মার্গারেট নোবল হলেন নিবেদিতা

১৮৯৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘মম্বসা’ নামক জাহাজে কলকাতা বন্দরে এসে পৌঁছান মার্গারেট। তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং। ২৫ মার্চ ১৮৯৮ স্বামী বিবেকানন্দ নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগানবাড়িতে ব্রহ্মচর্যব্রতে দীক্ষা দেন মিস মার্গারেট নোবলকে এবং তাঁর নামকরণ করেন ‘নিবেদিতা’। সেই ভগিনী নিবেদিতার চিন্তা দর্শনের সঙ্গে বিজেপির কাজকর্মের কোনও সাযুজ্য নেই। বরণীয় জীবনের আলোয় সেই স্মরণীয় প্রসঙ্গ লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

১২৭ বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দের কণ্ঠস্বরে ভারতবর্ষ ডাক দিয়েছিল মার্গারেট এলিজাবেথ নোবলকে। তিনি ছিলেন এক রত্ন মেয়ে। মেধাবী। যা দেখেন তাই অদ্ভুত আয়াসে আয়ত্ত করে নেন। যুক্তিবিদ্যায় ঘোর পারদর্শী। অধ্যাত্ম্যের জটিল তত্ত্বেও চমৎকারের রস খুঁজে নেন। পশ্চিমে তার পাপড়ি মেলার দিনগুলিতে পূর্বদিকের ভারত দেশে গঙ্গা নদীর পাড়ে বইছিল অলৌকিক। দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, তিনি অনুভব করেছেন, যিনি আল্লা তিনিই কৃষ্ণ, তিনিই কালী তিনিই খ্রিস্ট। তাঁর লোকান্তরিত হওয়ার পর সেই নিবেদিতাকে ভারতবর্ষে নিয়ে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। বিদেশিনীর খোলস ছেড়ে ভারতমানবের লোকমাতৃকা হয়ে ওঠার দিকে দিলেন এগিয়ে দিলেন তাঁকে। এ-দেশে এসে কল্যাণব্রতে দীক্ষা নিয়ে আজকের দিনে মার্গারেট হলেন ‘নিবেদিতা’ (Nivedita)।

ভারতকে নিবেদিতা (Nivedita) কতখানি আপনার করে নিতে পেরেছিলেন, তা বোঝা যায় নিবেদিতার কালীপ্রেম সম্পর্কে অবহিত হলে। শ্যামা মায়ের সঙ্গে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছিলেন এই শ্বেতাঙ্গিনী। কালীতেই যেন ঘনীভূত ছিল তাঁর সব কাজের প্রাণশক্তি, মা কালীই গড়েছেন তাঁর শিক্ষা, সেবা, উৎসর্গ করার ক্ষমতা আর খাপ-খোলা তলোয়ারের মতো ব্যক্তিত্ব।

যে পশ্চিম বারে বারে দূত পাঠিয়েছে, যে দূত মনে করেছে ভারতের সবটা কেবল অন্ধকার আর কুসংস্কারে ঠাসা, তাকে নিজ ধর্মে অভিষিক্ত করে সভ্য করানো তার মহান দায়িত্ব, যাকে বলে হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন, সেই তাদেরই ভূমি থেকে উঠে এসে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রুখে দাঁড়ালেন নিবেদিতা। নিজের তেজ দিয়ে আগলে রাখলেন ভারতের ঐতিহ্যকে, তার ধর্মকর্ম এবং সংস্কারকে। জানলেন, বুঝলেন এবং বললেন, ভয়ংকর অমানিশাসম ত্রাস পেরিয়ে তবেই নিত্যানন্দময়ী কালীকে পেতে হয়। শক্তিপূজায় এ ভাবেই শক্তি মেলে।
কালাপানির ওপার থেকে এক অচ্ছুৎ এসে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে দাঁড়িয়ে কালী নিয়ে এমন আবেগ ভরে কালীর চর্চা করছে, রক্ষণশীল সমাজে তুমুল ঝড় উঠল। কিন্তু ওই মেয়ে তো ঈশ্বরের কথা পৃথিবীকে বলার জন্যই জন্মেছিলেন। ফলে, সেই সব প্রশংসা-নিন্দার লেশমাত্র তাঁর জ্যোতির্বলয়ে প্রবেশই করতে পারল না। আর কালীর পায়ে আত্মোৎসর্গের তত্ত্বকে সত্যি করে একটু একটু করে নিংড়ে দিলেন নিজের রক্ত। তাঁর কালীর জন্য। কালীর সন্তানদের জন্য। সকালে স্কুল চালান, দুপুরে খর রোদে ছাতা হাতে ছাত্রী খুঁজতে বের হন, বিকেলে মুখের ফেনা তুলে খাটেন রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্র অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। অতীত খুঁড়ে আবার যে ফিরিয়ে আনতে হবে ভারত সংস্কৃতির হীরের যুগ। সন্ধেয় বিপ্লবীদের শেখান স্বাধীনতার মানে। তার পর, রাত জেগে বই লেখেন। পর দিন কাকভোরে উঠে রাস্তা ঝাঁট দিয়ে প্লেগের ব্যাধি তাড়াতে ছোটেন। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছিলেন, “ভগিনী নিবেদিতা একান্ত ভালবাসিয়া সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে ভারতবর্ষে দান করিয়াছিলেন, তিনি নিজেকে বিন্দুমাত্র হাতে রাখেন নাই।”

আরও পড়ুন-বাংলার শিল্পপতিদের চোখে ‘নতুন বাংলা’

অক্লান্ত কর্মযোগে তিলে তিলে শেষ হতে হতে সময়ের অনেক আগে নিবেদিতা আশ্রয় নেন বরফের কফিনে। শক্তিপক্ষেই তাঁর পৃথিবীতে আসা। শক্তিপক্ষেই তাঁর চিরতরে চলে যাওয়া। থেকে যায় দার্জিলিংয়ের হিমেল শ্মশানভূমিতে তাঁর সমাধির ওপর লেখা, ‘এখানে শান্তিতে শুয়ে আছেন তিনি, যিনি ভারতবর্ষকে তাঁর সর্বস্ব অর্পণ করেছিলেন’।
এই নিবেদিতাকে বিজেপি বা গেরুয়া পক্ষ গ্রহণ করতে অপারগ।
কারণ, নিবেদিতা বলতেন, “If you want to know the real India, dream the dreams of Akbar and Ashoka.” কিন্তু আকবরের স্বপ্ন বিজেপি দেখবে কী করে?
কারণ নিবেদিতা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশ সরকার “rotten to the core”। কিন্তু সেই ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি প্রার্থনা করতে দ্বিধা করেননি বিজেপির আদি পুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর।
হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীরা কিন্তু স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন বা লড়াইয়ে যোগ দেননি, সে জন্য কোনও আত্মত্যাগ করেননি। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময় ব্রিটিশদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করার যে শপথ নেওয়া হয়েছিল, গোলওয়ালকর পরিচালিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রবক্তারা তা সমর্থন পর্যন্ত করেননি।
তাঁরা নিবেদিতাকে আশ্রয় করবেন কোন আগ্রহে?

নিবেদিতা (Nivedita) ব্রিটিশ শাসনকে ভেতর থেকে পচা বলেছিলেন কার্জনের বঙ্গভঙ্গের আদেশ লক্ষ করে। আর ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি যখন ঘোষণা করেন ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবে, তখন হিন্দু মহাসভাই প্রথম পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের প্রস্তাব দিয়েছিল।

তেলে-জলে যেমন মিশ খায় না, নিবেদিতার চিন্তা ভাবনা দর্শন বিজেপির ভারত ভাবনার সঙ্গে মেলে না।
নিবেদিতার গুরু স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন,‘‘আমার দৃঢ় ধারণা, বেদান্তের তত্ত্ব যত সূক্ষ্ম এবং অপূর্বই হোক, ফলিত ইসলামের সাহায্য ছাড়া বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনও মূল্য নেই।’’ তার কারণ, ‘‘কোনও ধর্মমত যদি (মানুষে মানুষে) এই সাম্যের প্রতি যথার্থ মনোযোগী হয়ে থাকে, তা হল ইসলাম।’’
একথা বিজেপির হজম হবে? না হলে, বিবেকানন্দ আর নিবেদিতাকে ওরা গ্রহণ করবে কীভাবে?
প্রাচীন ভারত সম্পর্কে বিবেকানন্দের ধারণায় যে ভারসাম্য ছিল, আজ যাঁরা দেশের অতীত গৌরব উদ্ধারে ব্যগ্র, তাঁরা সেটি বোঝার চেষ্টা করছেন না। বিবেকানন্দের মতে, ‘‘প্রাচীনকালে ঢের ভাল জিনিস ছিল, খারাপ জিনিসও ছিল। ভালগুলি রাখতে হবে, কিন্তু আসছে যে ভারত— Future India— Ancient India-র অপেক্ষা অনেক বড়ো হবে।’’

অতীতের অশুভ উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হওয়ার কোনও বাসনা এই বিজেপির আছে? মোদি শাহের আছে?
১৯১৭ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ন্যাশনালিজম গ্রন্থের একটি অনুচ্ছেদ পড়লে ২০২৫ সালের ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের এমন একটা পূর্বাভাস শোনা যায় যে গা ছমছম করে! তিনি বলেছিলেন, ‘‘সমাজের যে মানুষেরা বিভিন্ন বিষয়ে, এমনকি খাদ্যাভ্যাসের মতো বিষয়ে আমাদের থেকে আলাদা, যে মানসিকতার বশে আমরা তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলি, সেটা আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনেও প্রভাব ফেলবে, এবং যে যুক্তিসংগত বিভিন্নতা জীবনের লক্ষণ, তাকে সমস্ত ক্ষেত্রে বিনাশ করতে চাইবে। এবং এই স্বৈর-আধিপত্য আমাদের রাজনৈতিক জীবনে অনিবার্য ভাবে মিথ্যা ও শঠতাকে ডেকে আনবে।’’গোরক্ষার নামে, হিন্দু বিপন্ন আওযাজের সুরে যুক্তিসংগত বিভিন্নতার প্রকাশ প্রচণ্ড ভাবে আক্রান্ত।
সুতরাং নিবেদিতাকে গ্রহণের কোনও লক্ষণ কোথাও নেই। ইচ্ছেও নেই।
যে ভূমিতে মার্গারেট নিবেদিতা হয়েছিলেন সেই বঙ্গভূমি সর্বতোভাবে বিজেপিকে বিদায় না করলে এই ভূমির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্বপ্ন, সবই বিনষ্ট হবে। একথা ভুললে চলবে না।

Latest article