অথ নারীদিবস কথা, ঘুম ভাঙানোর দিনের পাঁচালি

ক্যালেন্ডারে নারীদিবস চলে গেলেও তার রেশ রয়ে যায়। সেই রেশের ওম মেখে মেয়েদের জন্য আলাদা একটা দিন বেছে নেওয়ার রীতি রেওয়াজের ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা জেনে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। সেই জরুরি কাজটাই করছেন পৌলমী ভট্টাচার্য

Must read

বাংলায় রেনেসাঁর আলো চেতনার গভীরে যূথবদ্ধ বলেই কুসংস্কারের শিকড় ধরে টান দেওয়া সহজ। কিন্তু সেই সহজ কাজটাও কখনও কখনও কঠিন হয়ে ওঠে। তবে, এ কেবল বাংলার জন্যই নয়। অশিক্ষার অন্ধকারের সঙ্গে সভ্যতার পাঞ্জা লড়াই তো সারা পৃথিবীর মানব ইতিহাসের পারম্পর্য। এ সত্য মেনে নিয়েই সমস্যার মূলে পৌঁছে মানুষ লড়াই চালিয়ে গেছে আমরণ। আর সেজন্যই আজও ‘নারীদিবস’-এর আলাদা অস্তিত্ব। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন আজকের এই প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের প্রশ্নে, যেখানে সব উত্তর একই রেখায় গিয়ে শেষ হয়, সেখানে আলাদা করে, নারীদিবসের পালন, কতটা যুক্তিযুক্ত। আর এই প্রশ্ন থেকেই সত্যি সত্যি শুরু হয়, নারীদিবস পালনের আসল প্রতিপাদ্য। নারীর শ্রম, নারীর মেধা, সর্বোপরি অস্তিত্বকে স্বীকার করতে সভ্যতার দ্বিধা বারংবার প্রমাণিত। ভারতীয় সংস্কৃতির পর্দা প্রথা বা নারীশিক্ষার অপ্রতুলতার কথা বহুল প্রচারিত। (যদি অবশ্য বৈদিক যুগের ভারতীয় নারীপ্রজ্ঞার ভূয়সী অন্বেষণকে আলোচনার বাইরে রাখা হয়) কিন্তু, ইউরোপীয় সভ্যতার ক্ষেত্রেও যে বিশেষ আালাদা কোনও চিত্র নেই, সেটি একনিষ্ঠ অনুশীলনে আসে না। বাস্তবে, মাত্র ১২৪ বছর আগেও, নারীর আদৌ কোনও ভোটাধিকারই স্বীকার করা হত না ইউরোপে। মৌলিক অবস্থানের দিক থেকে দেখতে বসলে, একথা খুব ভাল বোঝা যায় যে, নারী মানেই কোথাও যেন একটা খামতির বোঝা আগাগোড়া গাঁথা ছিল। আর সেই বোঝাটিকে সপাটে সরিয়ে, আট ঘণ্টা কাজের দাবিদার একঝাঁক নারী শ্রমিকের অধিকার আধুনিক পৃথিবীতে অন্য এক পদাবলি তৈরি করল। যাকে নারীদিবসের মর্যাদা ছাড়া অন্য কোনও অভিধায় ভূষিত করা শুধু অন্যায় নয়। পাপ হবে।

আরও পড়ুন-মোহনবাগানের কোচ হওয়া চাপের : মোলিনা

ইতিহাস বলছে, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই মিছিলে চলে সরকার লেঠেল বাহিনীর পীড়ন। ১৯০৯ সাল। ২৮ ফেব্রুয়ারি। নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে হল সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারীদিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। ১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ উদযাপিত হল নারীদিবস। অতঃপর ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চকে দেওয়া হল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি জাতিসংঘের। ডাক দেওয়া হল, বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালনের জন্য। সাড়া মিলল সোচ্চারে। গোটা পৃথিবী জুড়ে। নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় ভাবনাটি আরও বেশি করে লগ্ন হয়ে রইল শ্রমে-ত্যাগে একটি দিনের পালনে।
নারীদিবস (পূর্বনাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারীদিবস) প্রতি বছর পালিত মার্চ মাসের ৮ তারিখ। সারা বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের এক-এক প্রান্তে এর উদ্‌যাপনের প্রধান লক্ষ্য এক-একরকম। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা। আবার কোথাও নারীর আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতি গুরুত্ব। তবে, আন্তর্জাতিক নারীদিবসের মূল লক্ষ্যটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কেউ৷ জনজীবনের নিরিখে সারা পৃথিবী জুড়ে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার মূল সূত্রটিই এখানে প্রধান বিবেচ্য। দুর্ভাগ্য এই যে, সারা পৃথিবী জুড়ে সমাজের স্তরে স্তরে লিঙ্গবৈষম্য। তারই, ফলস্বরূপ, কন্যাভ্রূণ হত্যা, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহের মতো অজস্র সমাজ অসুখ। এক-এক সমাজে এর চেহারা এক-এক হলেও আদতে রূপ এক। পিতৃতান্ত্রিকতার সুযোগে বেশিমাত্রায় সুবিধা ভোগ করা একদল পুরুষের অমানবিক আস্ফালনের সামনে প্রকৃত সত্য অনুধাবনের দিন তাই ৮ মার্চ। আর ঠিক সেই কারণেই এ-দিনটির গুরুত্ব গভীর, অনিবার্য। শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির মতো উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে ঘর গেরস্থালির ছোট-বড় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নারীর মতামত ও অস্তিত্বের অস্তর্থক দিকটিকে আরও একবার কুর্নিশ করার সুযোগ, এই দিনটি।
নারীকৃতিত্বকে সম্মান এবং লিঙ্গবৈষম্য সম্পর্কে আপামর জনতার সচেতনতাই একমাত্র দাবি করতে পারে আগামী পৃথিবীর সুস্থতা। তাই নির্দ্বিধায় নারীশিক্ষার প্রসার আর লিঙ্গ পক্ষপাতদুষ্ট সমাজের অবসানের লক্ষ্যে নারীদিবস পালনের সার্থকতা। একটি দিনের যাবতীয় উদযাপন যাপনে বিশ্বাসে কতটুকু কর্তব্যবোধের আলো এনে দিতে পারে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ ভাবনায়, তাও মনে রাখার। সেজন্যই বছর বছর উদ্‌যাপনের লক্ষ্যটিতে সংযোজিত একটি করে বিশেষ ভাবনা৷ এবছর আন্তর্জাতিক নারীদিবস ২০২৫-এর থিম, ‘সকল নারীর জন্য: অধিকার সমতা। ক্ষমতায়ন।’ এই থিম একই সঙ্গে সমস্ত নারীর অধিকার সমতা এবং ক্ষমতায়নের বিশিষ্টতাকে আহ্বান জানায়। মনে রাখতে হবে, এ আহ্বান সর্বস্তরের।

আরও পড়ুন-শান্তিনিকেতনে নিষেধাজ্ঞা, অভাব মেটাতে তৈরি মহিষাদল রাজবাড়ির আম্রকুঞ্জে বসন্তোৎসব

আন্তর্জাতিক নারীদিবস ২০২৫-এর ক্যাম্পেইন থিমই হল, ‘এক্সিলারেট অ্যাকশন’। এই থিমের মাধ্যমে নারীর অগ্রগতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন কৌশল, সরঞ্জাম এবং উদ্যোগের ব্যবহারকে স্বীকৃতি ও প্রচারের আলোয় আানার চেষ্টা। আর এ-দায়িত্ব বছরভর। প্রশাসনিক সাহায্য, সরকারি প্রকল্পের আওতা এগিয়ে দেবে এবং এগিয়ে দিয়েছে নারীর সার্বিক অবস্থান। একে স্বীকার করেও বলতে হয় সর্ব অর্থে গণজীবনের গভীরে নারী মননের বিকাশ সার্বিক না হলে, নারীমুক্তির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। ৮ মার্চ, সেই মননের ঘুম ভাঙানোর দিন৷

Latest article