১৯৭০-এর ১৭ মার্চ বর্ধমান শহরে লোমহর্ষক সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ বলা যেতে পারে। এই ভয়াবহ হত্যালীলা সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম খুব একটা অবহিত মনে হয় না। সিপিএমের বর্তমান তরুণ প্রজন্মও সম্ভবত এই সম্পর্কে বিশদ জানেন না। জানার কথাও নয়। ৫৫ বছর আগের ঘটনা। এর রাজনৈতিক পটভূমি সংক্ষেপে আলোচনা করছি। ১৯৬৯-এ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার মধ্যবর্তী নির্বাচনে অকংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট বিধানসভায় অবাধ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, আরসিপিআই, বাংলা কংগ্রেস (বর্তমানে বিলুপ্ত) প্রভৃতি নানা মত ও পথের বহু দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। অপরদিকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বড় নির্বাচনী বিপর্যয় হল। আসনসংখ্যা কমে ৫৫-তে দাঁড়াল। অচিরেই যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলির মধ্যে মতান্তর ও সংঘাত আরম্ভ হল। বিশেষ করে, মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় (বাংলা কংগ্রেস) এবং উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর (সিপিএম) মধ্যে মতভেদ তীব্র আকার ধারণ করল। অজয়বাবু নিজের সরকারের বিরুদ্ধে ধর্মতলায় অবস্থান আন্দোলন করলেন।
আরও পড়ুন-২১৪ পণবন্দি নিহত, পাকিস্তান সেনার দাবি উড়িয়ে জানিয়ে দিল বালুচিস্তানের বিদ্রোহীরা
রাইটার্সে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারের বাইরে সিপিএমের কো-অর্ডিনেশনের কর্মীরা অজয় মুখোপাধ্যায়কে লাঞ্ছনা করলেন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে চলল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিস্থিতির অবনতি হল। সিপিএমের তাণ্ডব বাড়তে লাগল। যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলির উপর এই হার্মাদের দলটি অত্যাচার করল। একই সঙ্গে বিরোধী দল কংগ্রেসের কর্মীদের উপর নির্বিচারে নির্যাতন চলতে লাগল। সিপিএম-নকশাল প্রকাশ্য সংঘাতের ফলে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি হল। অপরদিকে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হচ্ছিল। মন্ত্রীরা এবং শীর্ষস্থানীয় প্রসাসনিক ও পুলিশ আধিকারিকরা দুটি গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেলেন— মুখ্যমন্ত্রীর গোষ্ঠী এবং উপমুখ্যমন্ত্রীর গোষ্ঠী। প্রশাসন লাটে উঠল, আর কী। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্র-যুব আন্দোলন রাজ্যে প্রথম ব্যাপক রূপ নেয়। কলকাতায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে, বর্ধমানে প্রদীপ ভট্টাচার্য, নুরুল ইসলাম প্রভৃতির নেতৃত্বে ছাত্র পরিষদের সংগঠন দ্রুত বিস্তার করতে থাকে। একই সঙ্গে সিপিএম গুন্ডাদের হামলা-অত্যাচার বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে নকশালদের চোরাগোপ্তা হত্যা। সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সরকারি কর্মচারীরা ভয়ে ভয়ে কাটাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় ১৯৭০-এর ১৫ মার্চ (অথবা ১৬ মার্চ) পদত্যাগ করলেন। রাজ্যপাল এস এস ধাওয়ান বিকল্প মন্ত্রিসভা গঠন করা যায় কি না, সেই চেষ্টা শুরু করেছিলেন। রাজ্যে তখন প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না।
আরও পড়ুন-সিকিমে ঢুকতে পর্যটকদের দিতে হবে বাড়তি কর
বর্ধমান শহরের প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনের সাঁই পরিবার কংগ্রেসি পরিবার হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৯৭০-এর ১৭ মার্চ সাঁই পরিবারে একটি অনুষ্ঠান ছিল। মেয়ের একমাসের পুত্রসন্তানের নামকরণ অনুষ্ঠান। সকাল ৭.৩০টার সময় সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী সাঁইবাড়িতে নৃশংস হামলা চালায়। প্রথমে বোমা ফাটায় ও ইট-পাটকেল ছুঁড়ে জানলার কাচ ভেঙে দেয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দুই ভাই মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁইকে বৃদ্ধা মায়ের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। মা মৃগনয়নাদেবী এবং সাঁই ভাইয়ের ছোট বোন বাধা দিতে গেলে তাঁদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় গৃহশিক্ষক জিতেন্দ্রনাথ রাই বাড়ির বাচ্চাদের পড়াচ্ছিলেন। তাঁকেও টেনে এনে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়। নৃশংসতম ঘটনা হল, সাঁইভাইদের রক্তমাখা ভাত মাকে খেতে বাধ্য করা হয়। নবজাত একমাসের শিশুকেও হার্মাদরা আগুনে ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয়দের সহায়তায় শিশুটির প্রাণ রক্ষা পায়। গুরুতর আহত অবস্থায় মহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। তিনি বেঁচে গেলেন কিন্তু মানসিকভাবে ভারসাম্য হারালেন। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ন্যূনতম মানসিক স্থিতাবস্থা ফিরে আসেনি। বড় ভাই নবকুমার সাঁই সেই দিনটি রক্ষা পেলেও ঠিক এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার আহ্লাদিপুরে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁকে মেরে ফেলার আগে তাঁর দুটি চোখ উপড়ে ফেলে অন্ধ করে দেওয়া হয়। সিপিএমের কর্মীরাই এই হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল। নবকুমারের ভাগনে অমৃতকুমার জোশ (যে একমাসের শিশুটির নামকরণ অনুষ্ঠান ১৭ মার্চ হচ্ছিল) ২০১১-তে Times of India ইংরেজি দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘সেদিন আমি মারা যেতে পারতাম। কিন্তু আমার পরিবারের মতো আমি এখনও মানসিক ক্ষত সহ্য করি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা এখনও এমন একটি দল শাসিত যারা সন্ত্রাসের দ্বারা শাসনে বিশ্বাস করে।’’ (এই সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হয়েছিল ২০১১-র মে মাসে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পূর্বে)।
আরও পড়ুন-সাংসদ দেবের সক্রিয় উদ্যোগে খুব তাড়াতাড়ি, শুরু হচ্ছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের বাস্তবায়ন
বর্ধমানে তৎকালীন জেলাশাসক তরুণ দত্তের ভূমিকা নিন্দনীয় ছিল। জেলাশাসককে আগেই খবর দেওয়া হয়েছিল সাঁই পরিবারের উপর যে কোনও দিন হামলা হতে পারে। কিন্তু জেলাশাসক কোনও গুরুত্ব দেননি। বরং তখন তাঁর সঙ্গে সিপিএম নেতাদের দহরম-মহরম চলছিল। পরবর্তীকালে বামফ্রন্টের শাসনকালে তিনি রাজ্যের মুখ্যসচিব হয়েছিলেন। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে সিপিএমের হাতে বহু কংগ্রেস কর্মী, যুক্তফ্রন্টের শরিক দল বাংলা কংগ্রেস, ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারও আক্রান্ত হয়েছেন। বেদনার সঙ্গে স্মরণ করি, আমাকে এবং আমার ছোট ভাইয়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমার বাবা (তখন দক্ষিণ কলকাতার শ্যামাপ্রসাদ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন) তড়িঘড়ি করে দু’দিনের মধ্যে যাদবপুরের নিজ বাসভবন ছেড়ে ১৯৭০-এর এপ্রিল মাসে সপরিবারে হাজরা অঞ্চলের একটি ছোট ভাড়াবাড়িতে উঠে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই প্রবন্ধকার তখন সবেমাত্র এমএ পরীক্ষা দিয়েছেন।
সাঁইবাড়ি লোমহর্ষক ঘটনার ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সারা ভারতে হয়েছিল। বিশেষ করে আমাদের রাজ্যের সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯৭০-এর মার্চ মাসের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হল, কারণ অজয় মুখোপাধ্যায়ের পদত্যাগের পর বিকল্প মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব হল না। রাষ্ট্রপতির শাসনের সঙ্গে সঙ্গে জনরোষ প্রকাশ্যে যেন ফেটে পড়ল। রাজ্যপাল এস এস ধাওয়ান বর্ধমানে এলে ব্যাপক গণবিক্ষোভের সম্মুখীন হলেন। রাজ্যপালের সামনেই জেলাশাসককে চুলের মুঠি ধরে গলার কলার ধরে কিল-চড়-ঘুসি মারা হল।
আরও পড়ুন-বাংলার ১৬ গুণ স্কুলছুট যোগীরাজ্যে
জনবিক্ষোভ সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে উপস্থিত পুলিশ আধিকারিকরা কিছুই করতে পারলেন না। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিপিএমের হামলাকারী ও হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি উঠল। অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৭৭-এর পর বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী বা সিপিএমের সাংসদ অথবা সাংগঠনিক ক্ষেত্রে শীর্ষ পদের পুরস্কার পেয়েছিলেন— যেমন নিরুপম সেন (শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী) অনিল বসু (সাংসদ), বিনয়কৃষ্ণ কোনার, অমল হালদার ইত্যাদি। ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বর্ধমান শহরে এসে সাঁই পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
সিপিএমের আসল মুখোশ ৫৫ বছর আগের দুঃস্বপ্নময় সাঁইবাড়ি হত্যালীলা উন্মোচিত করেছে। এটি একটি হিংস্র ও সন্ত্রাসবাদী দল, গণতন্ত্রের আড়ালে। বর্তমান প্রজন্ম এই দলটির কলঙ্কিত অতীত সম্পর্কে অবহিত হোন। সিপিএমের তরুণ ও বুদ্ধিমান প্রজন্ম আত্মবিশ্নেষণ করুন, তাঁরা এই ধরনের কলঙ্কিত দলের হয়ে সময় দেবেন কি না।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার— ড. প্রশান্ত সরকার