দিন আসে, দিন যায়। লেখা থাকে ইতিহাসের পাতায়, কিংবা আজকের প্রতিযোগিতার পরীক্ষার বইয়ে। তরুণ প্রজন্ম মুখস্ত করে ভালই। বছর ঘোরে, মানুষ ভোলে এঁদের লড়াইয়ের নেপথ্য কাহিনি। ১১ ডিসেম্বর তেমনই এক দিন, মনে রাখার। আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস। আর এই শিখরে চড়ার গল্পের সঙ্গে গত কয়েক দশক ধরে আরও বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছে ভারতের মহিলা পর্বতারোহীদের অভিযানের লড়াই। বেশিটাই সাফল্য। পুরুষের সঙ্গে আজ সমান কৃতিত্বের দাবিদার তাঁরাও। সম্পূর্ণ একক কৃতিত্বে একের পর এক শিখরে চড়ে পতাকা পুঁতে আসার নেশা, আজ অনেক মেয়ের সাফল্যের পেশাও বটে। সেদিনের বাচেন্দ্রি পালেরা যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, আজ তা অরুণিমা, ভাওয়ানা, প্রিয়াঙ্কা, ছন্দা, পিয়ালি বা স্বরূপার মতো অনেক মেয়ের পাথর কেটে-ভেঙে ওঠার পথ। কেউ হয়ত চলে যান চিরঘুমের দেশে। পর্বতের বরফ বিছানায় পরিণত হয়, মৃত্যুশয্যায়। মানুষ ভুলে যায়। পাথরে লিখে আসা নাম কিন্তু থেকেই যায়।
অরুণিমা সিনহা
বাস্কেটবল খেলে বাড়ি ফিরছিলেন। ট্রেনের কামরায় বেশ কয়েকজন আগন্তুকের ঘোরাফেরা। আঁচ করতে বেশি দেরি করেননি তিনি। ডাকাত পড়েছে ট্রেনে। গলায় ছিল সোনার মেডেল। রাজ্যস্তরে খেলায় সেগুলো অর্জন করা, একজন অ্যাথলিটের কাছে তার সব চেয়ে বড় সম্পদ। প্রবল ধস্তাধস্তি। চলন্ত ট্রেনের খোলা দরজা দিয়ে অরুণিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ওরা। আর ঠিক সেই সময়ই পাশের ট্র্যাক দিয়ে আরও একটি ট্রেন আসছিল। ভলি বল খেলা শেষ। কারণ, বাঁ পা-টি চিরকালের জন্য বাদ পড়ে। ডান পা ও শিরদাঁড়াও ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত। প্রস্থেটিক পা বসানো হয়। সালটা ২০১১। কাঠের পা পরে একটু একটু করে হাঁটাচলা শুরু হয়েছে। খবরে দেখলেন এভারেস্ট জয়ের খবর। নাম শুনলেন বাচেন্দ্রি পালের। উত্তরকাশীতে শুরু হল ট্রেনিং। অন্যদের মতো সবল নন তিনি; তা-ও জোর দমে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর ফলাফল পেলেন ২০১৩ সালের ২১ মে। ৫২ দিনের লম্বা সামিটের পর প্রথম প্রতিবন্ধী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্টের শিখর ছুঁলেন অরুণিমা সিনহা। তৈরি করলেন বিরল নজির,‘টপ অফ দা ওয়াল্ড’-এ পা রেখে। শুধু কী আজ এভারেস্ট! একের পর এক শৃঙ্গ জয় করেছেন অরুণিমা। বিশ্বের প্রথম প্রতিবন্ধী মহিলা পর্বতারোহী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট, কিলিমাঞ্জারো, এলব্রুশ, ভিনসন, কসকিয়াসকো-সহ সাতটি শৃঙ্গ জয় করেছেন।
ছন্দা গায়েন
২০১৪-র ২৩ এপ্রিল। মা জয়ার সঙ্গে শেষ বার কথা হয়েছিল মেয়ের। তার পর আর গলা শোনেননি মা৷ বেশ কিছু টাকা ধারও ছিল। মা বলেছিলেন, টাকাটা যত তাড়াতাড়ি শোধ করে দিস৷ ছন্দা বলেছিলেন, ফিরে এসেই শোধ করে দেব৷ ফেরা আর হয়নি। ইতিহাস গড়ে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে টুসি দাসকে নিয়ে ৮৫৮৬ মিটার উচ্চতার কাঞ্চনজঙ্ঘায় উঠে পড়েছিলেন হাওড়ার বঙ্গ তনয়া৷ সেই জয়ের পর দিনই ৮৫০৫ মিটার উচ্চতায় কাঞ্চনজঙ্ঘার তৃতীয় শৃঙ্গ ইয়ালুং কাং জয় করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেন এভারেস্ট জয়ী বাঙালি কন্যা। সেবার, এভারেস্ট জয়ের পর, একই অভিযানে মাউন্ট লোৎসে শৃঙ্গ জয় করেন ছন্দা৷ সেটাও রেকর্ড৷ এবারও মাউন্ট কাঞ্চনজঙ্ঘা জয় করার পরদিনই ইয়ালুং কাং জয় করার উদ্দেশ্যে তিনজন শেরপাকে সঙ্গে নিয়ে ছন্দা রওনা হন৷ কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হতে শুরু করায় মাঝপথ থেকেই যখন ওঁরা ফিরে আসছেন, তখন এক প্রবল হিম-ধসের মুখে পড়েন সবাই৷ ছন্দা এবং দু’জন শেরপা চাপা পড়ে যান বিপুল পরিমাণ বরফের নিচে৷
আরও পড়ুন-স্টেটাস সিঙ্গল
প্রিয়াঙ্কা মোহিতে
পৃথিবীর দশম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট অন্নপূর্ণা। সম্প্রতি সেখানেই উড়ল ভারতের তেরঙা পতাকা। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে এই শৃঙ্গ আরোহণ করলেন প্রিয়াঙ্কা মোহিতে। উচ্চতার দিক থেকে দেখতে গেলে এভারেস্ট, কে-২ কিংবা কাঞ্চনজঙ্ঘার থেকে অনেকটাই নিচু অন্নপূর্ণা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৮০৯১ মিটার। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে নেপালের অন্নপূর্ণা অন্যতম দুর্গম শৃঙ্গ হিসাবেই পরিচিত। তার কারণ, অন্নপূর্ণার ভৌগলিক গঠন এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রিয়াঙ্কা মহারাষ্ট্রের সাতারা অঞ্চলের বাসিন্দা। কিশোর বয়সেই মহারাষ্ট্রের সহাদ্রি রেঞ্জে রক-ক্লাইম্বিং ও আরোহণ শিখেছেন তিনি। পরবর্তীকালে উত্তরাখণ্ডের গাড়ওয়াল বিভাগে হিমালয় আরোহণ অনুশীলন করেন দীর্ঘদিন। ২০১২ সালে বান্দরপঞ্চ শৃঙ্গ দিয়ে শুরু জয়যাত্রা। পরের বছরেই এভারেস্ট। তখনও কুড়ির গণ্ডি পেরোননি তিনি। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে জয় করেন পৃথিবীর পঞ্চম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট মাকালু। তা ছাড়াও স্পিতি, লাহুল, লহটস ইত্যাদি একাধিক কঠিন শৃঙ্গ জয় করার পালক রয়েছে তাঁর মুকুটে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল অন্নপূর্ণা।
পিয়ালি বসাক
বাংলার চন্দননগরের মেয়ে। অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়া ৮ হাজার ১৬৭ মিটার ধৌলাগিরি শৃঙ্গ জয় করে আজ ভারতের ইতিহাসের প্রথম মহিলা। শুধু সাফল্যই নয়, এই অভিযানে তিনি এক ভারতীয় তো বটেই, বাঙালি হিসেবেও অনন্য নজির গড়লেন। সম্প্রতি, অক্টোবরে। অভিযানে ছিলেন আরও দুই ভারতীয় এবং চার শেরপা। সকলেই অক্সিজেন নিয়ে এই অভিযান করলেও চন্দননগরের কানাইলাল স্কুলের শিক্ষিকা পিয়ালি একমাত্র অক্সিজেনের সাহায্য ছাড়া এই অভিযান শেষ করেন। নেপাল থেকে তিনি ধৌলগিরি অভিযানে বেরোন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় রক ক্লাইম্বিং কোর্স। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ। এর আগে ২০১৮-তে মানাসুলু শৃঙ্গ জয় করেছেন পিয়ালি। তবে মাউন্ট এভারেস্টের খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসতে হয় তাঁকে। সেই ঘটনাই তাঁর জেদ আর খিদে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। যেখানে সাধারণত আট হাজার মিটার উচ্চতায় পা দিলেই অক্সিজেন লাগে, সেখানে পিয়ালির এই পদক্ষেপ, ঘরের মেয়ের অনন্য নজির।
ভাওয়ানা দেহারিয়া
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট কসিউজকো জয় করলেন ভারতীয় মহিলা পর্বতারোহী, মধ্যপ্রদেশের মেয়ে, ভাওয়ানা দেহারিয়া। ২২২৮ মিটার উঁচু এই শৃঙ্গ তার দুর্গম ভূপ্রকৃতির জন্য সমস্ত পর্বতারোহীর কাছেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেটাই নিলেন ভাওয়ানা। ইতিমধ্যে জয় করে ফেলেছেন মাউন্ট এভারেস্ট। ২০২০-এর দেওয়ালির সময় তিনি উঠেছিলেন মাউন্ট কিলিমাঞ্জারোর চূড়ায়। আর ২০২১-এর হোলির রং আরও বর্ণময় করলেন কসিউজকো জয় করে। দুটো বড় উৎসবে জয় করলেন দুই দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ।
স্বরূপা মণ্ডল
রাশিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এলব্রুজ জয় করে, প্রথম বাঙালি মহিলা হিসাবে ইতিহাসে নাম লিখলেন হাওড়ার ডোমজুড়ের বাসিন্দা কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যা স্বরূপা মণ্ডল৷ এলব্রুজ শৃঙ্গের উচ্চতা ৫৬৪২ মিটার। এভারেস্ট বিজয়ী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে শৃঙ্গ জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। আবহাওয়া প্রতিকূল থাকলেও দ্রুত নিজের লক্ষ্যে পৌঁছে যান স্বরূপা৷ আন্দুলের প্রভু জগবন্ধু কলেজের স্নাতকের ছাত্রী স্বরূপা ২০১১ সালে পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নেন৷ ২০১২ সালে ওয়াল ক্লাইম্বিংয়ের প্রশিক্ষণ ৷ পরে পাহাড়ে চড়ার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে বেসিক ও ২০১৬ সালে অ্যাডভানস ট্রেনিং কোর্স। বাকিটা ইতিহাস।