বেশি বকবক করবেন না, প্লিজ, শিক্ষা নিয়ে কথা আপনাদের মানায় না

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কোনও কথা রাম-বামের মুখে শোভা পায় না। উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশের ব্যাপম কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে শিক্ষার হাল— সেসব মনে করলেই বোঝা যায় কেন লাল কিংবা গেরুয়া, কারও কেন জ্ঞান দেওয়ার নৈতিক অধিকার নেই। লিখছেন অধ্যাপক প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

পাঠককুল একবার ভেবে দেখুন, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রবেশিকা পরীক্ষায় একজন চাকরিপ্রার্থী ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। কিন্তু সেই শিক্ষককে যখন প্রশ্ন করা হয় ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতির নাম কী, তখন সে নির্বাক, প্রশ্নের উত্তর তাঁর অজানা। এই ভয়ানক পরিস্থিতি কোনও কাল্পনিক গল্প থেকে উঠে আসা নয়, বরং এটা ঘোর বাস্তব পরিস্থিতি, যা ঘটেছিল বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে। ২০১৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে যে প্রকাণ্ড দুর্নীতি, উত্তরপ্রদেশ বেসিক ট্রেনিং (টিচার্স) সার্ভিস রুলস, ১৯৮১-কে অমান্য করা এবং সংরক্ষণ নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছিল তার জন্য ২০২৪ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট ৬৯,০০০ শিক্ষকের চাকরির তালিকা বাতিল করে দেয়।

আরও পড়ুন-কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা

শিক্ষক নিয়োগ-সহ অন্যান্য সরকারি চাকরির নিয়োগের আরও বৃহত্তর দুর্নীতির প্রসঙ্গ টানলে প্রথমেই চলে আসবে বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ব্যাপম দুর্নীতির প্রসঙ্গ। এই ব্যাপম-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল মধ্যপ্রদেশ প্রফেশনাল এক্সামিনেশন বোর্ড যা ৯০-এর দশক থেকে একটি স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে আসছে। এই সংস্থাটিকে দুর্নীতি উৎপাদনের মেশিন বানিয়ে ফেলে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য প্রশাসন। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দুর্নীতির সাথে যুক্ত ২৩ থেকে ৪০ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, অসরকারি পরিসংখ্যানে এই সংখ্যাটা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। সহজেই অনুমান করা যায় দুর্নীতির সাথে যুক্ত এত বৃহৎ সংখ্যক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পিছনে কোন রাঘব বোয়ালকে আড়াল করার চেষ্টা অবশ্যই ছিল। বিজেপির তৎকালীন মন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মা এই দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বলে গ্রেফতারও হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০০৩ থেকে ২০১৮ সাল অবধি টানা মধ্যপ্রদেশে বিজেপির শাসন চলেছে, এই সময়ের মধ্যেই ব্যাপম দুর্নীতি প্রকাণ্ড বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল। ২০০৫ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শিবরাজ সিং চৌহান, যার আমলে এই বৃহৎ পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছিল সেই শিবরাজ সিং চৌহান পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেন এবং গত লোকসভা নির্বাচনে টিকিট পেয়ে জয়লাভ করে বর্তমানে কেন্দ্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই লজ্জা ভারতীয় জনতা পার্টি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে কি ঢাকতে পারবে?
আজ বাংলার বুকে বিজেপি-সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নোংরা রাজনীতির খেলায় নেমে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, উসকানি দিচ্ছে। রাজনীতির আয়নায় তাঁদের নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখা উচিত, দুর্নীতির কত দাগ তাঁদের চোখে, মুখে লেগে রয়েছে। ত্রিপুরায় তখন সিপিএমের চোখ রাঙানি শাসন, মানিক সরকারের রাজত্বকাল। ২০১৪ সালে আগরতলা হাইকোর্ট ১০৩২৩ জন সরকারি স্কুল শিক্ষকের চাকরি বাতিলের রায় দেয়, এই ১০৩২৩ জনের প্যানেল টিকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, চাকরি চলে যায় ১০৩২৩ জন সরকারি স্কুলের শিক্ষকের। পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টেও এই রায় বহাল থাকে। ২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ভরাডুবি হয় ত্রিপুরাতে। এখানে অবশ্যই বলতে হয়, সেই আইনজীবী মহাশয়ের কথা যিনি ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে আগরতলা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, কিন্তু সিপিএমের দুর্নীতিকে ঢাকতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্ট আগরতলা হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রেখেছিল। সেই আইনজীবী আবার বাংলায় ২০১৬ সালের ২৬০০০ ছেলেমেয়ের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্যানেলের চাকরি যাওয়ার পিছনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মামলা লড়েছেন। সেই আইনজীবীর নাম বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য। ২০১৬ সালের এসএলএসটি কর্মশিক্ষা ও শারীর শিক্ষার যে প্যানেলকে অবৈধ দাবি করে তিনি হাইকোর্টে মামলা লড়েছিলেন সেই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের কর্মশিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষার প্যানেলকে সম্পূর্ণ বৈধ ঘোষণা করেছে। বাংলার মানুষ এই সিপিএমের ধ্বজাধারীদের প্রকৃত স্বরূপ চিনে গেছেন, তাই আজ তাঁদের মহাশূন্যে যাত্রা শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন-একা একা বিদেশে

সিপিএমের দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজত্বকালে শিক্ষার যে কি বেহাল দশা হয়েছিল তা বিভিন্ন সময়ে গবেষকরা পরিসংখ্যানের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন। ১৯৯৮-৯৯ সালের ভারত সরকারের বার্ষিক ‘ইকোনমিক সার্ভে’ প্রকাশনে মানবসম্পদ দফতরের পক্ষ থেকে স্কুল শিক্ষার যে তথ্য দেওয়া হয়েছিল তাতে দেখা গেছে নিচু ক্লাসগুলোতে ক্লাস করার পরিসংখ্যানে পশ্চিমবাংলার স্থান ছিল গোটা ভারতে ১৫টি রাজ্যের মধ্যে দশম আর উঁচু ক্লাসগুলোতে ক্লাস করার পরিসংখ্যানে একাদশ। নিচু ক্লাসগুলোতে স্কুলে যাওয়ার হার ছিল জাতীয় গড়ের অল্প উপরে, কিন্তু উপরের ক্লাসগুলোতে ছেলে ও মেয়ে দুই দলের ক্ষেত্রেই স্কুলে যাওয়ার হার জাতীয় গড় হাড়ের অনেক নিচে চলে গিয়েছিল। শিক্ষাব্যবস্থায় সিপিএমের একাধিক বঞ্চনার মধ্যে আরেকটি হল, ১৯৯১ সালে রাজ্যে চালু হওয়া ‘টোটাল লিটারেসি ক্যাম্পেন’ নামক অভিযান। একসময় বীরভূম জেলাকে সিপিএম চালিত রাজ্য প্রশাসন সম্পূর্ণ সাক্ষর বলে ঘোষণা করে দেয়, এই দাবি পরে তাঁরা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। সুনীল সেনগুপ্ত ও হরিশ গজদার তাঁদের গবেষণায় সাক্ষরতা অভিযানের অল্প দিন পরেই বীরভূম জেলার দুটি গ্রামে সমীক্ষা করেন, তাঁরা আবিষ্কার করেন যে, যাদের অভিযানের লক্ষ্য করা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে আন্দাজ মাত্র ৬০ শতাংশ মানুষকে বাস্তবে আধা-সাক্ষর বলা যেতে পারে। এই প্রবঞ্চনা দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বামেরা বাংলার বুকে চালিয়ে গেছে।
এই বঞ্চনার হাত থেকে বাংলার মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২৩-’২৪ সালের ইউনিফায়েড ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম এডুকেশন প্লাসের করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাথমিক এবং উচ্চ প্রাথমিকে পশ্চিমবাংলায় স্কুল ছুটের হার শূন্যতে নেমে এসেছে। পশ্চিমবাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় এ এক বড় সাফল্য। আরও বলতে হয়, যে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিজেপি-সিপিএম, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কুৎসায় নেমেছে, সেই সিপিএমের রাজত্বকালে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কী নিম্নমানের ছিল, তাঁদের জীবনযাত্রা ছিল আর্থিক দুর্দশায় ক্লিষ্ট। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হৃদয় দিয়ে সেই দুর্দশাকে অনুভব করেছিলেন এবং তার ফলশ্রুতিবাবদ ২০১৯ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের জন্য তিনি চালু করেছিলেন নতুন বর্ধিত বেতন কাঠামো। আর্থিক গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছিলেন বাংলার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকেরা।
শেষে তাই বলতেই হয়, গোটা বাংলার ভরসার জায়গাতে যদি কোনও রাজনৈতিক দল থাকে তার নাম তৃণমূল কংগ্রেস!

Latest article