বিশ্বগুরু হওয়ার এ কোন পথ দেখাচ্ছেন মোদিজি

বিজ্ঞান গবেষণাকে অবহেলা করে হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্ব নিয়ে মাতামাতি করলেই বুঝি ভারত বিশ্বগুরু হয়ে যাবে? প্রশ্ন তুললেন সরোজিনী নাইডু কলেজ ফর উইমেন-এর সহকারী অধ্যাপক আজিজুল বিশ্বাস

Must read

ভারত কি সত্যিই বিশ্বগুরু হতে চলেছে? যদি হয়, তবে কোন পথে? একদিকে মোদি–যোগী সরকারের যৌথ উদ্যোগে ৭৫০০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কুম্ভমেলার বিশাল আয়োজন, অন্যদিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবসকে প্রায় অবজ্ঞা করা— এই দুই প্রবণতা ভারতের ভবিষ্যতের অভিমুখ সম্পর্কে এক গভীর প্রশ্ন তোলে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রচেষ্টায় সনাতন হিন্দুত্বের জাগরণ একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল হয়ে উঠেছে। কুম্ভমেলা চিরকালই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক পবিত্র মিলনক্ষেত্র। ভারতে কুম্ভমেলা শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি কোটি কোটি মানুষের সমাবেশের একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে স্নান করলে পাপমোচন হয় এবং মোক্ষ লাভ হয়। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে বিজেপি শাসনের অধীনে এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রকল্পের রূপ নিয়েছে। ‘১৪৪ বছর পরের মহাযোগ’— এই জাতীয় প্রচার কোনও ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর নির্ভর না করেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। প্রশ্ন হল, সত্যিই কি ১৪৪ বছর পর এমন কোনও বিরল মহাযোগ এসেছে, নাকি এটি এক রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ডিং’ মাত্র?
আসলে বিজেপির লক্ষ্য হচ্ছে, কুম্ভমেলার মতো বিশাল ধর্মীয় সমাগমকে একটি জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো। এটি শুধুই ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণার প্রচারের এক সুবর্ণ সুযোগ। কুম্ভমেলার সময় প্রধানমন্ত্রীর ছবি ও বক্তব্য সম্বলিত বিশাল প্রচারাভিযান, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ধর্মীয় পুনর্জাগরণ’, এবং সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ— এসবই পরিকল্পিত রণকৌশলের অংশ। এমনকী ভোটের ময়দানকেও প্রভাবিত করার সূক্ষ্ম পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে এই কুম্ভস্নানের ব্যবস্থাপনায়। যেমন, এবার দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনের দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কুম্ভ স্নানের আয়োজনে কোথাও না কোথাও ধর্মীয় ভাবাবেগে ইভিএমে গেরুয়া বিপ্লব ঘটানোর নিখুঁত চিত্রনাট্য পরিকল্পিত হয়েছিল, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। ২০১৯ এবং ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট প্রচার শেষ হয়ে যাবার পরও শেষ পর্বের ভোটকে প্রভাবিত করতে কৌশলে নরেন্দ্র মোদি ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিতে কখনও কেদারনাথ কখনও বিবেকানন্দ রকে ধ্যানমগ্ন থাকার মেগাইভেন্ট গোদি মিডিয়ার সৌজন্যে আসমুদ্র-হিমাচল নিমেষে পৌঁছে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতির পাশাখেলায় সাফল্য লাভের প্রয়োজনে মোদি–শাহ–যোগীরা সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বারবার সনাতন হিন্দুর জাগরণকে সামনে রাখছে, তার নমুনা নবনির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন থেকে সাম্প্রতিক মহাকুম্ভের মেগা ইভেন্টের মধ্যে ধরা পড়ছে। আর এর জন্য সরকারি রাজকোষ থেকে জলের মতো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। এই ধর্মীয় ইভেন্টগুলির মাধ্যমে বিজেপি নিজেকে সনাতনী হিন্দু জাগরণের ‘স্বঘোষিত ঠিকাদার’ রূপে জনমানসে খাড়া করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এবারের মহাকুম্ভে নাকি ৬৪ কোটি সনাতনী হিন্দুর মহাসম্মেলন ঘটেছে এক মাসের স্নানপর্বে! সংখ্যাটি বাস্তবে সম্ভব কিনা— সে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে অন্য আরেকটি বিষয় তুলে ধরলে বোঝা যাবে এই দাবির সত্যতা। ১৪০ কোটির দেশ ভারতে সর্বশেষ লোকসভার ভোটে মোট নথিভুক্ত ভোটার ছিল প্রায় ৯৭ কোটি। এর মধ্যে প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট সাড়ে ২৩ কোটি। অর্থাৎ তাই মহাকুম্ভের ‘স্বঘোষিত ঠিকাদার’ বিজেপি নিজেকে ভাবতেই পারে, কিন্তু সব সনাতনী হিন্দুই যে বিজেপির ভোটার নয়, এবং মোদি-শাহ–যোগীর গেরুয়া ব্রিগেড যে হিন্দু ধর্মের একমাত্র ‘মাই বাপ’ নয়, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। অথচ তাঁরা রাজনীতির পাটিগণিতে চোখ বুলিয়ে রাষ্ট্রীয় মোড়কে হিন্দুত্বের ব্র্যান্ডিং করে যাচ্ছে।
অথচ মানুষ যে কারণে মূলত ভোট দিয়ে সরকার গঠনে রায় দেয়, তা হল ‘রুটি–কাপড়া আউর মাকান’, ‘বিজলি-সড়ক-পানি’ ‘শিক্ষা-স্বাস্থ্য-শিল্প-কৃষি-বিজ্ঞান’-র প্রসার। কিন্তু বর্তমান বিজেপি–আর এস এসের নেতারা এই বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার না দিয়ে ‘হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান’-এর স্লোগান বাস্তবায়নে বুঁদ হয়ে আছে। অথচ বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর দেওয়া ‘জয় জোয়ান, জয় কিষান’ স্লোগানকে ‘জয় জোয়ান, জয় কিষান, জয় বিজ্ঞান’-এ উত্তীর্ণ করেছিলেন। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ‘জয় শ্রীরাম’–এ আটকে গিয়েছে। স্বাধীনতার পর ‘সবুজ(কৃষি)-শ্বেত(দুগ্ধ)-নীল (মৎস্য) বিপ্লব’- এর দেশে পরিণত হওয়া ভারত আজ মোদির জমানায় কেবলই ‘গেরুয়া (হিন্দু রাষ্ট্র) বিপ্লব’-এর জন্য যারপরনাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এঁদের কে বোঝাবে যে, ‘ধর্মরাষ্ট’ গঠনই যদি সুখী ও সফল রাষ্ট্র গড়ে তোলার একমাত্র শর্ত হত, তবে আজ ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ পাকিস্তানের দশা অন্যরকম হত! অথচ এই সব উদাহরণ ভুলে মোদি সরকার ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে এতটাই মশগুল যে, গেরুয়া বাহিনীর উদাসীনতায় দেশের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ কমছে। কিন্তু এক ধর্মীয় মেলায় কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের বদলে সরকারের অগ্রাধিকার কি ধর্মীয় আস্ফালন?

আরও পড়ুন-ফলন বাড়াতে পতিত জমিকে চাষযোগ্য করার উদ্যোগ রাজ্যের

অন্যদিকে, জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের গুরুত্ব ক্রমশই কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার ঘটানোর দিন, যা স্বাধীন ভারতের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে। সরকারের নির্ধারিত থিমের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এটি কেবলমাত্র ‘বিকশিত ভারত’ এবং ‘বিশ্ব নেতৃত্ব’ ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী শব্দের মোড়কে বন্দি হয়ে গেছে। জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের এবারের থিম ‘এমপাওয়ারিং ইন্ডিয়ান ইয়ুথ ফর গ্লোবাল লিডারশিপ ইন সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন ফর বিকসিত ভারত’— এটি কি সত্যিই বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে সহায়ক, নাকি শুধুই একটি ফাঁপা স্লোগান?
বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারে গবেষণার জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু ভারতে গবেষণা অনুদান কমছে। সরকারি ল্যাব ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাজেট সংকোচন করা হচ্ছে। অথচ বিজ্ঞান দিবসে শাসকশ্রেণি ‘বিশ্বগুরু’ হবার কথা বলছে! যদি সত্যিই ভারতীয় তরুণদের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় শক্তিশালী করতে হয়, তবে গবেষণাগারগুলোর উন্নয়ন, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার, এবং মৌলিক গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু তা না করে সরকার বিজ্ঞান দিবসের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে ‘দেশীয় প্রযুক্তি’, ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর মতো শব্দবন্ধ দিয়ে একধরনের রাজনৈতিক রণনীতি প্রয়োগ করছে। ফলে বিজ্ঞান দিবসের গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে, এবং দেশের ভবিষ্যৎও বিপদের মুখে পড়ছে।
বিজ্ঞানকে অবহেলা করে, গবেষণাকে উপেক্ষা করে, ধর্মীয় পুনর্জাগরণকে রাষ্ট্রীয় কৌশল বানিয়ে, ভারত কি সত্যিই ‘বিশ্বগুরু’ হতে পারবে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ইতিহাস বলে, সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সময়গুলোতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং গবেষণার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রাচীন ভারতে চরক, সুশ্রুত, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্যের মতো বিজ্ঞানীরা ছিলেন; মধ্যযুগে ফারসি ও আরব বিশ্বের সঙ্গে জ্ঞান-বিনিময় হয়েছিল; আধুনিক ভারতে জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সি ভি রামন, হোমি ভাবা, বিক্রম সারাভাই, মেঘনাদ সাহা, এ পি জে কালাম, বিকাশ সিংহের মতো বিজ্ঞানীরা বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান প্রবণতা সম্পূর্ণ উলটো। আজ ভারতবর্ষ কুম্ভমেলার মতো ধর্মীয় উৎসবকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় বিনিয়োগ কমাচ্ছে। সুতরাং, ভারত যদি সত্যিই বিশ্বগুরু হতে চায়, তবে তা ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়ে নয়, বিজ্ঞান, গবেষণা ও শিক্ষার উন্নতির মাধ্যমেই সম্ভব। অন্যথায়, ‘বিশ্বগুরু ভারত’ শুধুই একটি ফাঁপা রাজনৈতিক প্রচারণা হয়ে থাকবে।

Latest article