জগন্নাথ দেবধাম : ধর্ম যেথায় মেলে কর্মের সনে

আজ দিঘায় জগন্নাথ ধাম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের শুভ সূচনা। এই কেন্দ্রের তাৎপর্যের দিকটি তুলে ধরছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

“ধর্ম বিভেদ সৃষ্টি করে না, ধর্ম কর্মসংস্থান করে”— এর যথার্থতা নবনির্মিত জগন্নাথ দেবের আবির্ভাবেই স্পষ্ট। টাইমস্ ম্যাগাজিন এর একটি প্রবন্ধ পড়ে জানতে পারলাম ভারতবর্ষে কমবেশি ২০ লক্ষের ও বেশি মন্দির রয়েছে। যার মধ্যে বেশ কিছু মন্দির আছে যা সারা বিশ্বের ভক্তদের আকর্ষণ করে। তারমধ্যে রয়েছে যেমন দক্ষিণের তিরুপতি মন্দির, পশ্চিমে রয়েছে সোমনাথ মন্দির, উত্তরে রয়েছে কেদারনাথ ধাম এবং পূর্ব দিকে রয়েছে জগন্নাথ ধাম। ভারতের মন্দিরগুলি দেশের সমৃদ্ধ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যকে প্রতিফলন করে। তবে বিশ্বের মধ্যে ভারতীয়রা জানে কিভাবে আধুনিকতার যুগেও সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান এবং ধর্ম-কে সংরক্ষণ ও সর্বসমে আলিঙ্গন করতে হয়। তবে আদিযুগ থেকেই ভারতবর্ষে মন্দিরগুলোই ছিল বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং সামাজিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি এই মন্দিরের ঐতিহ্যর ওপর ভর করে বেশ কিছু স্থান তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সমৃদ্ধ করেছে, তার মধ্যে ওড়িশার নাম না করলেই নয়। ওড়িশার অর্থনৈতিক উন্নয়নে জগন্নাথ ধাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জগন্নাথ ধাম ওড়িশা তথা পূর্ব ভারতের প্রধান ধর্মীয় ও পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় প্রতি বছর হাজারো ভক্ত এই মন্দিরে তীর্থ যাত্রায় আসেন। যার ফলে ওড়িশা জুড়ে হোটেল, পরিবহন ও অনান্য ব্যবসার প্রভূত উন্নতি হয়েছে। মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সামগ্রী বিশেষ করে পূজার সামগ্রী এবং হস্ত শিল্পের বিক্রি শুধু স্থানীয় অর্থনীতিতেই নয় বরং পুরো ওড়িশার শিল্প ও বাণিজ্য মানচিত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

আরও পড়ুন-জয় জগন্নাথ! জয় বাংলা!

শুধু মন্দিরকে কেন্দ্র করে ১০০০ জনের ও বেশি সেবক নিযুক্ত আছেন। এছাড়াও নানা কর্মীর কর্মসংস্থান ও নিশ্চিত হয়েছে। এতকিছু বলার একটাই উদ্দেশ্য সেটা হল শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, হিন্দু ধর্মের সমৃদ্ধকরণ ও পর্যটন মানচিত্রে দীঘার জগন্নাথ ধাম পশ্চিমবঙ্গের দিশা আগামীদিনে যে ব্যাপক পরিবর্তন করতে চলেছে তা অনুমেয়! পশ্চিমবঙ্গ কে পর্যটনের আঁতুড়ঘর বললেও কিন্তু ভুল হবে না। প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গ সরকার পর্যটনে কোন না কোন নতুন দিশা দেখায়। ২০২৪ এ যেমন পুরুলিয়ার মুরগুমা পর্যটন কেন্দ্র, চন্দননগরের আলো পর্যটন কেন্দ্র, বাঁকুড়ার বারোঘুটু, বীরভূমের বাউল বিতান,বীরভূমের বাউল আ্যাকাডেমি, রামপুরহাট এর তারাবিতান ট্যুুরিস্ট কমপ্লেক্স, আরও কত কি। ২০২৪ এ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বরানগর গ্রামটিকে ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রক কৃষি পর্যটন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ পর্যটন গ্রাম হিসেবে পুরষ্কৃত করেছে। ইতিহাস ঘেটে জানা যায় মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনে হিন্দু তীর্থ যাত্রীদের কাছ থেকে তীর্থ কর নেওয়া হত রাজস্বের একটি অংশ হিসেবে। ১৫৬৩ সালে সম্রাট আকবর তীর্থ যাত্রী দের কাছ থেকে সেই কর আদায় বাতিল করেছিলেন যা মুঘল সাম্রাজ্যে শাসনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। কারণ রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি কমানোর অন্য কোনো পথ তাদের সামনে খোলা ছিল না। তবে এই পদক্ষেপটি শুধু কর মুকুবের ছিল না, ছিল ধর্মীয় সহনশীলতা ও সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ার অন্যতম পন্থা। আকবর মনে করতেন যে, তীর্থ যাত্রায় আসা লোকেরা ঈশ্বরের প্রতি তাদের ভক্তি ও বিশ্বাস প্রকাশ করতে আসে, তাই তাদের ওপর কর আরোপ করা উচিত নয়। বর্তমান সময়ে এই ধরনের করের ওপর কোনো ভাবেই সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা নির্ভর করে না। বরং পর্যটকদের আনাগোণার ওপর সরকারের ভাবমূর্তি এবং স্থানীয় উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে। পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে, পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩ এ আগত দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১৪.৫৭ কোটি যা ২০২৪ এর নভেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৬.৫৫ কোটি। আরও চমকপ্রদ তথ্য হল, ২০২৩ এ পশ্চিমবঙ্গে আগত আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৭ লক্ষ যা ২০২৪ এর নভেম্বর পর্যন্ত বেড়ে হয়েছিল ২৮ লক্ষ। এ এক অভূতপূর্ব সাফল্য পর্যটন মানচিত্রে। আমরা সকলেই কমবেশি জানি কেন সমুদ্র তীরে জগন্নাথ ধাম গড়ে উঠেছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সেই জন্য দীঘা-কেই উপযুক্ত স্থান মনে করেছেন জগন্নাথ ধাম গড়ে তোলার জন্য। আরও একটা বিষয় এরসাথে যোগ করে রাখা ভালো, প্রতি অমাবস্যার দিন (কৃষ্ণ পক্ষের শেষ দিন) ভগবান জগন্নাথ সমুদ্র তীরে যান মহোদধি আরতি নামে একটি বিশেষ আচার পালন করতে, কারন স্কন্ধ পুরাণ অনুসারে পবিত্র সমুদ্রকে জগন্নাথ দেবের শ্বশুর (দেবী লক্ষী জগন্নাথ দেবের স্ত্রী রুপে বিবেচিত হয়) বলে বিশ্বাস করা হয়। আর সমুদ্র ছাড়া সেই রীতি হওয়া সম্ভব ও নয়। বিষয়টি আধ্যাত্মিকতায় মোড়া থাকলেও সঙ্গতিপূর্ণ। তাই হয়তো জগন্নাথ ধাম গড়ে তোলার আদর্শ স্থান হল দীঘা। এবার আসা যাক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়নে। আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র যেখানে গড়ে ওঠে সেখানে সর্বদা পর্যটকদের ভাসমান জনসংখ্যা থাকে এবং সেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় অনান্য মধ্যম স্তরের শহরের তুলনায় তুলনামূলক বেশি হয়। অতএব দরিদ্রসীমার স্তর স্বাভাবিক ভাবেই অনান্য স্থানের তুলনায় একটু উঁচুতেই থাকে। অর্থাৎ দীঘার আশেপাশের এলাকার মানুষজনের জীবনযাত্রার মান যে উন্নত হবে সে বিষয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু ধর্মের মিলনক্ষেত্র তৈরি করেই খান্ত থাকেন নি, কর্মসংস্থান এর দিশাও যেমন দেখিয়েছেন তেমনি বাঙালির ঐতিহ্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার ব্যবস্থাও করেছেন। বিশ্ববাংলার জগন্নাথ ধাম পর্যটন ব্যবসায় যে বিপ্লব আনতে চলেছে তা সর্বজন একবাক্যে স্বীকার করবে। আনুষঙ্গিক কিছু দিক, পুরীর খাঁজা-তে যেমন বহু পর্যটকের রসনা তৃপ্তি হয়, ঠিক তেমনভাবে বাঙালিদের প্রিয় মিষ্টি প্যারা সন্দেশ ও গঁজা কে জগন্নাথ দেবের প্রসাদ এর তালিকায় রেখে বাঙালিয়ানার ভরপুর স্বাদ-কে মিষ্টি প্রেমীদের কাছে তুলেও ধরলেন। এর ফলে মিষ্টি ব্যবসায়ে যে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে সে বিষয়ে কিন্তু কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। মাননীয়া শুধু এখানেই থেমে থাকেননি পুরীর ধ্বজা অনুকরণে স্টলও দীঘায় থাকছে এবং পুরী থেকে কারিগর এনে প্রথম দিকে সেই স্টলগুলি পরিচালিত হবে, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মানুষজনও যাতে ধ্বজা তৈরি করতে পারেন তার ও ব্যবস্থা করা হবে। কদিন আগেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ধজ্জ্বা চিলে নিয়ে গিয়ে আভাস দিয়েছিল জগন্নাথ দেবের নতুন ঠিকানার। তবে ঈশ্বর বা আলহার অধিষ্ঠান কখনোই মন্দির বা মসজিদে আবদ্ধ থাকতে পারে না। কর্মেই ঈশ্বরের বাস। সুতরাং দীঘার মন্দির শুধু আধ্যাত্মিকতার ধারক রুপে পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত হবে তা কিন্তু নয়, ধর্মের মহা মিলনক্ষেত্র রুপেও সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে উঠে আসবে তা শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। কয়েকটা লাইনে তবে শেষটা করি—
“ধর্ম যেখানে গুণ গায়
নুন সেখানেই সৃষ্টি হয়,
বিভেদ করে মানুষ জন্ম
ব্যর্থতায় শুধু ঢেকে যায়”।

Latest article