ভোটার তালিকায় ভূতের উৎপাত

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলের সভা থেকে ভুয়ো ভোটার নিয়ে সরব হন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি এপিক নম্বরে একাধিক ব্যক্তির ভোটার কার্ডের তথ্য তুলে ধরেন তিনি। তার জন্য ভোটার তালিকা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে দলের সর্বস্তরের কর্মীদের নির্দেশ দেন। কেন এই বিভ্রান্তি, কেন এত ধোঁয়াশা? লিখছেন সরোজিনী নাইডু কলেজ ফর উইমেনের সহকারী অধ্যাপক আজিজুল বিশ্বাস

Must read

ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম প্রধান ভিত্তি হল অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকা সংক্রান্ত বিতর্ক নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি অভিযোগ তুলেছেন যে, বিজেপি ভিনরাজ্যের ভোটারদের পশ্চিমবঙ্গের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করার ষড়যন্ত্র করছে। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এক ভাষণে তিনি প্রকাশ্যে প্রমাণ তুলে ধরে দেখিয়েছেন যে, বাংলার বিভিন্ন জেলার বহু ভোটারের সঙ্গে গুজরাত, হরিয়ানা, রাজস্থান এবং বিহারের লোকদের একই এপিক নম্বর রয়েছে।

নির্বাচন কমিশন একে প্রযুক্তিগত ত্রুটি বলে ব্যাখ্যা দিলেও প্রশ্ন থেকেই যায়— এই ত্রুটি কেন এতদিন ধরা পড়েনি? কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি সামনে আনার পরই কমিশন তড়িঘড়ি বিজ্ঞপ্তি জারি করল? এর আগে মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার নির্বাচনে বিরোধীরা যখন ভোটার তালিকার গরমিলের অভিযোগ তুলেছিলেন, তখন কেন কমিশন বিষয়টি স্বীকার করেনি?
এই বিতর্ক শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতার বিষয় নয়, এটি গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর ওপর গুরুতর আঘাত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ অনুযায়ী, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বহিরাগতদের ভোটার তালিকায় যুক্ত করে এবং একই এপিক নম্বর ব্যবহার করে বিভিন্ন রাজ্যের মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। নির্বাচন কমিশন যদিও দাবি করছে যে এটি পুরোনো ডেটাবেস মাইগ্রেশনের সময় সৃষ্ট একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা, কিন্তু প্রশ্ন হল— এটি আগে ধরা পড়েনি কেন? যদি এটি নিছক ত্রুটি হত, তবে কি এতদিন এ নিয়ে কোনও বিতর্ক হয়নি? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, যদি একজন ভোটার শুধুমাত্র সেই কেন্দ্রেই ভোট দিতে পারেন যেখানে তাঁর নাম রয়েছে, তাহলে কেন পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় বহিরাগতদের নাম পাওয়া যাচ্ছে? এটি কি নিছক প্রশাসনিক গাফিলতি, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত?
নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দলগুলি অভিযোগ করেছে যে কমিশন শাসক দলের সুবিধার্থে কাজ করছে। এবারও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন— যখন তিনি এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আনলেন, তখনই কেন কমিশন দ্রুত বিজ্ঞপ্তি জারি করল? যদি এটি পুরোনো সমস্যার অংশ হয়, তাহলে এতদিন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? কেন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন বা তারও আগে এই সমস্যা আলোচনায় আসেনি? কেন হঠাৎ ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এটি সামনে এল? এই বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া কি কেবল প্রশাসনিক গাফিলতি, নাকি রাজনৈতিক চাপের ফল? যদি নির্বাচন কমিশন সত্যিই নিরপেক্ষ হত, তবে কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ না-ওঠা পর্যন্ত তারা চুপ করে থাকত?
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক লড়াই ক্রমেই তীব্র হচ্ছে এবং বিজেপি এখানে নিজেদের শক্তি বাড়াতে মরিয়া। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা ১৮টি আসন দখল করেছিল, যা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কমে আসে। এরপর থেকেই দলটি আরও আগ্রাসী কৌশল নিচ্ছে। যদি সত্যিই বহিরাগতদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে, তবে সেটি শুধু নির্বাচনী আইন ভঙ্গ নয়, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির ওপর আঘাত। এর আগেও উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার নির্বাচনে একই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। বিজেপি-বিরোধী দলগুলি দাবি করেছিল যে হিন্দি বলয়ের কিছু রাজ্যে বহিরাগত ভোটার এনে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয়েছে। এবার পশ্চিমবঙ্গেও সেই একই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।

আরও পড়ুন- কেন্দ্রের বঞ্চনা, কম্পোজিট গ্রান্টে অর্থ বরাদ্দ রাজ্যের

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু অভিযোগ তোলেননি, তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন, বুথভিত্তিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভোটার তালিকা বিশুদ্ধ করতে হবে। দলীয় স্তরে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা প্রতিটি বিধানসভা কেন্দ্রের ভোটার তালিকা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবে। এটি নিছক রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই। কারণ, যদি সত্যিই বহিরাগতদের অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনে কারচুপি করা হয়, তবে তা জনগণের স্বাভাবিক ভোটাধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার শামিল।
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, আধার কার্ডের মতো ভোটার কার্ডেও কেন ইউনিক নম্বর থাকবে না? আধার কার্ড প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বতন্ত্র, অথচ ভোটার কার্ডের ক্ষেত্রে একই নম্বর একাধিক ব্যক্তির মধ্যে ভাগ হয়ে যেতে পারে— এটি কীভাবে গ্রহণযোগ্য?
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা ‘ইউনেট ২.০’ পোর্টাল আপডেট করছে, যাতে ভবিষ্যতে এই সমস্যা আর না থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন এতদিন এটি হয়নি? কেন আধার-ভোটার কার্ড সংযুক্তকরণের কথা বলা হলেও, এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি? ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক ইস্যু নয়, এটি গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন। যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনিয়ম থাকে, তবে জনগণের আস্থা দুর্বল হবে, এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার পরই কমিশনের তৎপরতা প্রশ্নের জন্ম দেয়। যদি তিনি অভিযোগ না তুলতেন, তাহলে কি নির্বাচন কমিশন চুপ করে থাকত? যদি এই সমস্যাটি এতদিন থেকে থাকে, তবে তা ঠিক করতে এত সময় লাগল কেন? ভোটার তালিকা সংক্রান্ত এই বিতর্ক নিছক প্রশাসনিক গাফিলতি, নাকি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র— তা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি বিষয়টি সামনে না আনতেন, তাহলে হয়তো এটি এত বড় ইস্যুতে পরিণত হত না।

গণতন্ত্রের ভিত্তি হল বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। যদি ভোটার তালিকা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তবে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে। পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংক্রান্ত এই বিতর্ক তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, নির্বাচন কমিশন কতটা নিরপেক্ষভাবে এই সমস্যার সমাধান করবে? যদি তারা সত্যিই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়, তবে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে ভোটার তালিকাকে বিশুদ্ধ করতে হবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই লড়াইয়ে প্রথম কণ্ঠস্বর তুলেছেন, যা পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র রক্ষার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন কতটা কার্যকর ভূমিকা নেয় এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য কতটা সচেতন থাকেন।

Latest article