ইঁটের টোপর মাথায়-পরা শহর কলিকাতা/অটল হয়ে ব’সে আছে ইঁটের আসন পাতা, সেই কলকাতায় এবার পুরভোট। মহানগরে এমন মহারণের আগে একবার নাগরিক চাহিদা-প্রাপ্তির খতিয়ান খুলে দেখলেন দেবাশিস পাঠক
কলকাতা বড় কিউবিক— যেন পিকাসোর ইজেলে তুলিতে গরগরে রাগে রাঙা। সেই কলকাতার ৪০ লক্ষ ৪৮ হাজার ৩৫২ জন ভোটার পুর নির্বাচনে ভোট দেবে আগামী ১৯শে ডিসেম্বর।
কলকাতা সুররিয়ালিস্ট— যেন স্যাগালের নিচের লালের গূঢ় রহস্যে রাঙা। ৪,৭৪২টি বুথে অনুষ্ঠিত হবে এই শহর কলকাতার ভোটদান কথা।
কলকাতা বড় অস্থির— যেন বেঠোফেন ঝড়ে খুঁজছেন সিমফনি কোনও শান্তির। কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে যাঁরা ২৯৪টি আসনের মধ্যে কেবল ৭৭টি আসনে জিতেছিলেন এবং তারও পর ভাঙনের ঝাপটায় কমতে কমতে ষাটের কোঠায়, তাঁদের সঙ্গে অস্থির লড়াই এবার সেই পক্ষের যাঁরা ওই নির্বাচনে শূন্যে বিলীন হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় তাই ১৯শে জবর লড়াই দ্বিতীয় স্থান নিয়ে। জোড়া ফুলের ঝড়ে শান্তির সিমফনির খোঁজ চলছে এ নিয়েই।
আরও পড়ুন-এ টক টু ববি হাকিম
কলকাতা এক স্কাল্পচার— রঁদ্যার বাটালি পাথরে কাটছে পেশল-প্রাণের কান্তি। ১৪৪টা ওয়ার্ডে তাই লড়াই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের। পরম্পরার গৌরবের সঙ্গে আগামীর প্রতিশ্রুতির। অতীতকে ছাপিয়ে আরও, আরও, আরও অগ্রগতির ভাস্কর্য গড়তে কলকাতা এখন প্রস্তুত হচ্ছে।
২০১০-এরপর থেকে এ শহর এমন কোনও মহানাগরিক দেখেনি যিনি জোড়া ফুল শিবিরের নেতা নন। এক কথায় গত এক দশক ধরে টানা পুরশ্রী বিবর্ধনের দায়িত্ব তৃণমূল কংগ্রেসকেই অর্পণ করেছেন এই শহরের নাগরিক সমাজ।
আগামীতেও, আরও একবার সেই দৃশ্যই মঞ্চস্থ হতে চলেছে। এই প্রত্যয়ের বিপ্রতীপে তাবৎ কলেবরের বিশেষত্বই হচ্ছে সেটার অকিঞ্চিৎকরতা। নির্বাচনের প্রাক্কালে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে কান পাতলেই তৃণমূল কংগ্রেসকে ছোট লালবাড়ি থেকে উৎখাত করার তাবৎ আহ্বানকেই মানুষজন অক্ষমের উত্তেজনা প্রকাশ কিংবা অকর্মণ্যের আত্মবিনোদন বলে ধরে নিয়েছেন।
আরও পড়ুন-বাইপাসে দুর্ঘটনা এড়াতে পথচারীদের জন্য সতর্কতামূলক প্রচার করল তিলজলা ট্রাফিক গার্ড
কেন? কেন? কেন?
এই তো সেই শহর যেখানকার পুরসভার প্রতীকের কেন্দ্রে বিরাজ করে অনবদ্য এক প্রতীক। অগ্নিহোত্রী হস্ত। এই প্রতীক দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের, ব্যাধিমুক্ত নাগরিক জীবনের এবং অমঙ্গলরিক্ত সমাজকল্যাণের। বিগত এক দশকে সেই কাজটাই তিল তিল করে নিশ্চিত করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মহানাগরিক ও পুরপ্রশাসকরা। বাম আমলে যে লালবাড়ি ‘চোরপরেশন’ নামের কুখ্যাতি ললাটলিখন বলে মেনে নিয়েছিল, সেই লালবাড়িই এখন জনগণমনে নাগরিক চাহিদা পূরণের নিশ্চিত আশ্রয়, প্রত্যয়ী আস্থা।
স্রেফ গালভরা বুলি আওড়ে এই বদল আসে না। এক্ষেত্রেও আসেনি। সুনির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদক্ষেপে প্রসৃত হয়েছে দুর্নীতিমুক্তির অম্লজান।
এই দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বলিষ্ঠতম পদক্ষেপ হল ই-গভর্ন্যান্সের সুবিধা প্রদান। গ্রাহক বা নাগরিক যদি পুর পরিষেবা অনলাইনে অর্থ দিয়ে পান, তবে তাঁকে আরও ওই কাজের জন্য দালাল ধরতে হয় না। দালাল যদি না ধরতে হয় তবে একদিকে বাঁচে অর্থ, অন্যদিকে বাঁচে সময়। সরকার নির্দিষ্ট অর্থ দিয়ে ঝটপট কলকাতার নাগরিকরা পাচ্ছেন জন্ম/মৃত্যুর শংসাপত্র, বাড়ি তৈরির ছাড়পত্র, বাড়ি তৈরির নকশার অনুমোদনপত্র, জলসংযোগের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি প্রভৃতি। সেই সঙ্গে সম্পত্তিকর, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদির জন্যও দালাল ধরার দরকার নেই। সব কিছুতেই অনলাইন ব্যবস্থা। আর সেই ব্যবস্থার দৌলতে, অন্তর্জালের ব্যবহারে মুছে গিয়েছে ‘চোরপরেশন’ নামের কলঙ্ক। পুর-প্রশাসনের ওপর নাগরিকের আস্থা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-গৃহলক্ষ্মী কার্ড প্রকাশ করে আনন্দিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জানালেন টুইটারে
কোন অভিযোগ জমা করেছেন পুর পরিষেবার বিষয়ে। সেটা কোথায় পড়ে আছে, সেই অভিযোগের ভিত্তিতে পুর প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেসব জানতে ইচ্ছুক আপনি।
কিংবা সম্পত্তিকরের বিষয়ে আপনার কোনও জিজ্ঞাসা আছে, জানতে চান ড্রেনেজ ফি সংক্রান্ত বিষয়, রেজিস্টার্ড প্লামবার বা পঞ্জীকৃত কলের মিস্ত্রিদের তালিকা দরকার আপনার।
অথবা সম্পত্তিকর বা বাড়ি-সংক্রান্ত বিবাদের ক্ষেত্রে শুনানির হালহকিকত জানতে আগ্রহী আপনি। উল্লিখিত কোনও ক্ষেত্রেই দালাল ধরার আর দরকার নেই। https://www.kmcgov.in। এই সাইটে থাকছে যাবতীয় জিজ্ঞাসার উত্তর, তাবৎ সমস্যার সমাধান। একবার কম্পিউটারের মাউস ক্লিক করলেই হল।
আরও পড়ুন-তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তেহারে কলকাতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেওয়া হল প্রধান ১০টি প্রতিশ্রুতি
কলকাতা পুরসভার প্রতীকে, একেবারে নিচে, বাঁদিকে আছে স্বস্তিক চিহ্ন। সর্বমঙ্গলের প্রতীক। তৃণমূল কংগ্রেসের কাঁধে যবে থেকে কলকাতার নাগরিক সমাজ পুরসভার দায়িত্বভার অর্পণ করেছে, তবে থেকে এই স্বস্তিক চিহ্নের যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে। এটা যে কোনও বাগাড়ম্বর নয়, তার প্রমাণ মিলেছে অতিমারির প্রহরে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে, এ-সংক্রান্ত খবর সামনে আসামাত্র কলকাতা পুরসভা ২০টি শয্যা-সমন্বিত ও ১৫টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর বিশিষ্ট সেফ হোম তৈরি করে ফেলেছিল, স্রেফ শিশুদের জন্য। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ রুখতে পুরসভার টিম বাজারগুলোকে সংক্রমণমুক্ত করার কাজে নেমে পড়েছিল, মোবাইল ক্লিনিকে কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিল, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে করেছিল, নাগরিকদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি চালু করেছিল। এ-জন্যই কলকাতায় সংক্রমণ বা সংক্রণজনিত মৃত্যু কখনও লাগামছাড়া হয়নি।
আরও পড়ুন-বৈষম্যের মেঘে ঢেকেছে আকাশ
এ শহরের আকাশে শকুন ওড়েনি, গঙ্গায় ভাসেনি মানুষের লাশ। ১ নং বরোর গোপাল চ্যাটার্জি রোড, কালীচরণ ঘোষ রোড থেকে শুরু করে ১৬ নং বরোর ক্ষুদিরাম পল্লি, জোকা কালীমন্দিরের কাছে বখরাহাট রোড পর্যন্ত সব ক’টি বরোতে শতাধিক কেন্দ্রে নাগরিকদের বিনামূল্যে কোভিশিল্ড টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিল কলকাতার পুর প্রশাসন, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে। সেজন্য, সেজন্যই তরঙ্গতাণ্ডবী মৃত্যুর লক্ষ লোল জিহ্বা অতিমারির লগ্নে এই শহরের বুকে আস্ফালন করতে পারেনি।
শহরবাসীর স্বাস্থ্য-বিষয়ে সদা সচেতন তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভা। পুরসভার হাডকো বিল্ডিংয়ে ৪,৮০০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি আধুনিক ল্যাবরেটরিতে তাই বিশ্বমানের ফুডল্যাব। এখানে বোতলবন্দি পরিশুদ্ধ জল থেকে শুরু করে প্যাকেটবন্দি ফলের রস, ভারী ধাতু, কীটনাশক, খাবার সংরক্ষণের উপাদান— সবকিছু পরীক্ষা করে দেখার বন্দোবস্ত আছে। পাশাপাশি টাইফয়েড, কলেরা, খাবারের বিষক্রিয়া-সংক্রান্ত জীবাণুর পরীক্ষাও এই গবেষণাগারে করা সম্ভব। এই বিশ্বমানের ল্যাবটিও কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের পরিচালনাধীন পুর প্রশাসন তৈরি করেছে। বুকনিসর্বস্ব বাম আমলে নয়।
আরও পড়ুন-চক্রান্ত করেই আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল
একটা সামান্য খবর। কিন্তু নিছক উড়িয়ে দেওয়ার মতো খবর নয়। সেই খবরের পরতে সংগুপ্ত অন্য উন্মোচন।
বিদেশি পর্যটক টানার ব্যাপারে দেশের সব ক’টি মেট্রো শহরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা। এই শহরে ভিনদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যান অন্তত তিনটি বিষয়কে তুলে ধরছে। এক. কলকাতার রাস্তাঘাট দিল্লি-মুম্বইয়ের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ। দুই. রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এবং তিন. গত এক দশকের নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় কলকাতা এখন দেশের বাকি মেট্রো শহরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আগে নিউ মার্কেট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটে বিদেশি পর্যটকরা শহরের অপরিচ্ছন্নতার ছবি তুলে বেড়াত। এখন তাঁরা আর সে-সুযোগ পান না। বরং আকৃষ্ট হন ঝকঝকে শহরের আকর্যক শক্তিতে।
আরও পড়ুন-কলকাতার ভোট শেষ হলে হবে অন্য পুরসভার
এই শহরের ঐতিহ্যবাহী হেরিটেজ বিল্ডিংগুলোর সংরক্ষণে মদত দিয়ে পুরসভা সেই আকর্ষণকেও নিঃসন্দেহে বিবর্ধিত করেছে। সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার করে শহরটাকে একেবারে বদলে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভা।
এই পরিচ্ছন্ন সুদৃশ্য শহরটাই এখন উন্নততর পুর-পরিষেবার বেঞ্চমার্ক। নিজেদের তৈরি বেঞ্চমার্ককে ছাপিয়ে যাওয়াটাই আগামী দিনে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত নতুন পুরবোর্ডের কাছে চ্যালেঞ্জ।
ওই যে, বলছিলাম না! বিজেপি কংগ্রেস সিপিএম— ধারেকাছে কেউ নেই। ১৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসই। উন্নত কলকাতা উন্নততর কলকাতা হওয়ার স্বপ্ন আঁকড়ে ইভিএমে বোতাম টিপবে সেদিন।
আরও পড়ুন-মোদির রাজ্যের ‘আমিষ’ কীর্তি, কে কী খাবে আপনারা ঠিক করার কে? কোর্ট
একদা সাংবাদিক বীর সাংভি লিখেছিলেন, ‘কলকাতা শহরটা সবার জন্য নয়। যদি তুমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সবুজ শহর চাও, দিল্লিতে থাক। যদি তোমার পছন্দ হয় ধনী আর নৈর্ব্যক্তিক শহর (rich and impersonal) তবে যাও মুম্বইয়ে। যদি উন্নত প্রযুক্তি (high-tech)-তে মজে মন, তবে বেঙ্গালুরুই তোমার সঠিক জায়গা। কিন্তু তুমি যদি চাও এমন এক শহর যার মন আছে, তবে এস কলকাতায়।’
তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত কলকাতা পুরসভা এই বক্তব্যটাকেই নস্যাৎ করে দিয়েছে।
এখন বলতে গেলে বলতেই হবে, যদি তুমি চাও সবুজ সতেজ উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন এক শহর যার মধ্যে আকর্ষক নৈর্ব্যক্তিকতায় লেগে থাকে মন, তবে কলকাতা তোমায় ডাকছে।