ভাবছি বহুদিন মোর আকাশ হয়নি দেখা, ইচ্ছে হচ্ছিল খুব করে উড়তে ওই মহাশূন্যে, সেথায় কুড়িয়ে নিতাম তারাদের সৌন্দর্য্য মুগ্ধ নয়নে! সত্যিই তো— অবাক দৃষ্টিতে দেখার মতোই রহস্যময়ী ওই নিসর্গ। তবে দুঃখের বিষয় ওই নির্মল মহাকাশে এখন বিপদের ঘনঘটা। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েকশো কিলোমিটার দূরে আকাশের বুকে পৃথিবীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে আবর্জনার মেঘ— মহাজাগতিক আবর্জনা, তার উপর ওগুলো গতিশীল, যাচ্ছেতাইভাবে মহাশূন্যে পাক খাচ্ছে, গতিপথের পাত্তা লাগানো সেভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি, বিজ্ঞানীদের ধারণা ওগুলো নাকি পৃথিবীর চারদিকে একটি ঘুরন্ত চাকতির মতো বাসা বেঁধেছে। অন্তরীক্ষে যেন তৈরি হয়েছে মহাজাগতিক আবর্জনার আঁস্তাকুড়! তৈরি হচ্ছে প্রকৃতির নতুন মহাজাগতিক ভয়।
অন্তরীক্ষে দূষণের কালো ছায়া
মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণার পরিধি আজ আকাশছোঁয়া। সাধারণ জনতা থেকে জ্যোতির্বিদ সকলের কাছেই ওই মহাশূন্য হয়ে উঠেছে অত্যন্ত আগ্রহের। অপরিসীম সম্ভাবনার রহস্য খুঁজে পেতেই বিশ্ব জুড়ে চলছে রমরমিয়ে বৈজ্ঞানিক কসরত। পৃথিবীর বুক থেকে ছুটে যাচ্ছে রকেট, স্যাটেলাইট এবং আরও নানাধরনের ছোট-বড় মহাকাশযান ও যন্ত্রপাতি। স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে বর্জ্যের— প্রয়োজন ফুরালে কিংবা নির্ধারিত কাজের শেষে পৃথিবী থেকে পাঠানো বস্তু বা বস্তুসামগ্রীর মোটামুটিভাবে সবটাই থেকে যাচ্ছে ওই মহাশূন্যে। যদিও উৎপন্ন ওইসব মহাজাগতিক অবশিষ্টের মধ্যে কিছু জিনিস হয়তো একটি সময় পরে আপনা-আপনিই ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও সে-সময় আসার আগে পর্যন্ত ওগুলো পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরের জগৎ— উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক।
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা তাঁদের ভাষায় ওগুলোর নাম দিয়েছেন ‘স্পেস ডেব্রিস’। তবে অবশ্য অনেকেই স্পেস জাঙ্ক, স্পেস পলিউশন, স্পেস ওয়েস্ট, স্পেস ট্রাশ, স্পেস গার্বেজ ও এমনকী কসমিক ডেব্রিসও বলে থাকেন। এখন চিন্তার বিষয়, আমরা এই বিষয়টিকে যে নামেই ডাকি না কেন, বিষয়টি হল মহাকাশ দূষণ ও তার ভয়াবহ রূপ! পৃথিবীর অন্তর্বর্তী পরিবেশদূষণ যে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ সেকথা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি; তার উপর আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আবারও একটি নতুন ভয়াবহতা আমাদের মাথার উপর নাচছে। মাথার উপর মহাশূন্যেও গভীরভাবে পড়েছে দূষণের কালো ছায়া। বলতে গেলে দূষণ নামের কালো ভূতটি আমাদের ঘরে ও বাইরে দু’জায়গাতেই সরষের মধ্যেই বসে বসে ভয় দেখাচ্ছে!
স্পেস গার্বেজের স্বরূপ
ওই মহাশূন্যে, বিশেষ করে পৃথিবীর কক্ষপথে যে আবর্জনার আস্তাকুঁড় তৈরি হয়েছে সেটা আসলে মানুষের তৈরি বস্তু যেগুলো অকার্যকর হয়ে পড়েছে তাদের জন্য। অব্যবহৃত স্পেসক্রাফ্ট, পরিত্যক্ত লঞ্চ ভেহিকলের বিভিন্ন স্টেজ, অন্তরীক্ষ অভিযানে ব্যবহৃত অন্যান্য উপকরণ যেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, রকেট ও স্পেসক্রাফ্টের ব্রেকআপের সময় তৈরি হওয়া কিছু বর্জ্য, এসবই যাচ্ছেতাইভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাশূন্যে। এছাড়াও ডিসইন্ট্রিগেশন, ইরোশন এবং কলিশনের দরুন সৃষ্টি হয় কিছু ভগ্নাংশের, রকেট মোটর থেকে আগত কিছু কণা, কিংবা মহাকাশ যান থেকে নির্গত তরলের কঠিনে পরিণত হওয়ার ফলে যে আবর্জনা সৃষ্টি হয় সেইসব কিছুই একসঙ্গে মহাকাশের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে তুলেছে।
আরও পড়ুন-এবার হাসপাতালে ভর্তি না হলেও মেডিক্লেমের সুবিধা পাওয়া যাবে
স্পেস ট্রাসের আধিক্য
শূন্যে ওইসব অকেজো বস্তু কিংবা বস্তু সামগ্রী সাধারণত পৃথিবীর প্রায় ২০০-২০০০ কিলোমিটার উচ্চতায় লিও অঞ্চলে অর্থাৎ লো আর্থ অরবিটে সবচেয়ে বেশি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে লিও কক্ষপথে প্রায় ১০০০০ স্যাটেলাইট পাক খাচ্ছে এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ওই এলাকা ঘিঞ্জি হতে বসেছে। তৈরিও হচ্ছে মাত্রা ছাড়িয়ে পরিত্যক্ত কসমিক ডেব্রিস। বিজ্ঞানীদের ধারণা ওইসব বস্তুর মধ্যবর্তী সংঘর্ষের আনুমানিক বেগ প্রায় ৯-১৪ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড। প্রায় ৬০০-১০০০ কিলোমিটার উপরে রয়েছে সান-সিঙ্ক্রোনাস অরবিট, সেখানেও রয়েছে প্রায় ৮০০ স্যাটেলাইট, যদিও অধিকাংশই আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট। এখানেও পৃথিবীর মেরু অঞ্চলের দিকে প্রচুর পরিমাণে ওয়েস্ট মেটিরিয়াল জমা হচ্ছে; মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এর নাম রেখেছেন গ্রেভইয়ার্ড অরবিট। তবে এটিই একমাত্র গ্রেভইয়ার্ড অরবিট নয়, বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা খুব তাড়াতাড়িই জিওসিঙ্ক্রোনাস অরবিটও গ্রেভইয়ার্ডের দিকেই যাচ্ছে। প্রায় ৩৫০০০-৩৬০০০ কিলোমিটার উঁচুতে অবস্থিত এই কক্ষপথেও রয়েছে প্রায় ৮০০টি স্যাটেলাইট। এই অঞ্চলেও উপস্থিত ওয়েস্ট আকারে বেশ বড় এবং অনেকসময়ই তাদের গতিবিধি নজরে রাখা সম্ভব। এছাড়াও প্রায় ২০০০-৪০০০০ কিলোমিটার উচ্চতায় হিও অর্থাৎ হাইলি ইলিপ্টিক্যাল অরবিট কিংবা প্রায় ৩৬১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় জিও স্টেশনারি গ্রেভইয়ার্ড অরবিটেও রয়েছে ডেব্রিস। বহুসংখ্যক মহাকাশযান ওইসব কসমিক ওয়েস্ট মেটিরিয়ালের অপ্রত্যাশিত সংঘর্ষের শিকার হয়েছে। বর্তমানে মহাকাশ থেকে ওইসব আবর্জনার নিষ্কাশন জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরিসংখ্যান ও পরিণতি
ইউনাইটেড স্টেটস স্পেস সার্ভেল্যান্স নেটওয়ার্কের ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের রিপোর্ট বলছে, পৃথিবীর উপর বিভিন্ন কক্ষপথে নাকি প্রায় ২৫৮৫৭টি কৃত্রিম বস্তু পাক খাচ্ছে, এর মধ্যে ৫৪৬৫টি বর্তমানে কার্যকরী স্যাটেলাইট এবং অগণিত ক্ষুদ্র বস্তু যাদের নির্দিষ্ট চলাফেরা আন্দাজ করা মুশকিল। এক ধরনের অত্যধিক উপবৃত্তাকার কক্ষপথ, যা প্রধানত রাশিয়ান উপগ্রহগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি উচ্চ অক্ষাংশের অঞ্চলে দীর্ঘ সময় সিগন্যাল কভারেজ নিশ্চিত করতে সহায়ক, যাকে বলে মলনিয়া অরবিট, এই অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে কসমিক ওয়েস্ট। ২০২০ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ওই প্রকার ডেব্রিসের পরিমাণ প্রায় ৮০০০ মেট্রিক টন। জানুয়ারি, ২০১৯ সালের একটি তথ্য অনুযায়ী, ১ সেমির চেয়ে ছোট বস্তুকণার সংখ্যা প্রায় ১২৮ মিলিয়ন, ১-১০ সেমি বস্তুর সংখ্যা প্রায় ৯ লক্ষ এবং ১০ সেমির চেয়ে বড় কণার সংখ্যা প্রায় ৩৪০০০। বিজ্ঞানীদের ধারণা ওইসব ছোট ছোট কণাগুলো মাইক্রোমেটিওরয়েডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সংঘর্ষ ঘটায়।
কেসলার সিনড্রোম ও নজরদারি
না চাইতেই মহাকাশে যেভাবে আবর্জনার পরিমাণ বাড়ছে তার ফলে স্যাটেলাইট, মহাকাশ অভিযান, বিমান চলাচল ও ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তার উপর ১৯৭৮ সালে নাসার বিজ্ঞানী ডোনাল্ড কেসলার এবং বার্টন জি কু-পালাই একত্রে যে ‘কেসলার সিনড্রোম’-এর ধারণা দেন, তা আরও ভয়াবহ। কেসলার সিনড্রোম হল একটি পরিস্থিতি যেখানে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ ও আবর্জনার সংঘর্ষ থেকে নতুন ধ্বংসাবশেষ সৃষ্টি হয় যা আরও সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়িয়ে মহাকাশ অভিযানের জন্য বিপজ্জনক পরিবেশ তৈরি করে। বলে রাখা ভাল, শূন্যে ওইসব ওয়েস্ট জমা হওয়ার পিছনে শুধুমাত্র স্পেস মিশন দায়ী নয়, অনেক সময় পৃথিবীর বুক থেকে প্রাকৃতিক নির্গমনের ফলেও ওয়েস্ট গিয়ে জমা হয় মহাশূন্যে। বিজ্ঞান লেখক উইলি অট্টো অস্কার লে সেই ১৯৬০ সালে এই স্পেস ডেব্রিসের ধারণা দিয়েছিলেন। আর আজ নাসা-সহ পৃথিবীর সব দেশের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কীভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়া যায় সেই চেষ্টাই করছেন।