আকাশজুড়ে বিস্ময়-ডালি
সন্ধে হলে তারা ওঠে ঝলমলিয়ে আকাশটাতে, রাতের আঁধার ভেদ করে রঙিন মেঘের নরম ছোঁয়ায়, মনটা আমার স্বপ্ন আঁকে, অজানা কত নক্ষত্রমালায়, এই বিশ্ব কতই না রহস্য লুকিয়ে রাখে! যেন বড্ড বেশি অদ্ভুতুড়ে ওই রাতের আকাশ— তবুও আকাশের ওই ছবির গোপন ছন্দ বারবার নিসর্গপ্রেমীদের দৃষ্টি টেনে ধরে। এই বছরের শুরু থেকেই মহাশূন্য যেন স্কাই-গেজারদের বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকছে— নানারকম বিচিত্র মহাজাগতিক কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে থাকতে।
বছরের শুরুতেই, জানুয়ারির ৩-৪ তারিখে উত্তর গোলার্ধে প্রথম কুয়াড্রান্টিড উল্কাপাত দেখা যায়। ওই উল্কাপাতের শীর্য পর্যায়ে কখনও কখনও একসঙ্গে ২৫-২০০টি পর্যন্ত উল্কাপাত বা তারা-খসা দেখা গেছে। নিঃসন্দেহে ওই দৃশ্য নয়নকাড়া! এরপরই জানুয়ারির ২৫ তারিখ অন্তরীক্ষে গ্রহের আশ্চর্য সংযোগ বা প্ল্যানেটরি অ্যালাইনমেন্টের দৃশ্য তো সকলের মনে জায়গা করে নিয়েছে। ঠিক একমাস পরে ২৫ ফেব্রুয়ারিও এই ঘটনার সাক্ষী ছিলাম আমরা। এর ক’দিন আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্র গ্রহ পৃথিবীর খুব কাছে এসেছিল এবং যতটা সম্ভব উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। মজার বিষয়, শুক্রের ওইদিন অর্ধচন্দ্রাকৃতি দৃশ্য সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখেছিলেন। তার উপর সেই ২০২২ সালের পর এ-বছর মার্চের ১৩-১৪ তারিখ উত্তর আমেরিকার রাতের আকাশে প্রায় ৬৫ মিনিট ধরে যে কমলা-লাল রঙের বিস্ময়কর চন্দ্রগ্রহণ দেখা গেল, তা প্রায় বাক্রুদ্ধকর!
আরও পড়ুন-ইডেনে নাইটদের প্রস্তুতি-ম্যাচ বাতিল বৃষ্টিতে, ক্যাপ্টেন্স ফটোশ্যুট হবে মুম্বইয়ে
বিষুবকালে আলোর বন্যা
যখন পৃথিবীর বিষুবরেখার ওপর সূর্যের অবস্থান থাকে, ফলে দিন ও রাত সমান হয়, সেই সময়কেই বলে বিষুব। প্রতিবছর ২১ মার্চ (বসন্ত বিষুব) ও ২৩ সেপ্টেম্বর (শরৎ বিষুব) এই ঘটনা ঘটে। এই সময় পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সূর্যের বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে বিশেষভাবে সংযুক্ত হয়, যা বেশি পরিমাণে চার্জিত কণাকে মেরুর দিকে পরিচালিত করে। ফলে, উত্তুরে আলো বা নর্দার্ন লাইটস বা মেরুজ্যোতির ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়। তবে এবছরের চমক একটু অন্য মাত্রার। কেননা, এবারে সূর্য তার সোলার ম্যাক্সিমাম পজিশনে রয়েছে। তাই সূর্যের কাজকর্ম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওইসব মেরু জ্যোতি উত্তর দক্ষিণে আরও সরে যাবে, এমনকী বিষুব কাল পেরিয়ে যাওয়ার কয়েকদিন পর আলোক জ্যোতি থেকে বিস্ফোরণও দেখা দিতে পারে। এ ঘটনা নিঃসন্দেহে আকাশপ্রেমীদের চক্ষু জুড়াবে!
আংশিক সূর্যগ্রহণ
আদৌ ২০২৪ সালের ৮ এপ্রিলের পূর্ণ সূর্যগ্রহণের মতো নয়, তবে প্রায় ৯৪ ভাগ সূর্য চাঁদ দিয়ে ঢাকা থাকবে, এমনই আংশিক সূর্যগ্রহণের সাক্ষী হতে চলেছে উত্তর-পূর্ব আমেরিকা ও কানাডার পূর্ব প্রান্তের মানুষগুলো। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এবছর ২৯ মার্চ ইউরোপ এবং উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার লোকজনও এই দৃশ্য দেখতে পাবেন।
বছরভর উল্কাবৃষ্টি
মহাকাশে ঘুরছে এমন ধূমকেতু বা গ্রহাণুর অংশ, কিংবা পাথুরে ও ধাতব বস্তু, ওগুলোই উল্কা। যখন প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১১-৭২ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ওগুলো প্রবেশ করে, তখন তারা ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে, রাতের আকাশে উজ্জ্বল রেখার মতো দেখায়, তখন বলে উল্কাপাত বা উল্কাবৃষ্টি, আমরা অনেকেই এই ঘটনাকে আবার তারা-খসাও বলি। ছোট, বড় কিংবা মাঝারি সব পর্যায়ের উল্কাপাতই দেখা যায়, ঘণ্টা প্রতি একসঙ্গে প্রায় ২০-২০০টি পর্যন্ত তারা খসতে দেখা যায় ওই নিসর্গের বুকে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এবছর উল্কাবৃষ্টির আয়োজন একটু বেশিই আকর্ষণীয়। আগামী এপ্রিলের ২১-২২ তারিখ উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় আকাশ জুড়ে দেখা যাবে খুবই লোকপ্রিয় লাইরিড উল্কাপাত। ওইদিনই নাকি একটু বেশি রাতের দিকে দেখা যাবে পৃথিবীর ছায়াপথ মিল্কি ওয়ে। মে মাসের ৬-৭ তারিখে দক্ষিণ গোলার্ধের আকাশে দেখা মিলবে হ্যালিস কোমেটের ইটা অ্যাকুয়ারিড উল্কাপাতের। ১০ জুন রাতের আকাশে আলোর নৃত্যে মেতে উঠবে অ্যারিয়েটিড টুটো তারা, ২৮ জুলাই পিসিস অস্ট্রিনিড। ১২ অগাস্ট ও ৯ সেপ্টেম্বর দেখা মিলবে পারসিয়েড উল্কাপাতের। আবার অক্টোবরে গোটা মাস জুড়েই আকাশ মাতবে ড্রাকোনিড, টাউরিড, অরিজিড, জেমিনিড, ওরিওনিড, ও মিনোরিড তারা খসার আড়ম্বরে। তবে এখানেই শেষ নয়, নভেম্বরের ১৭ ও ২১ তারিখে লিওনিড এবং মনোসেরোটিড উল্কাবৃষ্টি, ডিসেম্বরের সারাটা মাস ফোনিসিড, ক্যাসিওপিয়েড, পাপ্পিয়েড, হাইড্রিড, বেরেনিসিড এবং উরসিড তারা খসা যেন মহাকাশ-কৌতূহলীদের জন্য উপরি পাওনা!
শনির প্রতিপক্ষ অবস্থান
আগামী ২০২৬ সাল না এলে দানব গ্রহ বৃহস্পতির কোনও প্রকার প্রতিপক্ষ অবস্থানের দেখা মিলবে না, এমনটাই হিসেব জ্যোতির্বিদদের। তবে এবছর আগামী ২১ সেপ্টেম্বর শনি গ্রহের প্রতিপক্ষ অবস্থান লক্ষ্য করা যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীকে শনি এবং সূর্যের মাঝখানে একই সরলরেখায় দেখা যায়। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে দৃশ্যটি খুবই আকর্ষণীয় এবং উৎসাহের। কেননা, এই পরিস্থিতিতে এই গ্যাসীয় দানব ও তার বলয়গুলোকে সবচেয়ে উজ্জ্বলতার সঙ্গে টেলিস্কোপের মাধ্যমে দেখা যায়। গ্রহ, গ্রহের কক্ষপথ, উপগ্রহ এবং তার ভিতরের বায়ুমণ্ডল বিষয়ে গবেষণার জন্য এই সুযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন-সম্প্রীতি-শান্তি-ঐক্য নিয়েই বাংলা, ফুরফুরা শরিফে বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
শুক্র ও বৃহস্পতির সংযোজন
১২ অগাস্ট, ২০২৫ সূর্যোদয়ের কিছু সময় আগে বিছানা ছেড়ে উঠে আকাশের দিকে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাবে বৃহস্পতি ও শুক্র গ্রহ মাত্র এক ডিগ্রির তফাতে আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করছে। বিজ্ঞানীদের কথায়, ওটা ওই দুই গ্রহের সংযোজন। যখন দুটি গ্রহ তাদের কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী থেকে দেখার সময় একই কোণীয় অবস্থানে চলে আসে, তখন তাকে ‘সংযোগ’ বলা হয়। বৃহস্পতি ও শুক্রের সংযোগ সাধারণত প্রতি এক থেকে দেড় বছর অন্তর ঘটে। ওইদিন বৃহস্পতি মাইনাস ১.৮ ম্যাগনিচুডে এবং শুক্র মাইনাস ৩.৯ ম্যাগনিচুডে অবস্থান করবে। এদৃশ্য শুধু নজরকাড়া তাই নয়, গ্রহীয় কক্ষপথ ও তাদের গতিবিধি বুঝতেও বিজ্ঞানীদের সাহায্য করে।
সুপারমুন
যখন চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসে এবং তখন যে পূর্ণিমা ঘটে, তাকে সুপারমুন, আবার পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে শরৎকাল শুরু হওয়ার সময়ে সবচেয়ে কাছের পূর্ণিমাকে হারভেস্ট মুন বলে। এখন আগামী ৬ অক্টোবর এই দুই বিরল ঘটনা একসঙ্গে ঘটতে চলেছে, যা সুপার হারভেস্ট মুন নামে সকলকে আকৃষ্ট করছে। এছাড়াও নভেম্বর মাসে যখন উত্তর আমেরিকার বিভার সম্প্রদায় তাঁদের জন্য বাঁধ তৈরি করে, সেই সময়ের পূর্ণিমাকে বলে বিভার মুন। একসঙ্গে সুপার ও বিভার মুনের বিরল সংযোগকে বলে বিভার সুপারমুন, যা কিনা আগামী ৫ নভেম্বর ঘটতে চলেছে। এইসময় চাঁদ কমলা-সোনালি রঙে প্রতি রাতের চেয়ে নাকি ১৪ গুণ বড় আর ৩০ গুণ উজ্জ্বল দেখায়। নিঃসন্দেহে এইসব ঘটনা সাধারণ মানুষকে মহাশূন্যের ব্যাপারে আরও কৌতূহলী করে তোলে।