আরওতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নিজেকে একটা আলাদা ধরনের দল বলে প্রচার করে। আলাদা মানে অন্যান্য দলগুলির থেকে আলাদা। ‘পার্টি ইউথ ডিফারেন্স।’ এই কথা বলে বিজেপি নেতারা বোঝাতে চান যে, মতাদর্শের বিচারে তাঁদের দল অন্যদের থেকে অনেক উঁচুস্তরে অবস্থান করে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কী তাঁদের মতাদর্শ? তাঁদের মতাদর্শকই বা কারা?
এ-পর্যন্ত যা জানা যায়। তাতে একথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) নামক একটি বহু বিতর্কিত ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা সংগঠন হল বিজেপি। তাঁদের পূর্বসূরি ছিল জনসংঘ নামক ভোটে-লড়া সংগঠনটি। আরএসএসের আরও নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় শাখাসংগঠন আছে। সবার উপরে আরএসএস। এই সংগঠনের শাখা-প্রশাখা, তস্য শাখা ও প্রশাখা জালের মতো ছড়িয়ে আছে দেশে-বিদেশে। সকলকে এক ব্রাকেটে সংঘ পরিবার বলা হয়।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলিম লিগ ইত্যাদি দলের বিপরীতে আরএসএস সম্পূর্ণ অন্যমতের একটি মহাদল। ‘মহাদল’ এই কারণে বলছি যাতে পাঠকের বুঝে নিতে সুবিধে হয়। ভারতে যতগুলি রাজনৈতিক দল আছে তারা তাদের শাখা সংগঠন তৈরি করে। সে ছাত্র-যুব-শ্রমিক-কৃষক-মহিলা থেকে শুরু করে নানা শাখা সংগঠন থাকে দলগুলির। আর আরএসএস- এমন একটা সংগঠন যার শাখা সংগঠন বিজেপি এখন দেশের শাসক দল। যার মাথায় আরএসএস। তাই তাকে ‘মহাদল’ না বলে পারা যায় না। তাই বিজেপি অবশ্যই আলাদা ধরনের দল। আরএসএস তাই ওয়ার্কিং কমিটি বা পলিটব্যুরোর ঠাকুদা। আরএসএস- মতাদর্শে পরিচালিত হয় বিজেপি। আজকের প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপির তাবড় নেতারা অনেকেই আরএসএস করা লোক। এক কথায় বলা যায়, আরএসএসের লোকেরাই বিজেপিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। অথচ সংঘের নেতারা বারবার বলেন, সংঘ কোনও রাজনৈতিক দল নয়, সংঘ নাকি একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন। তাঁদের মতাদর্শ হল— ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ বা ‘কারচারাল ন্যাশনালিজম।’ আরএসএস- বিজেপির মতাদর্শিক গুরুরা হলেন— হেডগেওরার, গোলওয়ালকার। এঁরা ছাড়া দীনদয়াল উপাধ্যায় ও শ্যামাপ্রসাদকেও এঁরা নেতা হিসেবে মানেন। সবার উপরে আছেন সাভারকার।
আরএসএস- বিজেপির মতাদর্শগত ভিত্তি তৈরি করেছিলেন সাভারকার, হেডগেওয়ার এবং গোলওয়ালকার। যে মতাদর্শের মূল কেন্দ্রীয় বিষয় হল— ‘হিন্দু-জাতীয়তাবাদ’ ও মূল লক্ষ্য হল ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা। এই মতাদর্শের সঙ্গে গান্ধী-নেহরু-সুভাষের, গণতান্ত্রিক-সমাজবাদী—ধর্ম-নিরপেক্ষ-প্রজাতান্ত্রিক মতাদর্শের মৌলিক পার্থক্য ছিল। তাই আরএসএস-বিজেপির মতাদর্শটাই দেশের প্রধান রাজনৈতিক ধারা থেকে মূলগতভাবেই ছিল আলাদা।
যে কারণে, আরএসএস ধারার নেতারা ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের চলমান ধারার বিরোধী ছিলেন। কারও কারও নামমাত্র সংযোগ ছিল। এঁরা ছিলেন ধর্মীয় কারণে মুসলিম ও খ্রিস্টান বিরোধী। কৃত্রিম হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী। ক্রমে ক্রমে এই ধারার নেতারা ভারতের অতীত গৌরবকে, তার ইতিহাসকে, তার সভ্যতাকে এমনভাবে বিকৃত করতে থাকেন, যা আজকের সংঘ ও বিজেপি নেতাদের হাত ধরে এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এরা কল্পবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মর্যাদা দেয়। সামাজিক ক্ষেত্রে মনুবাদী ধারণাকে প্রশ্রয় দেয়, প্রতিষ্ঠা করে। নারীর মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। গণতন্ত্র এদের পছন্দ নয়। এরা এককেন্দ্রিক নায়কতন্ত্রে বিশ্বাস করে। এরা বর্ণবিদ্বেষী ও দলিত-দমনকারী ব্রাহ্মণ্যবাদী। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনলে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। এরা হিটলার-মুসোলিনিকে শ্রদ্ধা করে। বিশ্বাস করে জাতি ও ধর্ম-বিদ্বেষে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলে মহাত্মা গান্ধী এদের মহাশত্রু হয়ে ওঠেন এবং এদেরই চক্রান্তে খুন হন। সেই ধারা আজও অক্ষুণ্ণ। সংঘ-পরিবার বা গৈরিক শক্তির হাতে মুসলিম-খ্রিস্টান খুন হন আজও। দলিত-নিপীড়ন চলে অবাধে। এই শক্তি সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে যেমন সংসদে একাধিপত্য চালায়, বিরোধীদের বলার অধিকার কেড়ে নেয়, অভিযুক্তর কথা না শুনে শাস্তি দেয়— ঠিক তেমনই এরা এদের সমালোচকদের ‘অপর’ বলে মনে করে এবং তাদের উপর নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালায়। মুক্ত-চিন্তার মানুষদের এঁরা শত্রু মনে করে। প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্রছাত্রী, সমাজকর্মীদের সবরকম হীন উপায় অবলম্বন করে শাস্তি দেয়। এরাই ঠিক করে দেয়— কে কী খাবে, কে কী পরবে, কে কেমন চলচ্চিত্র বানাবে, কে কেমন ছবি আঁকবে, কে কোন দিবস পালন করবে, কে কার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হবে ইত্যাদি। এরা ঘোরতর গান্ধী বিরোধী, ঘোরতম নেহরু বিরোধী। আর চরম কমিউনিস্ট বিরোধী।
আরও পড়ুন: হাইকোর্ট বার নির্বাচনে বিশাল জয় Trinamool Congress-এর
আরএসএসের গোপন অ্যাজেন্ডার মূল বিষয় ছিল সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতা দখল করে তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী দেশ চালানো। জাতীয় কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগে এই শক্তি নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে সংসদ দখল করে। মোদির নেতৃত্বে আরএসএসের কর্মসূচিগুলি কার্যকর হতে থাকে একের পর এক। ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ চালাতে থাকেন নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি। মোদি শাসনের ভিত্তি হল, মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা, উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মেরুকরণকে প্রশ্রয় দেওয়া, প্রতিবাদী বিরোধী শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা। স্বাধীন চিন্তার বিকাশকে ধ্বংস করা। সব সময় শত্রু খুঁজে বেড়ানো (পাকিস্তানকে সব থেকে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে)। বিরোধীদের দেশদ্রোহী বানানো। একটু যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব লাগিয়ে রাখা, উগ্র দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেওয়া। সবসময় মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা এবং তস্কর পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তার সেবায় আত্মনিয়োগ করা। এক পরাক্রমশালী ব্যক্তির ভাবমূর্তি তৈরি করে তাঁকে শাসনে রেখে শাসন চালানো। এরা বহুত্বের ভারতকে এক দেশ, এক ভাষা, এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। বিজেপি এভাবেই একটা আলাদা ধরনের দলে পরিণত হয়ে উঠেছে। মানুষকে মিথ্যা মোহজালে জড়িয়ে, ‘নতুন কিছু’, ‘ভাল কিছু’ হবে বলে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে জনমানসকে বশীভূত করে এক ফ্যাসিবাদী রাজত্ব গড়তে চায় বিজেপি। সম্প্রতি কৃষক আন্দোলন তাদের জয়যাত্রার রথ টেনে ধরেছে। বিজেপি সরকারের মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এখন যত প্রত্যাশা দানা বাঁধছে। বিজেপিও বসে নেই। এরকম অবস্থায় জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রধান ভরসা।