সংখ্যায় হয়তো কমেছে, তবে এখনও শহর কলকাতায় বসে হাট। কয়েকটি হাট বসে মধ্যরাতেও। স্বচ্ছন্দে চলে কেনাবেচা। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে কিছু হাট নিয়েছে বাজারের চেহারা। রাতের হাট-বাজারে বিক্রি হয় মূলত নানারকমের পোশাক। ব্র্যান্ডেড নয়, লোকাল কোম্পানির। সেইসঙ্গে বিক্রি হয় শাক-সবজি, ফল, মাছ, মশলাপাতি। পাইকারি এবং খুচরো। শপিংমলের ঔজ্জ্বল্য নেই। আছে আন্তরিকতা। ভেসে বেড়ায় পুরনো শহরের গন্ধ, গুঁড়ো গুঁড়ো গল্প। পুরুষরা তো বটেই, মহিলাদেরও দেখা যায় ক্রেতা-বিক্রেতার ভূমিকায়।
আরও পড়ুন-
হরি সাহার হাট
উত্তর কলকাতায় খান্না মোড়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোড এবং গ্রে স্ট্রিটের সংযোগস্থল। শনিবার এবং মঙ্গলবার মধ্যরাতে গিয়ে দেখা যায়, চারদিক লোকারণ্য। বসেছে জমজমাট হাট। গমগম করছে চারদিক। চলছে কেনাবেচা। এটাই হল হরিদাস সাহার হাট বা হরি সাহার হাট। লোকমুখে ‘হরিসা হাট’। মোড়ের মাথায় বিভিন্ন মনীষীর মূর্তির ফ্রেসকো দেওয়া যে বাড়িটি রয়েছে, সেখানেই হরিদাস সাহার তত্ত্বাবধানে শুরু হয়েছিল এই হাটটি। কলকাতার তৈরি পোশাকের সবচেয়ে সস্তা এবং বৃহত্তম পাইকারি বাজারগুলির মধ্যে এটা অন্যতম। বর্তমানে হরি সাহার হাটের পরিধি ফড়িয়া পুকুরের দিকে যাওয়ার রাস্তার মাঝামাঝি, পাশের দীনেন্দ্রনাথ স্ট্রিট পর্যন্ত ছড়িয়েছে। হাট বসে রাত ১০টায়। চলে ভোর পর্যন্ত। ভিড় দেখলে চমকে যেতে হয়। দূরদূরান্ত থেকে বিক্রেতারা আসেন। বসিরহাট, ক্যানিং এবং বনগাঁ থেকে। বিক্রি করেন নানারকমের পোশাক। কেউ কেউ নিজেদের তৈরি পোশাক বিক্রি করেন, কেউ বিক্রি করেন বড়বাজার, খিদিরপুর মার্কেট, শান্তিপুর, ফুলিয়া, সমুদ্রগড়, দত্তপুকুর থেকে সস্তায় কেনা জামাকাপড়। ব্র্যান্ডেড পোশাক একেবারেই পাওয়া যায় না। সস্তার লোকাল কোম্পানির জিনিসের চাহিদাই এখানে বেশি। জিএসটি লাগে না। শাড়ি, ব্লাউজ, চুড়িদার, নাইটি, জামা, প্যান্ট, লুঙ্গি প্রভৃতি পাওয়া যায়। সিজন অনুযায়ী হয় জিনিসের বদল। দারুণ ভিড় জমে পয়লা বৈশাখ, দুর্গাপুজো, ইদের আগে। শীতের মরশুমে পাওয়া যায় গরম পোশাক। শাল, সোয়েটার ইত্যাদি। হাটে সারারাত দোকানদারি করে বিক্রেতারা বাড়ি ফিরে যান ভোরের বেলা। হরি সাহার হাটে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মেয়েরাও আসেন। কেউ জিনিসপত্র বিক্রি করতে, কেউ কিনতে। প্রায় একশো বছরের পুরনো এই হাটে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ভিড় বেশি চোখে পড়ে। মূলত ডজন ধরে জিনিস কিনতে হয়। ইদানীং খুচরোও বিক্রি হচ্ছে। কেনাবেচা হয় নগদ টাকায়। স্থানীয় ক্রেতাদের ভিড় বেশি দেখা যায়। আসেন দূরের মানুষেরাও। শুধু বাংলা নয়, ওড়িশা, অসম, বিহার থেকেও ক্রেতারা আসেন এই হাটে। শপিংমল বা অনলাইনে নানারকম পোশাক পাওয়া গেলেও, আজও কিন্তু কলকাতার ঐতিহ্যবাহী হরি সাহার হাটের গুরুত্ব কমেনি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। ধীরে ধীরে নিয়েছে বাজারের চেহারা।
লিবার্টি ফুটপাথ হাট
পুরনো জামাকাপড়ের ফুটপাথ হাট। এখন অবশ্য বাজার। বসে শেষ রাতে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে লিবার্টি সিনেমার ফুটপাথে। লোকমুখে পরিচিত ‘লিবার্টি ফুটপাথ হাট’ নামে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় চলে বেচাকেনা। শহর ঠিকঠাক ব্যস্ত হয়ে ওঠার আগেই গুটিয়ে নেওয়া হয় পাততাড়ি। পাওয়া যায় অল্পবিস্তর ছেঁড়া-তালি মারা— রিফু করা পোশাক। পুরনো জামাকাপড় ছাড়াও কেজি দরে বিক্রি হয় ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো। এগুলো নাকি কারখানার মেশিনপত্র মোছার কাজে লাগে। স্থানীয়রাই এই হাটের ক্রেতা। মূলত নিম্ন মধ্যবিত্তরা। পুরুষদের সঙ্গে আসেন মহিলাও। বড়দের হাত ধরে ছোটরা। কেনাকাটা সেরে ভোরের আলো ফোটার আগেই বাড়ি।
আরও পড়ুন-২৩ বছর ধরে মামলা, গুজরাত হাইকোর্টের বিস্ফোরক পর্যবেক্ষণ, মোদির পুলিশের কারণেই ভয়ঙ্কর গোধরা
সরকার হাট
বেহালা চৌরাস্তার মোড় থেকে বাস অথবা অটোয় মিনিট সাতেকের পথ। পৌঁছে যাওয়া যায় সরকার হাটে। সরশুনা মেইন রোডে। বাসস্টপের নামকরণও হাটের নামেই। প্রতি শুক্রবার বিকেলে নিয়মিত বসে এই হাট। চলে রাত পর্যন্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বড়িশার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবারের আমলে এবং প্রত্যক্ষ সহায়তায় সূচনা। হাটের বাইরেটা মনিহারি-প্রসাধনী দ্রব্য ও টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকান দিয়ে ঘেরা। এর মাঝখানে যে-কোনও গলি দিয়ে সেঁধিয়ে গেলেই হাটের মাঠ। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে, হাঁকডাকে জমজমাট। পাওয়া যায় নানারকমের জিনিস। মূলত শাকসবজি। কেনাকাটা করা যায় প্রাণ খুলে। ভিড় জমে ক্রেতা ও বিক্রেতার।
চোরবাজার হাট
পার্ক সার্কাস, মল্লিকবাজার আর শিয়ালদহ বউবাজারের মোড়ে, পুরনো শার্ট-প্যান্ট-ঘড়ি-জুতো-কাঠের ফার্নিচার— এরকম আরও অনেক বিকিকিনির পশরা নিয়ে বসে চোরবাজার হাট। জমে ওঠে রাতের দিকে। গমগম করে। গলিতে গলিতে জ্বলে অল্প পাওয়ারের আলো। দোকানে দোকানে বিক্রি হয় শার্ট-প্যান্ট-পালিশ করা পুরনো জুতো-ঘড়ি ইত্যাদি। নাম চোরবাজার বা চোরাবাজার। তবে এই বাজারের জিনিসপত্র চোরাই কি না জানা নেই। ভিড় জমে বহু মানুষের। কাছেই আছে খাবারের দোকান। কেনাকাটা করতে করতে খিদে পেলে খেয়ে নেওয়া যায়। রোল, বিরিয়ানি, পরোটা, কষা মাংস। চোরবাজার কিন্তু আজও এক উদ্দাম সময়ের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। এই বাজার জানে শহরের অনেককিছু।
পোদ্দার কোর্টের হাট
কলকাতার টেরিটি বাজারের উল্টো ফুটে পোদ্দার কোর্ট। তার ঠিক পিছনে প্রতিদিন শেষ রাত থেকে চালু হয় দোকানপাট। গুটোতে গুটোতে সাড়ে সাতটা-আটটা। তিন-চার ঘণ্টার হাট।
ফুটপাথের ওপর রঙিন ছাতার নিচে বা খোলা আকাশের তলায় বিক্রি হয় গরম ধোঁয়া-ওঠা চিকেন-ফিশ-পর্ক স্যুপ। কন্টেনারে ভাপ ছড়ানো মোমো, পর্ক ডাম্পলিঙ, চিকেন বান, সুইন কর্ন আর এক্লেয়ার নুডল স্যুপ। দারুণ সুস্বাদু আর অবিশ্বাস্য রকম সস্তা। এখান থেকে দু’কুড়ি গজ দূরে কলকাতার আরও দুই ল্যান্ডমার্ক— পও চং আর নান কিং। প্রথমটি সসের দোকান। সস না বলে চিনা রান্নায় যা যা লাগে, সেই সমস্ত রকম উপকরণ-বিপণি বলাই ভাল। বয়স দেড়শো ছুঁই-ছুঁই। এই দোকানে পাওয়া যায় চিলি-গার্লিক-টোম্যাটো সস আর পিউরি, চাইনিজ কুকিং ওয়াইন ও হার্বস ইত্যাদি চিনা রান্নার উপকরণ। পও চংয়ের উল্টো ফুটে একটু দূরেই ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে নান কিং। শহরের প্রথম চিনে রেস্তোরাঁ। যখন গড়পড়তা বাঙালি গণহারে চাউমিন-চিলিচিকেন খেতে শেখেনি, এলাকারই এক প্রবীণ সহনাগরিক হংম্যান বলছিলেন ঠাকুর পরিবারের অনেকেরই প্রিয় খাবার জায়গা ছিল এই নান কিং। পোদ্দার কোর্টের এই হাট যুগ যুগ ধরে শহরের খাদ্যপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে চলেছে।
আরও পড়ুন-মাদ্রাসায় মেয়েদের ম্যাজিক
কোলে মার্কেট
পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় পাইকারি সবজি ও ফলের বাজার কোলে মার্কেট। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে অবস্থিত। চব্বিশ ঘণ্টা এই বাজারে বেচাকেনা চলে। দিন থেকে রাত। গমগম করে মধ্য রাতেও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানেই কাজের খোঁজে আসেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। এখানে থেকেই বাংলা এবং পূর্ব ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় সবজি ও ফল। জানা যায়, বিগত শতাব্দীর একেবারে গোড়ায় নফর কোলের ছেলে ভূতনাথ কোলে এই বাজার স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের পদবি আজও এই বাজার বহন করে চলেছে। নফরবাবুর বাজার বলে মূল ফটকে লেখা থাকলেও লোকমুখে কোলে মার্কেট নামেই চলে আসছে। পাইকারি বাজার বলতে যা বোঝায়, সেটাই এই কোলে মার্কেট। আলু, পেঁয়াজ, রসুন, কপি, পান, লেবু, টমেটো ইত্যকার হাজার রকম পণ্য বিক্রি হয়। আগে কয়াল বা মাপদাররা এখানে দাঁড়িপাল্লায় ওজন করেই মাল দিত ক্রেতাকে। এখন দাঁড়িপাল্লার জায়গায় অনেক দোকানে ইলেকট্রনিক ওজনযন্ত্র বসেছে। কয়ালদের কথা এখনকার নাগরিক বাঙালি ভুলে গেছে। কেউ কেউ বলেন, কোলে মার্কেট আসলে ছিল কয়ালের মার্কেট। পরে লোকমুখের বিকৃত উচ্চারণে হয়ে গেল ‘কোয়ালে মার্কেট’ তথা কোলে মার্কেট। শোনা যায়, একটা সময় এটা ছিল হাট। পরবর্তী সময়ে পাইকারি বাজারে পরিণত হয়েছে।
মঙ্গলা হাট
কলকাতার যমজ শহর হাওড়া। এই শহরে প্রায় তিনশো বছর ধরে বসছে মঙ্গলা হাট। এশিয়ার বৃহত্তম বাজার। যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয় ও সচল। এত প্রাচীন এবং আকারে বৃহৎ বাজার বা হাট পৃথিবীর আর কোথাও বসে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও মঙ্গলবার দু’দিন বসে এই হাট। দিন থেকে রাত। এখানে মূলত পোশাক কেনাবেচা হয়। বাংলার পাশাপাশি ভিন রাজ্য থেকে প্রচুর বিক্রেতা ও ক্রেতা আসেন। লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে বিশাল এলাকা জুড়ে কয়েক হাজার ছোট-বড় দোকান। মঙ্গলা হাটের জনপ্রিয়তা এতটাই যে, বিভিন্ন জেলায় পৃথক পোশাকের বাজার গড়ে উঠলেও এর জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বরং দিন দিন বেচাকেনার পরিমাণ বাড়ছে। এখানে পাইকারির পাশাপাশি খুচরো বেচাকেনাও হয়। শুধু যে পোশাক-ব্যবসায়ীরা আসেন, তা নয়। বহু সাধারণ মানুষও এখানে প্রয়োজনীয় শাড়ি, জামা, প্যান্ট কেনার জন্য আসেন। নদিয়ার শান্তিপুরের ফুলিয়ার বিখ্যাত শাড়ি উৎপাদকেরা এই মঙ্গলা হাটে পাইকারি দরে তাঁদের তৈরি অসামান্য সব শাড়ি বিক্রি করেন। পাতি ছাপা শাড়ি, থান কাপড় থেকে শুরু করে বেনারসি, স্বর্ণকাতান, টাঙ্গাইল, কাঞ্জিভরম— সবকিছু পাওয়া যায়। সোমবার ভোরে হাটে দোকান দেওয়া বা শাড়ি কেনার জন্য রবিবার রাতেই বহু দোকানদার ও ক্রেতা চলে আসেন। মূলত শেষ রাত বা ভোরের দিকে পাইকারি কেনাবেচা হয়। বেলা বাড়লে, বিশেষত মঙ্গলবার সারাদিন খুচরো খরিদ্দার এসে প্রয়োজনীয় পোশাক কেনেন। মূলত সড়ক ও সুগম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা মঙ্গলা হাটের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।