পুরাতন

১৪ বছর পর তিনি নতুন করে ফিরলেন ‘পুরাতন’-এ। আবেশ গড়ে তুললেন। সদ্য মুক্তি পেল পরিচালক সুমন ঘোষ ও প্রযোজক ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর ছবি ‘পুরাতন’। মা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প। এই ছবির মাধ্যমে কামব্যাক হল অন্যতম সেরা অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

গঙ্গার পাড়-ঘেঁষা পুরনো বাড়ি, সেই বাড়িতে একটা চিলোকোঠা আছে, ইটের রংচটা দেওয়ালে শ্যাওলা ধরা। সেই বাড়ির বাসিন্দা এক অশীতিপর বৃদ্ধা। পুরনো রবীন্দ্র রচনাবলি, পুরনো রেডিয়ো, রিড উপড়ানো হারমোনিয়াম, পুরনো ব্যাঙ্কের পাসবই, সেই কবেকার দুর্গাপুজোর চাঁদার বিল, পুরীর লাঠি, মুদির দোকানের ফর্দ— এগুলোই সেই বৃদ্ধার ছোট্ট পরিসর। শিরা উপশিরা বের হওয়া হাতে তিনি সেগুলো যত্ন করে রাখেন উল্টে পাল্টে দেখেন কারণ সেসব ধূসর হয়ে যাওয়া কাগজে রয়েছে তাঁর স্বামীর হাতের লেখা। ওই সব জিনিসেই বেঁচে আছে তাঁর পুরাতন। আজও নকশাল আন্দোলনের অস্থির সময়, বন্দুকের গুলির শব্দ, স্বামীর পাশে বসে গান করা স্মৃতির মাঝেই রয়ে গেছেন তিনি।

মেয়ে ঋত্বিকা বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে কর্মরতা। স্বামী ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার রাজীব। ব্যস্ততম জীবন থেকে সপ্তাহান্তে একটু সময় বের করে মেয়ে আসে মায়ের সঙ্গে একটু সময় কাটাতে। মায়ের আশি বছর পূর্ণ হবে তাই। কিন্তু মেয়ে ঘুম থেকে উঠে দেখল মা তাঁর জন্য টিফিন বানাচ্ছে কারণ মেয়ের স্কুল বাস এসে পড়বে। মা তার মামণির হাত ধরে টিফিন নিয়ে চলে আসেন সদর দরজায়। মায়ের এমন অদ্ভুত আচরণে মেয়ে বুঝতে পারে সে স্মৃতিভ্রংশের শিকার। ডিমেনশিয়ার সেই জগতে নেই কোনও ইঁদুর দৌড়, আধুনিক জীবনের জটিলতা,আছে শুধু শিকড়ে জুড়ে থাকার শান্তি।

গল্পটা পরিচালক সুমন ঘোষের সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘পুরাতন’-এর (Puratawn)। বহুবছর বিদেশে থাকা পরিচালক যে আজও আষ্টেপৃষ্টে নিজের শিকড়ের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন এই ছবি তার প্রমাণ। মন কেমনের ছবি ‘পুরাতন’। আসলে রোজ আধুনিক জীবন যাপন করতে করতে আমরা ভাবি যে আমরা বুঝি অতীতকে একেবারেই ভুলতে বসেছি। সম্পর্কের টানাপোড়েন, ইগোর লড়াই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঝগড়া, কাজের চাপ, পারিবারিক হিউমিলিয়েশন, মানসিক নানা অস্থিরতার মাঝে দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাতে একেবারেই ভুলে গেছি। আসলে তা নয়। যদি তাই হত তবে পুরনো গানের রিমিক্স, রেট্রো ফ্যাশন, পুরনো পথ্য, মা -ঠাকুমার সেই পুরনো রান্নাঘরের পুরাতনী পদ, পুরনো টোটকা, রেট্রো লুক ফিরে ফিরে আসত না নতুন করে। আসলে আমরা কিন্তু পুরনোতেই বেঁচে থাকি। পুরনো সুখ আর পুরনো দুঃখের স্মৃতি, পুরনো সম্পর্ক, ফেলে আসা ভালবাসা, ঘৃণার, আনন্দের রোমন্থনেই কাটে আমাদের সময়। শুধু ব্যস্ততার মাঝে ভুলে থাকার ভান করি। এমনই এক পুরোনোকে নতুন করে তুলে আনলেন পরিচালক সুমন ঘোষ। এক স্মৃতি ভুলতে থাকা মা এবং মেয়ের গল্প এই ছবি।

আরও পড়ুন- বাংলায় হিংসা নয়, বঙ্গীয় ইমাম পরিষদের আবেদন

এই ছবির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হল সর্বকালীন সেরা অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরের অভিনয়। খুব বেছে ছবি করেন শর্মিলা, খুঁতখুঁতে। তাই ১৪ বছর সময় নিলেন ফিরতে। তাহলে কি দীর্ঘ ফিল্মি কেরিয়ারে এটাই শর্মিলার শেষ ছবি? এমনটা শোনা গেলেও উত্তরটা সময়ই বলবে, কারণ ভাল অভিনেতারা ভাল চরিত্রের টানে ফিরে আসেন। আর এমন একটা কালজয়ী চরিত্র যদি আবার পেয়ে যান কে বলতে পারে। তবে সময় লাগবে। ছবিতে আশি বছরের মেক-আপ হীন, আভিজাত্যে পূর্ণ এক মা— যাঁকে দেখলে মন ভরে যায়।
এই ছবি এবং শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্রায়ণ সম্পর্কে পরিচালক সুমন ঘোষ বললেন, পুরনোকে নতুন করে তোলার গল্প বলবে এই ছবি। শর্মিলা ঠাকুর ছাড়া এই ছবিটি সম্ভব হত না। ওঁকে ভেবেই ছবির পরিকল্পনা। ঋতুপর্ণার সাহায্যে আমার ফ্রেমে দুই প্রজন্মের স্বনামধন্য অভিনেত্রীদের পেয়েছি। আশা করি, ‘পুরাতন’ (Puratawn) কখনও পুরনো হবে না। দর্শকের মনে চিরকাল নতুন হয়েই থাকবে।

ছবিতে ঋতুপর্ণা আর শর্মিলার রসায়ন ভারী সুন্দর। শর্মিলার আভিজাত্যের পাশে তিনি সাবলীল, উজ্জ্বল। আবার ইন্দ্রনীলের চরিত্রের পাশেও ঋতুপর্ণা পরিপূরক। অতীত স্মৃতিতে বিচরণকারী মা এবং স্বামী। দুয়ের ধরন আলাদা কিন্তু তাঁদের মাঝে দু-রকমভাবে নিজের টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, সংশয় নিয়ে লড়াই করে চলার অভিব্যক্তি ঋতুপর্ণা অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। জামাই রাজীব অর্থাৎ ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর অভিনয় খুব মনে থাকবে। শাশুড়ি শর্মিলার সঙ্গে রসায়নও বেশ বলিষ্ঠ। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর কাছে এটা জীবনের বড় পাওয়া। এই প্রসঙ্গে অভিনেত্রী জানালেন, এমন একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে পর্দাভাগ করাটাই বড় ব্যাপার। আমার সৌভাগ্য যে, কেরিয়ারে ওঁর মতো কারওর সান্নিধ্য পেলাম। গল্পে ফুটে উঠেছে সম্পর্কের টানাপোড়েন, পুরনো-নতুনের ভেদাভেদ। সবকিছুর মাঝেও যেন দর্শক এক টুকরো শান্তি খুঁজে পাবেন ছবির শেষে।

শর্মিলা ঠাকুর, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত ছাড়া পরিচারিকার ভূমিকায় বৃষ্টি, একাবলি খান্না, শুভ্রজিৎ দত্ত সবাইকেই ভাল লাগবে। পুরনো মানেই তা ঝেড়ে ফেলে দেবার নয়, পুরনো ভিতেই নতুনের নির্মাণ সবল হয়ে ওঠে এই ছবি সেই বার্তা দেয়। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং তাঁর ভাবনা আজ ও কাল ছবিটির প্রযোজনা করেছে। ছবিতে অলকানন্দা দাশগুপ্তর সুরে এবং রাজেশ্বরী দাশগুপ্তর কথায় শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে ‘দূরে’ গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সম্পাদনায় আদিত্যবিক্রম আর সিনেমাটোগ্রাফিতে রবিকিরণ।

বিদেশের মাটিতেও ইতিমধ্যেই সুমন ঘোষের ‘পুরাতন’ পেয়েছে সেরার সম্মান। বিগত বছরে ওয়াশিংটন ডিসির সাউথ এশিয়ান চলচ্চিত্র উৎসবে পেয়েছে সেরা ছবির সম্মান। পাশাপাশি শর্মিলা ঠাকুর পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা। এছাড়া ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব হাউস্টোনে সেরা ফিচার ফিল্ম বিভাগে জয়ী হয়েছে ‘পুরাতন’।

Latest article