কিডনির (Kidney) রোগ নীরব ঘাতক। প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত না হলে মারাত্মক আকার নিতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। এই তালিকায় রয়েছে শিশুরাও। তাই কিডনি রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে গোটা মার্চ জুড়ে পালিত হয় জাতীয় কিডনি সচেতনতা মাস। সারা বিশ্বে কিডনি রোগের প্রভাব এবং রোগটি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এই মাসটি পালনের উদ্দেশ্য। এই সময় বিভিন্ন হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারা কিডনি রোগ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা, প্রোগ্রাম, প্রচার কর্মসূচি পালন করে।
কিডনির রোগ কেন হয়
অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, অসংযমী জীবনযাপন কিডনির রোগের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে কমবয়সিদের মধ্যে কিডনিতে পাথর জমার প্রবণতাও বেশি। এর কারণ হল অত্যধিক জাঙ্ক খাবার খাওয়া। কারণ ফাস্ট ফুড, প্যাকেজড ফুডে বেশি পরিমাণে সোডিয়াম থাকে। ক্যালশিয়াম, সোডিয়াম, ফসফেট এগুলি শরীরে জমতে জমতে তা ক্রিস্টালাইজ় হয়ে যায়। ফলে কিডনিতে পাথর জমতে শুরু করে। কিডনিতে পাথর হলে তা ইউরিনের স্বাভাবিক পথ বন্ধ করে দেয়।
ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ জেনেটিক সমস্যা, কোনও সংক্রমণ, অটোইমিউন ডিজিজ ইত্যাদি থেকে হতে পারে।
রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকলে কিডনির রক্তনালি এবং ফিল্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা কিডনি রোগের একটি প্রধান কারণ।
অনিয়ন্ত্রিত উচ্চরক্তচাপ কিডনির রক্তনালির ক্ষতি করে।
কিছু ক্ষেত্রে, বংশগতভাবে কিডনি রোগের ঝুঁকি থাকে, যেমন— পলিসিস্টিক কিডনি রোগ।
বিভিন্ন অটো ইমিউন ডিজিজ-এর কারণে অর্থাৎ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করে, তখন কিডনির ক্ষতি হয়।
কিছু ওষুধের দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহার কিডনির ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্রনিক কিডনি ডিজঅর্ডার
কিডনির প্রধান কাজ হল রক্ত থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ দূর করে রক্ত পরিশোধন করা। জল, সোডিয়াম পটাশিয়াম, ফসফরাস এবং বাইকার্বোনেটের মতো পদার্থের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ কিডনিরই কাজ। ক্রনিক কিডনি ডিজঅর্ডারে এই ভারসাম্য থাকে না এবং কিডনির আর রক্ত পরিশোধন করতে পারে না। এর ফলে ধীরে করে কিডনির কার্যকারিতা কমতে থাকে তখন তা দীর্ঘস্থায়ী কিডনির অসুখ বা ক্রনিক কিডনি ডিজঅর্ডারের আকার নেয়।
সিকেডি-র প্রধান দুটো কারণ। ডায়াবেটিস বা মধুমেহ এবং উচ্চরক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার।
আরও পড়ুন: এক দেশ, এক ভোট তো বুঝলাম কিন্তু আসল ছকটা কী!
উপসর্গ
হঠাৎ করেই খিদে কমে যাওয়া।
খুব দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব হয়।
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা।
বমি বমি ভাব হয়।
বমিও হতে পারে।
ওজন কমে যেতে থাকে।
পা-হাত ফুলতে পারে, এমনকী চোখও।
শুষ্ক এবং রুক্ষ ত্বক।
ঘুমের সমস্যা হয়।
আমাশা আমাশা ভাব।
মাসল ক্র্যাম্প হতে থাকে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
রক্তের ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন— এই দুটো টেস্ট দেন চিকিৎসক। কারণ কিডনিতে সমস্যা থাকলে এই দুটি পদার্থ শরীরে স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেড়ে যায়। এছাড়া ইউরিন টেস্টও দেওয়া হয়ে থাকে। এই সব মিলিয়ে রোগ নির্ণয় সম্ভব হয়। তবে দুশ্চিন্তা নয়, সচেতনতা জরুরি।
চিকিৎসা
রোগ ধরা পড়লে প্রথমে চেষ্টা করা হয় ওষুধ দিয়ে রোগকে নিয়ন্ত্রণ করার। এর পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোগ অনেকটা বেড়ে গেলে ডায়ালিসিস ছাড়া উপায় নেই। এখন ডায়ালিসিস পদ্ধতির অনেকটাই উন্নত হয়েছে তাই তাই ডায়ালিসিস খুব কষ্টকর নয়। এছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপন এই রোগের অন্যতম চিকিৎসা।
কিডনি রোগীর খাবার
কিডনি সমস্যা ধরা পড়ার পর অনেকেই প্রোটিন বা আমিষ-জাতীয় খাবার খাওয়া একদম কমিয়ে দেন। গবেষণায় দেখা গেছে, আমিষ জাতীয় খাবার বেশি কমিয়ে দিলে পুষ্টিহীনতা হয়। এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে প্রোটিন গ্রহণ করুন।
কিডনি রোগীর যে সব ধরনের ফল বা শাকসবজি খাওয়া নিষেধ এই ধারণা ঠিক নয়। শুধু কারও রক্তে যদি পটাশিয়ামের মাত্রা বেশি থাকে তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার কম খান। যেমন— ডাবের জল, কলা, খেজুর, শুকনো ফল, আলু, টমেটো, শসা, পালং শাকে পটাশিয়াম বেশি থাকে।
আবার আপেল, পেয়ারা, আঙুর, নাশপাতি, জাম, তরমুজ— এ ফলগুলোয় পটাশিয়াম তুলনামূলক কম থাকে। এ ফলগুলো পরিমাণমতো খেতে পারেন।
শাকসবজি সেদ্ধ করে তার জলটা ফেলে দিয়ে তারপর রান্না করুন।
খাবারে অতিরিক্ত নুন বা পাতে কাঁচা নুন একেবারেই চলবে না।
ছয় মাস অন্তর রক্তে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি-এর মাত্রা পরীক্ষা করে প্রয়োজন হলে খেতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী৷
কিডনি রোগীরা ইফতারে কী খাবেন
রমজান মাস, রোজা রাখছেন অনেক মানুষ। এক্ষেত্রে যাঁদের কিডনির সমস্যা রয়েছে তাঁরা ইফতারের সময় এমন খাবার বেছে নিন যাতে শরীরের জলের ভারসাম্য ঠিক রাখে এবং অতিরিক্ত পটাশিয়াম, ফসফরাস ও সোডিয়াম শরীরে না ঢোকে।
খেজুর অল্প একটা কি দুটো খাওয়া যেতে পারে, কারণ এতে পটাশিয়াম রয়েছে ।
শরবত চিনি ছাড়া খান। লেবু জল অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। কার্বোনেটেড ড্রিঙ্কস বাদ দিন।
কম পটাশিয়ামযুক্ত সবজি, ফল, শসা, ক্যাপসিকাম, লাউ, পেঁপে, আপেল খাওয়া যেতে পারে।
প্রোটিন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খান। সেদ্ধ ডিমের সাদা অংশ, গ্রিলড চিকেন বা মাছ সামান্য পরিমাণে খেতে পারেন।
কম নুনযুক্ত খাবার যেমন ছোলা, মুড়ি বা দই-মুড়ি খাওয়া যেতে পারে।
হালকা সবজি স্যুপ বা টক দই ও শসার স্যালাড ভাল বিকল্প হতে পারে।
ভাজাপোড়া, প্যাকেটজাত খাবার ও প্রসেসড ফুড এড়িয়ে চলুন।
উচ্চ পটাশিয়ামযুক্ত খাবার যেমন— কলা, কমলা, আলু, টমেটো, কাঁঠাল, নারকেলের জল ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার বেশি খাবেন না, এতে ফসফরাস বেশি থাকে, যা কিডনির রোগীর জন্য ক্ষতিকর।