বিখ্যাত হতে নয়, মানুষের আত্মার অন্বেষণে থিয়েটার

বারুদের গন্ধ নয়, ব্যারাকপুরে এখন জীবনমুখী প্যাশনের নাম থিয়েটার। মানুষকে শান্তির বাতাবরণ দিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই নয়া বিকল্পের পেছনে আছেন এলাকার সাংসদ থেকে বিধায়ক, সবাই। গুণ্ডারাজ খতম করতে নাটকই এখন হাতিয়ার। পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে এভাবেই হানাহানির অবসান ঘটানো যেতেই পারে। আন্তর্জাতিক নাট্যদিবসে এমন অভিনব উদ্যোগের কথা তুলে ধরছেন শমিত ঘোষ

Must read

এই বছর কয়েক আগেও এই শিল্পাঞ্চলের বাতাসে ছিল বারুদের গন্ধ। ইতিউতি খুঁজে পাওয়া যেত বোমা কিংবা দেশি বন্দুক, বুলেটের খোল৷ চব্বিশের লোকসভার নির্বাচনের সময় থেকেই শপথ ছিল, গুন্ডারাজকে শেষ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে ব্যারাকপুরের পরিচয় হয়ে উঠেছিল গুলি-বোম দেশি পিস্তলের আঁতুড়ঘর। সেই ব্যারাকপুরেই এখন পাড়ায় পাড়ায় নাট্যচর্চা! ব্যারাকপুর লোকসভা মানেই এখন থিয়েটার। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়।’ থিয়েটারের মধ্যে দিয়ে লোকশিক্ষার যে কথা ঠাকুর বলে গেছিলেন সেই কথাকেই যেন বাস্তবের মাটিতে ফলিত প্রয়োগ করছেন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনেরই এক প্রাক্তন ছাত্র। তিনি ব্যারাকপুর লোকসভার বর্তমান তৃণমূল সাংসদ পার্থ ভৌমিক।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গোটা ব্যারাকপুর লোকসভা জুড়ে যে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি হয়, তাতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ব্যারাকপুরের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। ওই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিল্পাঞ্চলে সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাড়ায় পাড়ায় বাজতে থাকে বীভৎস ডিজে বক্স! এবং অশালীন ইঙ্গিতে ‘ডবল মিনিং’ বিজাতীয় ভাষার গান! যে গান (বলা ভাল শব্দতাণ্ডব)-এর সঙ্গে পরিচিত ছিল না মফসসলের বাঙালি। শিল্পাঞ্চলের সাধারণ জনতা তখন প্রহর গুনেছে। পাঁচ বছর বাদে, ২০২৪-শে ব্যারাকপুরের শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাই প্রথম আওয়াজ তোলেন ব্যারাকপুরের মাটিতে গুন্ডারাজ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার। দলীয় রাজনীতির ঊর্দ্ধে থাকা বহু প্রকৃত বামপন্থী নাট্যকার, অভিনেতারাও সেদিন ব্যারাকপুরের মাটিতে গুন্ডারাজের বিরুদ্ধে হেঁটেছিলেন। নির্বাচনের ফলে দেখা যায়, গুন্ডারাজের মহান প্রতিনিধিকে ব্যারাকপুরের মানুষ হারিয়েছে। জিতেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশীর্বাদধন্য পার্থ ভৌমিক।

এখান থেকেই এক নতুন অধ্যায় শুরু। যে ব্যারাকপুরের পাড়ায় পাড়ায় একটা সময় সাধারণ মানুষ তটস্থ থাকত বোম-গুলির শব্দে, সেইসব এলাকাই এখন রমরম করে নাটকের মহড়ার সংলাপে। প্রতিটি বিধানসভার সমস্ত নাটকের দলগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে গড়ে উঠছে নতুন নতুন নাট্য সমন্বয় সমিতি। ইতিমধ্যেই, ‘জগদ্দল নাট্য সমন্বয় সমিতি’ এবং ‘ব্যারাকপুর নাট্য সমন্বয় সমিতি’ আয়োজন করে ফেলেছে দশ দিন ব্যাপী নাট্যোৎসবেরও! সেই নাট্যোৎসবে স্থানীয় নাটকের দলগুলি যেমন অভিনয় করছে তেমনই অভিনয় করছেন দেবশঙ্কর হালদার, সুরঞ্জনা দাশগুপ্তদের মতো বাংলা থিয়েটারের একেকজন দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। স্থানীয় নাটকের দলের তরুণ ছেলে-মেয়েরা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে থিয়েটারে আসছেন। কয়েকবছর আগে এক গুন্ডা বাহুবলীর ভয়ে যে ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া জগদ্দলের সাধারণ মানুষ সন্ধের পর বেরোতে ভয় পেতেন। সেই ভাটপাড়ার প্রেমচাঁদ শতবার্ষিকী ভবন বা শ্যামনগর রবীন্দ্র ভবনে মানুষ প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ করে থিয়েটার দেখছেন!
একজন সাংসদ মনে করছেন, সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশই পারে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে। এবং এই কাজে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন এই এলাকার বিধায়করাও। বীজপুরের বিধায়ক সুবোধ অধিকারী অভিনয় করছেন উৎপল দত্ত রচিত ‘ফেরারী ফৌজ’ নাটকে। নৈহাটির বিধায়ক সনৎ দে অভিনয় করছেন মনোজ মিত্র রচিত ‘কেনারাম বেচারাম’ নাটকে। জগদ্দলের বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম অভিনয় করছেন ‘মৃত্যুপুরীর রহস্য’ নাটকে। সারাদিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরে, স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে মিলেমিশে সারারাত জেগে স্থানীয় বিধায়ক নিজে যখন নাটকের মহড়া দেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই একটা বাড়তি উৎসাহ পায় স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। একটা সময় ছিল, যখন ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ তাঁর দলের নেতাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতেন। নানারকম অসামাজিক কার্যক্রম করতে উৎসাহিত করতেন৷ আর এখন ব্যারাকপুরের সাংসদ তাঁর সহকর্মী দলীয় নেতৃত্বদের এগিয়ে দিচ্ছেন নাটকের মঞ্চে।

আরও পড়ুন-হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মদিবস উপলক্ষ্যে সকলকে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

পাড়ার বিজয়া সম্মেলনীতে অথবা পঁচিশে বৈশাখের মঞ্চেও যারা একদিনের জন্য ‘শখের অভিনয়’ করেছেন, তাঁরাও জানেন দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলা কতটা কঠিন কাজ! অন্তত ‘অ্যামেচার’ অভিনেতাদের ক্ষেত্রে তো যথেষ্ট কঠিন বটেই। সেখানে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী থেকে সরাসরি পেশাদার নাটকের মঞ্চে অভিনয় করাটা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের! রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ও এলাকার সাংসদের অনুপ্রেরণায় মা-মাটি- মানুষের বিধায়কেরা এই কঠিন চ্যালেঞ্জটাই নিয়েছেন। এবং বলতে দ্বিধা নেই, রাজনীতির মঞ্চের মতো নাটকের মঞ্চেও তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন এঁরা এই ঝুঁকিটা নিতে গেলেন! দিব্যি তো, ব্যারাকপুরে যে রাজনীতি স্বাভাবিক অর্থাৎ ‘বাহুবলী পলিটিক্স’ সেই রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কাটিয়ে দিতে পারতেন! কেন হঠাৎ করে, প্রতিটা বিধানসভায় নাট্যচর্চা শুরু করলেন? এতগুলো নাট্য সমন্বয় গড়ে উঠল! নতুন প্রতিভার অন্বেষণ শুরু করলেন! এমনকী, স্থানীয় বিধায়করা অবধি নাট্যমঞ্চে অভিনেতা হিসেবে অবতীর্ণ হলেন! এত কিছু করার দরকারটা কি ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একটাই উত্তর মেলে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীক্ষায় দীক্ষিত বলেই ব্যারাকপুর, শিল্পাঞ্চলের তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ ও বিধায়করা সেখানকার চেনা বাহুবলী রাজনীতির রাস্তায় না হেঁটে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন৷ মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১১-তে বাংলায় সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পরে নেত্রী বলেছিলেন, ‘বিজয় উৎসব নয়, পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করুন।’ ৩৪ বছর ধরে পুঞ্জীভূত রাগের সেদিন বিস্ফোরণ হতে পারত। কিন্তু নেত্রী তা হতে দেননি। সেদিন তাঁর ওই সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু আজ এত বছর বাদে প্রমাণ হয়ে গেছে, নেত্রী কতটা দূরদর্শী ছিলেন। গণতান্ত্রিকভাবেই বাংলার মানুষ সিপিএমকে শূন্য করে দিয়েছে। সেদিনও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৃদয়ে ছিলেন রবীন্দ্র- নজরুল। কণ্ঠে বারবার ধ্বনিত হয়েছে, ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে॥’

উল্লিখিত সাংসদ-বিধায়করা আসলে এই আদর্শেই অনুপ্রাণিত। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথ ধরেই ব্যারাকপুর জুড়ে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটছে। সাংসদ পার্থ ভৌমিক নিজে অভিনয় করছেন ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘আনন্দ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘বসন্ত বিলাপ’-এর মতো নাটকে। হাউসফুল বোর্ড ঝুলছে মফসসলের হলের বাইরে। একসময় অন্ধকারের অতলে ডুবে যাওয়া শিল্পাঞ্চল আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছে। আর রামকৃষ্ণ মিশনের এক প্রাক্তন ছাত্র ঠাকুরের বলা সেই বাণীকে রোজ একটু একটু করে সত্যি করে চলেছেন। থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়। সত্যিই হয়।

Latest article