মহাবলিপুরম

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে হোক বা ঐতিহাসিক গুরুত্বে মহাবলিপুরম হল ভারতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি পর্যটনকেন্দ্র। সেই প্রাচীন বন্দরনগরী ঘুরে এসে লিখলেন হেমন্তিকা কর

Must read

গন্তব্য মহাবলিপুরম (Mahabalipuram), অতীত যেখানে কথা বলে। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে যখন দক্ষিণ ভারত পল্লব রাজবংশের শাসনাধীন ছিল তখনই তৈরি হয়েছিল মহাবলিপুরমের অসাধারণ মন্দিরগুলি। পল্লব বংশীয় রাজা নরসিংহ বর্মনের অন্য নাম মহাবলী, তাই নগরীর নাম মহাবলিপুরম। স্থানীয় উচ্চারণে মামল্লাপুরম। পাশেই উত্তাল বঙ্গোপসাগর। অতীতের এই বন্দর ছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। ব্যবসা-বাণিজ্য চলত রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে। বাণিজ্য-নির্ভর এই রাজ্যের অর্থনীতিও ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। তারপর কেটে গেছে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী। বঙ্গোপসাগরের বুকে কত ঢেউ ভেঙেছে, কত ঢেউ তৈরি হয়েছে। কিন্তু পাথরের উপর ছেনি-হাতুড়ির আঘাতে শিল্পীরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন যেসব অনবদ্য শিল্প-স্থাপত্য তারা এখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। হারিয়ে গেছেন সেই সব শিল্পীরা। হারিয়ে গেছেন পৃষ্ঠপোষক রাজারাও। তবু পল্লব যুগের নিদর্শন রয়ে গেছে পাথরের বুকে। সমুদ্রের নোনা বাতাস আর কালের আগ্রাসন সহ্য করেও টিকে আছে তারা।

পিরামিড আকৃতির মন্দির
প্রাচীন নাবিকেরা বলতেন সাতটি প্যাগোডার মন্দির। ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো মহাবলিপুরমকে (Mahabalipuram) ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থানের তালিকাভুক্ত করে। একটা অটোতে চেপে শুরু করেছিলাম মহাবলিপুরম সফর। একটা চল্লিশ টাকার টিকিট কাটলেই দেখা যায় সব ক’টা দর্শনীয় স্থান। শুধু সি শেল মিউজিয়ামের টিকিট এর অন্তর্ভুক্ত নয়। শুরু করলাম পঞ্চরথ দিয়ে। প্রাচীর বেষ্টিত একটি স্থান। গেট দিয়ে ঢুকেই ইতস্তত ছড়ানো কিছু পাথর ও মন্দির। প্রথমে দ্রৌপদীর রথ। তারপর নকুল-সহদেবের রথ, সামনে হাতির মূর্তি। তারপর অর্জুন, ভীম ও সবশেষে যুধিষ্ঠিরের রথ। একটিমাত্র শিলাকে কেটে পিরামিড আকৃতির মন্দির। গায়ে প্রচুর কারুকার্য।

পাথরের মাঝে ভীমের রান্নাঘর
মহাবলিপুরমের স্মৃতিমন্দিরগুলির মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় হল অর্জুনের তপস্যা। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম ওপেন স্টোন কার্ভিং আর্ট। যাই মহিষাসুরমর্দিনী গুহা। মণ্ডপটি অসমাপ্ত ও পরিত্যক্ত, পুজোর ব্যবস্থা নেই। ছাদ দিয়ে জল ঝরছে। বছরের পর বছর সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় পাথর ক্ষয় হতে শুরু করেছে। উপর থেকে দেখা যায় সমুদ্রের নীল। পাশেই লাইট হাউস। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে একটি মণ্ডপ। সেখানে অপূর্ব সব চিত্র খোদাই করা আছে। মহিষাসুরমর্দিনী, অনন্ত শয্যায় বিষ্ণু, শিব-পার্বতীর মূর্তি। শুধুমাত্র ছেনি-হাতুড়ি সম্বল করে বিশাল পাহাড় কেটে এসব মন্দিরের সৃষ্টি হয়েছে। সামনেই রায়া গোপুরম— একটি অসম্পূর্ণ কাঠামো, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। এরপর বরাহ মন্দির। ভেতরে বরাহ অবতারের মূর্তি। দেখলাম গণেশ মন্দির। আরেকটু এগোতেই এক বিশাল পাথর। একটি বিন্দুতে স্পর্শ করে রয়েছে। নাম কৃষ্ণের মাখন লাড্ডু। ব্রিটিশ যুগে হাতির সাহায্যে দড়ি দিয়ে টেনে সরানোর চেষ্টা করলেও সরানো যায়নি ২৫০ টনের এই পাথরটি। পাথরটি আসলে ব্যালেন্সিং রক। পায়ে পায়ে এগোই। দুটো বিরাট পাথরের মাঝে ভীমের রান্নাঘর। ভীম যেমন বলশালী, তাঁর রান্নাঘরটিও বিশাল। সেখানে আশেপাশে ছড়ানো-ছিটানো অনেকগুলি মন্দির।

আরও পড়ুন- প্ররোচনার শিকার হবেন না, ভুলপথে চালিত হবেন না

মুক্তোর সংগ্রহশালা
মহাবলিপুরমের অন্যতম আকর্ষণ সি শেল মিউজিয়াম। এটি এশিয়ার বৃহত্তম সামুদ্রিক শেল মিউজিয়াম। সারা বিশ্ব থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার সামুদ্রিক শামুক, ঝিনুক, শঙ্খ ও সামুদ্রিক জীবাশ্মের বিস্তৃত সংগ্রহ রয়েছে এই মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামটি কয়েকটি ব্লকে বিভক্ত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিভিন্ন খনিজের সংগ্রহ। যেখানে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ খুব সুন্দরভাবে ডিসপ্লে করা আছে। একটি রয়েছে মুক্তোর সংগ্রহশালা। সেখানে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন আকার-আকৃতির মুক্তোর সংগ্রহ রয়েছে। সবচাইতে ভাল লেগেছে এই মুক্তোর সংগ্রহটি। ভাল লেগেছে সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুক সংগ্রহটিও। এক পাশে একটা আ্যকুরিয়াম, একটা ডাইনোসর পার্ক এবং সবশেষে একটা বাজার।

তিন মন্দিরের সমন্বয়
মহাবলিপুরমের (Mahabalipuram) শেষ গন্তব্য শোর টেম্পেল বা তট মন্দির। বঙ্গোপসাগরের একদম তীরে অবস্থিত এই মন্দির। অষ্টম শতাব্দীতে গ্রানাইটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই মন্দির। তৈরির সময় এই মহাবলিপুরম ছিল একটি ব্যস্ত বন্দর। বন্দরাগত নাবিকদের কাছে এই মন্দির ছিল একটি ল্যান্ডমার্ক। মার্কোপোলোর বর্ণনায় যে সাতটি প্যাগোডার কথা বলা হয়, এটিই হয়তো সেই সিরিজের শেষ মন্দির। এই মন্দিরটি পূর্ব বর্ণিত সাতটি প্যাগোডার অংশ যার মধ্যে ছটি মন্দির এখনও সমুদ্রে ডুবে আছে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সেই সুনামি মন্দির ও তার আশেপাশের বাগানে আঘাত করলেও মন্দিরটি খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। জল কমে গিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে তাড়াতাড়িই।
মন্দিরটি তিনটি মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত। প্রধান মন্দিরটি শিবের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত। ছোট দ্বিতীয়টিও তাই। মাঝের মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়েছে বিষ্ণুকে। ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দিরটিকে আরও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে।
তট মন্দির থেকে যখন বের হয়ে আসি, সূর্য তখন পাটে বসতে চলেছে। পাশেই সদা চঞ্চল বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের ধারে একবার দাঁড়াই, তারপর ফেরার পথ ধরি।
রাত নামবে। ক্রমশ আলো মুছে গিয়ে মন্দিরের দখল নেবে অন্ধকার। তারাভরা আকাশের নিচে পড়ে থাকবে তটমন্দির, সমুদ্র আর ঝাউবন। ফিসফিস করে তারা অতীতের কথা বলবে। অশরীরী হয়ে ঘুরে বেড়াবে কত ছায়ামানুষ।

কীভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে রেলপথ, বিমানে সরাসরি ভায়া চেন্নাই হয়ে পৌঁছতে পারেন মহাবলিপুরম। আবার কলকাতা থেকে ভায়া ভুবনেশ্বর, রায়পুর, দুর্গাপুর হয়েও পৌঁছনো যায় চেন্নাই। সেখান থেকে সড়কপথে ৬ ঘণ্টা মহাবলিপুরম।

কোথায় থাকবেন
মহাবলিপুরম এবং আশেপাশের এলাকায় আছে বেশকিছু হোটেল এবং গেস্ট হাউস। ভাড়া নাগালের মধ্যে। থাকা-খাওয়ার কোনও অসুবিধা হবে না। আগে থেকে বুকিং করে গেলেই ভাল।

Latest article