বলেই। তবে আমাদের দেহের সব কোষই যে বিভাজিত হয়, এমনটা নয় কিন্তু। চোখের লেন্সের কিছু কোষ বা স্নায়ুকোষ সাধারণত বিভাজিত হয় না। তাই এই কোষগুলো কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলে সহজে সারানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
এই কোষ বিভাজন ঘটে বলেই জীবের আকার বাড়ে, বা একটা জীব থেকে অন্য জীব জন্ম নিতে পারে, বা কখনও মৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষকে বদলানোর কাজেও এই কোষ বিভাজন ব্যাপারটা প্রযুক্ত হয়। কোষ বিভাজন ঘটে মূলত দুটো প্রক্রিয়ায়— একটার নাম মাইটোসিস, অন্যটা মিয়োসিস। প্রথমটা ঘটে দেহের আকার বৃদ্ধি বা ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রে যে কোষগুলোকে বিভাজিত করে নতুন কোষ তৈরির দরকার পড়ে, সেক্ষেত্রে। আমাদের দেহে এই বিভাজনই ঘটে থাকে বেশিরভাগ সময়। মাইটোসিস-এর সময় একটা কোষ থেকে একেবারে একইরকম দুটো কোষ তৈরি হয়। নতুন কোষ দুটোর সমস্ত বৈশিষ্ট্যই আদি কোষের মতোই হয়। আর মায়োসিস কোষ বিভাজন ঘটে থাকে নতুন জীব তৈরির সময়, বা অন্যভাবে বললে জীব যখন বংশবিস্তার করবার উদ্দেশ্যে ভ্রূণ বা ডিম উৎপন্ন করে, তখন। এই মায়োসিসের বেলায় যে-কোষগুলো তৈরি হয়, আদি কোষের সঙ্গে সেগুলোর ফারাক থাকে একমাত্র ডিএনএ সংখ্যায়। এখন প্রশ্ন মনে জাগতে পারে, ডিএনএ কী?
কী এই ডিএনএ
প্রত্যেক কোষের নিউক্লিয়াসে থাকে ক্রোমোজোম নামে এক বস্তু। এই ক্রোমোজোমের একটা অপরিহার্য অংশ হল ডিএনএ বা ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড নামের পলিমার অণু। আমাদের শরীরকে যদি একটা কম্পিউটার ধরা হয়, তাহলে সেই কম্পিউটারের কোড বা সঙ্কেত লেখা থাকে এই ডিএনএ-তেই। চার ধরনের রাসায়নিক ক্ষারীয় উপাদানে ডিএনএ গঠিত— অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন আর থিয়ামিন। এই চার ধরনের ক্ষারীয় উপাদান নিজেদের মধ্যে দুটো-দুটো করে জোড় বেঁধে থাকে— অ্যাডেনিনের সঙ্গে থিয়ামিন আর সাইটোসিনের সঙ্গে গুয়ানিন। এগুলোর সঙ্গে আরও নানা ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিডের অণুও থাকে, সব মিলিয়ে তৈরি হয় ডিএনএ-র ওই পরিচিত দ্বি-সর্পিল প্যাঁচালো সিঁড়ির মতো গঠন। ক্রোমোজোমে আবার থাকে হিস্টোন নামে এক ধরনের প্রোটিন যারা এই সরু চুলের মতো লম্বা ক্রোমোজোমের আকারকে গুটিয়ে কোষের মধ্যে ধরিয়ে ফেলবার মতো উপযুক্ত করবার কাজে দায়ী। কোষের যাবতীয় কাজকর্মের নির্দেশ আসে এই ক্রোমোজোম থেকেই।
আরও পড়ুন-এক বছরে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে প্রায় ৯০ কোটির চিকিৎসা পরিষেবা নদিয়াতেই
প্রত্যেকটা কোষে ঠিক কতগুলো ক্রোমোজোম থাকবে, সেটা আগে থেকেই স্থির করা থাকে। এই সংখ্যা আবার প্রাণী-ভেদে আলাদা, মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা হল তেইশ জোড়া। প্রত্যেকটা মানুষ কেন অন্য মানুষের চেয়ে আলাদা, সেই পার্থক্যটা নির্ধারিত হয়ে যায় বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকা ডিএনএ আর জিনের মধ্যেকার ফারাক থেকে। জিন ডিএনএ-রই একটা অংশ, বাবা-মায়ের শরীর থেকে এই জিনই সন্তানের দেহে আসে, এবং এটাই প্রকৃত অর্থে উত্তরাধিকার বহন করে আনে।
এই ডিএনএ অণুর চারটে ক্ষারীয় অংশ প্যাঁচালো সিঁড়ির মতো হয়ে থাকে শুরু নয়, এটা গুটিয়ে খুব ছোট্ট একটা জায়গায় এমনভাবে থাকে, যাতে একটা কোষের মধ্যেই ধরে যায়। একটা ডিএনএ-কে পুরোপুরি টেনে লম্বা করতে পারলে সেটা একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান লম্বাই হবে। যখন কোনও কোষের ডিএনএ থেকে আর একটা অবিকল প্রতিরূপ তৈরির পরিস্থিতি আসে, তখন ওই ডিএনএ-র সিঁড়ির মতো গঠনের দুটো জোড় খুলে যায়।
যে-কোনও প্রাণীর দেহ বয়স বাড়লে বড় হতে থাকে। অথবা কোনও জায়গায় কোষ নষ্ট হয়ে গেলে সেখানে দরকার হয় নতুন কোষের। আদি কোষ থেকে নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়াকে বলে কোষ বিভাজন। একটা কোষ ভেঙে দুটো নব্য কোষ তৈরি হওয়ার যে প্রক্রিয়া, সেখানে ওই কাজটা শুরুর আগেই ডিএনএ বিভাজনটা সম্পন্ন হয়ে যায়। আর এই ডিএনএ বিভাজনেরই কাজটা হয় প্রতিলিপি গঠনের মধ্যে দিয়ে।
ডিএনএ-র প্রতিলিপি গঠন
একটা কোষ থেকে অসংখ্য কোষ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রত্যেকটা নতুন কোষে একেবারে অবিকল আগের কোষের মতোই ডিএনএ সজ্জা। প্রত্যেকটা ডিএনএ অবিকল নিজের মতো নতুন ডিএনএ তৈরি করে চলেছে প্রতি মুহূর্তে। এর চেয়ে আজব ঘটনা বড় একটা দেখা যায় কি প্রকৃতিতে?
প্রত্যেক জীবের যা-যা বৈশিষ্ট্য, সে পূর্বপুরুষানুক্রমে বাহিত হয়ে আসুক বা নতুনভাবে অর্জিত হোক, আসল যে জায়গায় সেগুলো লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে, সেটাই হল এই ডিএনএ। সুতরাং নতুন যে কোষ তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতেও আগের কোষের মতোই অবিকল ডিএনএ ঠিক তৈরি হয়েই চলেছে। প্রত্যেকটা ডিএনএ তার আদি ডিএনএ-র (মানে যার থেকে সে তৈরি) মতো একদম একইরকম, একটুও আলাদা নয়। এটাই ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ (বা DNA replication)। সংক্ষেপে বললে ব্যাপারটা এইরকম: কোষের মধ্যের ডিএনএ যখন দুটো টুকরোয় বিভক্ত হয়ে আদি ডিএনএ-র মতোই একেবারে অবিকল কপি হয়ে দাঁড়ায়, সেই ঘটনাই ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ। এই পদ্ধতিতেই আমাদের দেহে প্রতিনিয়ত ডিএনএ-র সংখ্যা বদলাতে থাকে। একটা কোষে তো বড় কম ডিএনএ থাকে না। কয়েক কোটি তো হবেই। অতগুলো ডিএনএ নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে চুপচাপ নিজেদের কপি তৈরি করে একটা নতুন কোষের মধ্যে সজ্জিত হয়ে যাচ্ছে, এ কি সহজ কাজ? অথচ এইরকম একটা জটিল প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে সমস্ত জীবের দেহেই।
ডিএনএ গঠন : কার আবিষ্কার
ডিএনএ অণুর বিশেষ প্যাঁচালো গঠন আবিষ্কার করবার কাজে অন্তত তিনজন বিজ্ঞানীর অবদান সবচেয়ে বেশি—যাঁদের মধ্যে দু’জনকেই মূলত এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। এঁরা হলেন জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক। এঁদের প্রথমজন এখনও জীবিত, বয়স ছিয়ানব্বই। সত্তর বছরেরও বেশি আগে ১৯৫৩ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তাঁরা এই গঠনে কথা প্রথম প্রকাশ করেছিলেন।
ওঁদের ওই আবিষ্কারে ভূমিকা ছিল আরও কয়েকজনের: যেমন রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, বা মরিস উইলকিনস। এক্স রশ্মির সাহায্যে অণুর গঠনের ছবি তুলেছিলেন এঁরা, সেখান থেকেই ওয়াটসন-ক্রিক ওই ঐতিহাসিক আবিষ্কারটি করতে পেরেছিলেন। অবশ্য নোবেল কমিটি পুরস্কার দিয়েছিল ওয়াটসন, ক্রিক আর উইলকিনস-কে। রোজালিন্ড ততদিনে প্রয়াত, নইলে এই পুরস্কারের যোগ্য দাবিদার ছিলেন তিনিও।
ওই সালে ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর গত কয়েক দশকে এই সংক্রান্ত গবেষণায় নতুন দিশা উন্মোচিত হয়েছে। হিউম্যান ক্লোনিং, ডিএনএ ম্যাপিং, ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং, জেনেটিক নানা অসুখের চিকিৎসা বা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং জাতীয় বেশ কিছু ঘটনার কথা আমরা চারদিকে দেখতে পেয়েই থাকি। মলিকিউলার বায়োলজি বিষয়টাও এতটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছে এই আবিষ্কারের কল্যাণেই। আগামী দিনে মানুষ যদি অবিকল আর একজন মানুষের প্রতিরূপ বানিয়ে ফেলতে পারে কখনও, সেটার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকবে এই ডিএনএ-র গঠন-চিত্রেরই।
সাম্প্রতিক এক আবিষ্কারের কথা
এবার আসা যাক একেবারে হাল আমলের এক আবিষ্কার-প্রসঙ্গে। গত অগাস্ট মাসের শেষ দিকে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এই খবর। জাপানের ‘রিকেন সেন্টার ফোর বায়োসিস্টেমস ডিনামিক্স’ নামে এক প্রতিষ্ঠানের এক গবেষক ইচিরো হিরাতানি (Ichiro Hiratani) এবং তাঁর সহকারীরা মিলে দেখিয়েছেন যে আদি ভ্রুণের মধ্যে যেভাবে ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ হয় বলে আগে মনে করা হত, সেটা আসলে একটু অন্যরকমভাবে হয়। আর ওই ঘটনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ক্রোমোজোম-সংক্রান্ত সমস্যার চাবিকাঠি।
ডিএনএ-র প্রতিলিপিকরণ ব্যাপারটা ঘটে প্রাণীর একেবারে আদিপর্ব— মানে জন্মের সূচনা থেকেই। তবে সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। এবার সেই প্রসঙ্গে আসি।
আরও পড়ুন-সেই মুম্বইয়ে আটকাল মোহনবাগান
ভ্রূণের মধ্যে কীভাবে ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ ঘটে
যে-কোনও কোষের ডিএনএ কিন্তু পুরোটা একসঙ্গেই নিজের প্রতিরূপ তৈরি করে ফেলে, এমনটা নয়। সেটা হওয়ার কিছু ধাপ থাকে। সাধারণ কোষ বিভাজনের ক্ষেত্রে কোষের ক্রোমোজোমের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে নিজের প্রতিরূপ তৈরি করতে থাকে। ভ্রূণ-গঠনকালে নিষেক ঘটবার তৃতীয় দিনে ভ্রূণ তিনবার বিভাজিত হয়ে মোট ষোলোটা কোষে পরিণত হয়। আর এই প্রত্যেকটা কোষ বিভাজনের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে ডিএনএ বিভাজনও। যার ফলে প্রত্যেকটা নতুন কোষে আগের কোষের অবিকল জিন-চেহারা ফিরে ফিরে আসতে থাকে। জাপানের এই গবেষকদল ওই সময়কালেই ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ বিষয়টায় নজর দিয়েছিলেন, আর এজন্য তাঁরা ইঁদুরের দেহে নিষেক ঘটবার পর একটা একক ভ্রূণ-কোষ থেকে যখন একাধিক কোষ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়, সেই সময়ে ওই ঘটনার বেশ কিছু ছবি তুলতে পেরেছিলেন।
জাপানের এই গবেষকদলের একটা বড় কৃতিত্ব, তাঁরাই প্রথম এটা দেখাতে পেরেছেন যে ভ্রূণের মধ্যে কোনও কোষের প্রতিরূপ তৈরির সময় ডিএনএ তার প্রতিরূপ তৈরি করে একটা ধাপেই, সেখানে একাধিক অংশ একাধিক ধাপে প্রতিরূপ তৈরি করে, এমনটা ঘটে না। যদিও বিভিন্ন বইপত্রে এমনটাই এতদিন লেখা হয়ে এসেছে যে ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ ঘটে থাকে একাধিক ধাপেই। ক্রোমোজোমের বিভিন্ন অংশের প্রতিলিপি তৈরি হয় বিভিন্ন সময়ে। আবার তাঁরা এটাও দেখেছেন যে এই প্রতিলিপিকরণ ঘটবার সময়কালে পরের দিকে (মানে প্রথম থেকে শুরু করে কয়েকটা কপি হয়ে যাওয়ার পর) মাঝেমধ্যেই কিছু ত্রুটি দেখা যায়, যার প্রভাব পড়ে ক্রোমোজোমের ওপর। সেইসব ক্রোমোজোমের চেহারায় তখন রয়ে যায় কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার। যেমন কখনও তার চেহারা হয় অন্যরকম, কখনও দেখা যায় বাড়তি দু’-একটা কপি তৈরি হয়ে গিয়েছে, বা কখনও দেখা যায় অসম্পূর্ণ একটা কপি বাড়তি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওঁদের ধারণা এই ধরনের সমস্যার জন্যেই মহিলাদের গর্ভে কখনও কখনও ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়। বা কখনও সদ্যোজাতের দেহে দেখা যায় ডাউন সিনড্রোমের মতো অসুখ।
আরও পড়ুন-এক বছরে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে প্রায় ৯০ কোটির চিকিৎসা পরিষেবা নদিয়াতেই
কী কাজে লাগতে পারে এই আবিষ্কার
যেহেতু এই ঘটনার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে ওই বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যাওয়া বা ভ্রূণের মধ্যে এমন কিছু সমস্যা তৈরি হওয়ার মতো ব্যাপার, যা ওই ভ্রূণ থেকে জন্ম নেওয়া নবজাতকের শরীরে রয়ে যায়, সে-জন্য ওঁরা আশাবাদী যে আগামী দিনে ওঁদের এই গবেষণা বিশেষভাবে পথ দেখাবে ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ (একে সংক্ষেপে বলে আইভিএফ) পদ্ধতিতে যে সন্তান জন্ম দেওয়া হয়, সেটার ওপর। মাতৃদেহের কোনও সমস্যার জন্য অনেক সময় ইদানীং নিষেক-প্রক্রিয়া ঘটানো হয় মাতৃদেহের বাইরে, কোনও আবদ্ধ জায়গায়। সেখানেই তৈরি করে নেওয়া হয় ভ্রূণ। তারপর সেই ভ্রূণকে স্থাপিত করা হয় মাতৃদেহে। আমাদের দেশে ১৯৭৮ সালে এই পদ্ধতিতে প্রথম কোনও শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন এক বাঙালি ডাক্তার, তাঁর নাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তার সেই আবিষ্কার তখনকার ডাক্তার-সমাজ বা সরকারি আমলাতান্ত্রিকতার কাছে প্রশংসনীয় মনে হয়নি, তাই তাঁকে তখন নানাভাব হেনস্থা করা হয়েছিল। সেই চাপে ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায় আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৮১ সালে। অনেক পরে অবশ্য তাঁর স্বীকৃতি মিলেছিল।
ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে আগামী দিনে কাজকর্ম চলবে, উঠে আসবে আরও নানা আকর্ষণীয় তথ্য বা তত্ত্ব। সেদিকে আমাদের নজর রাখতেই হবে। দেহের একটা ছোট্ট কোষের মধ্যে কত যে রহস্য লুকিয়ে, তা কি কোনও টানটান গোয়েন্দা গল্পের চেয়ে কম?