একে তো বিশ্বসুন্দরী, তার উপর আবার দেখা মেলাই দুষ্কর, নাম তার মন্দারিন হাঁস (Mandarin Duck)। জানতে খুব ইচ্ছে করে, ‘হাঁস রে হাঁস/ কোথায় যাস?/ কোথায় বাড়ি/ কোথায় ঘর/ বাড়ি কি তোর তেপান্তর?’
— তেপান্তরেরই বটে; বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এই মন্দারিন হাঁস পূর্ব এশিয়ার আদি বাসিন্দা। চিন, জাপান, কোরিয়া ও রাশিয়ার মতো দেশে এদের অধিকাংশ সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে বছর দুয়েক আগে পূর্ব আসামের তিনসুকিয়া জেলার অন্তর্গত মাগুরি মোটাপাঙ্গ জলাভূমিতে এদের একজনকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
গোটা বিশ্বের মধ্যে রাশিয়া ও চিনে প্রায় এক হাজার জোড়া মতো এই মন্দারিন হাঁসের (Mandarin Duck) দেখা মেলে; বর্তমানে জাপানে একক ভাবে সর্বাধিক প্রায় পাঁচ হাজার জোড়ার বেশি লক্ষণীয় এই বিশেষ হংস। এশিয়া মহাদেশের বাইরে এই হাঁস গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, আইল অফ ম্যান, ফ্রান্স ও রোমান সাম্রাজ্যের মতো পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে প্রায় সাত হাজার জোড়ার দেখা পাওয়া গেছে।
মাঝারি আকারের এই অতীব সুন্দরী হাঁসগুলো অ্যানিমালিয়া রাজ্যের, এভিস শ্রেণির, অ্যানিটিডিয়া পরিবারের, আইক্স গণের অন্তর্ভুক্ত পরিযায়ী শ্রেণির একধরনের পাখি জাতীয় প্রাণী। অনেকেই মনে করেন যেহেতু চিন দেশের মানুষেরা মন্দারিন ভাষায় কথা বলেন তাই এর নাম মন্দারিন হাঁস, আবার কেউ মন্দারিন বলতে এশিয়া মহাদেশের বিচিত্র রঙের বন্যপ্রাণীদের কথা উল্লেখ করেন। তবে মন্দারিন হাঁস (Mandarin Duck) তার রঙিন সৌন্দর্যের জন্য বিশ্ববন্দিত তাতে কোনও সন্দেহই নেই। এই প্রজাতির হাঁসগুলো লম্বায় প্রায় ৪১-৪৯ সেন্টিমিটার এবং ডানাগুলো ৬৫-৭৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।
অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের তুলনায় মন্দারিন হাঁস একটু লাজুক প্রকৃতির হয় এবং এরা সবসময় গাছ কিংবা গুল্ম জাতীয় ঝোপঝাড়ের পাশে আশ্রয় নিতে পছন্দ করে। প্রায় সময়ই এরা ছোট ছোট দল করে থাকতে ভালবাসে। সচরাচর ঘন ও ঝোপঝাড়যুক্ত জঙ্গলে, নিম্ন সমতল ভূমি অঞ্চলে, হ্রদ ও নদীর পাড়ে, কখনও কখনও উঁচু উপত্যকায়, শীতের সময় বন্যাগ্রস্ত জমিতে, খোলা জলাভূমিতে ও এমনকী পার্বত্য খাঁড়িতেও বসবাস করে। বছরের এপ্রিল-মে মাস নাগাদ এরা ডিম পাড়ে, একসাথে প্রায় ৯-১২টা এবং তারপর নির্দিষ্ট সময় পর ডিম ফুটে বাচ্চা হয়।
মন্দারিন হাঁস পুরুষ ও স্ত্রী দুই প্রকারের হয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হাঁসের চোখের উপর দিয়ে একটি সাদা অর্ধচন্দ্র দেখা যায়, মুখ লাল হয়, একটি লাল রঙের হুন্ডি থাকে। স্ত্রী হাঁসের ক্ষেত্রে একটি সাদা চক্ষুবলয় দেখা যায়, চোখের পিছন থেকে সারা দেহে সাদা ফিতের মতো দাগ থাকে, হুন্ডি বিবর্ণ হয়। তবে এদের মধ্যে পুরুষ মন্দারিন হাঁসের বক্ষদেশ বেগুনি রঙের হয়ে থাকে।
১৯০২ সালের পর প্রায় ১১৮ বছর বাদে ভারতবর্ষে এই বিশেষ প্রজাতির হাঁসের দেখা পাওয়া পরিবেশগত দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধরনের মন্দারিন হাঁস প্রথম ১৭৫৮ সালে সুইডেনের উদ্ভিদবিদ, শারীরবিদ ও প্রাণীবিদ জনাব কার্ল লিনিয়াস চিহ্নিত করেছিলেন। এর বিজ্ঞান সম্মত নাম হলো আইক্স গ্যালেরিকুলাটা। আইক্স একটি প্রাচীন গ্রিক শব্দ যা অ্যারিস্টটল অজানা ডুবুরী পাখি নির্দেশ করতে ব্যবহার করেছিলেন এবং গ্যালেরিকুলাটা একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ ডানা অর্থাৎ আইক্স গ্যালেরিকুলাটা হল ডানাযুক্ত জলজ পাখি অর্থাৎ হাঁস।
আন্তর্জাতিক সংরক্ষণ তৎপরতার নিরিখে আইইউসিএন তালিকায় এটি কম গুরুত্বপূর্ণ (লিস্ট কনসার্ন) হলেও এদের একটির দেখা পাওয়া খুবই দুষ্কর; তাই গুরুত্বপূর্ণও যথেষ্ট। বর্তমানে এরা বিভিন্ন ধরনের হিংস্র জন্তু জানোয়ারের কবলে পড়ে এদের অস্তিত্বের উপর সংকট তৈরি হয়েছে, শিকারিদের অত্যাচার ও প্রাকৃতিক বাসস্থানের ক্ষতিসাধন এদের উপর বিপদ ডেকে আনছে। মানুষ এদের মাংসের জন্য এদের শিকার করে না, এদের আকর্ষণীয় সৌন্দর্য এদের বিপদের কারণ।
তবে সাংস্কৃতিক ভাবে চিন, জাপান ও কোরিয়ার মতো দেশে এদের গুরুত্ব খুব বেশি। ওইসব দেশের প্রথা অনুযায়ী মন্দারিন হাঁস দীর্ঘ, শান্তিপূর্ণ ও প্রেমময় দাম্পত্য জীবনের প্রতীক। এই হাঁস যুগল পরিবারের শান্তি, আনুগত্য, সুসন্তান ও সুখের দূত হিসেবে পালিত ওই ওই সব দেশে। তাই এরা শুধু পরিবেশগত ও প্রকৃতি অনুসারেই নয় সামাজিক গত দিক দিয়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আজকে নানা সব কারণে প্রাকৃতিক বাসস্থানের ক্ষতিসাধনের দরুন এই বিশেষ ধরনের হাঁসগুলোকে পরিযায়ী হয়ে বাঁচতে হচ্ছে। আমাদের সর্বস্তরের উচিত প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা এবং পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রকে চাঙ্গা করে তোলা। ভারতবর্ষের বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির মত অনুযায়ী উচ্চ অসামের ডিব্রু সাইখোয়া জাতীয় উদ্যানের নিকট মাগুরি মোটাপাঙ্গ জলাভূমি অঞ্চল একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষী বিচরণ স্থান। এখানেই বছর দেড়েক আগে মন্দারিন হাঁসের দেখা পাওয়া গিয়েছিল; এটি বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও আশাপ্রদ একটি বিষয়।
হাঁসের মতো প্রাণীরা পরিবেশ ও মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে কৃষির উপকার করে। হাঁসের গোবর মাটির উর্বরতা বাড়ায়, যা কৃষির জন্য উপকারী। এছাড়া, হাঁস জলজ উদ্ভিদের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং জলাশয়ের জল পরিষ্কার রাখতে ভূমিকা পালন করে। মানুষ হাঁস পালন করে ডিম ও মাংসের জন্য, যা পুষ্টির চাহিদা পূরণে সহায়ক। পাশাপাশি, হাঁসের পালক বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়। এরা পরিবেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই তাদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ প্রয়োজন।
আমরা এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আমাদেরই দায়িত্ব বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণের খেয়াল রাখা— তা সে কোন হাঁস, মুরগির প্রাণ হোক কিংবা কোনও কীটপতঙ্গের। বড় অদ্ভুত এই বাস্তুতন্ত্রের মিথষ্ক্রিয়া— সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। সবসময় মনে রাখতে হবে, পরিবেশে ক্ষুদ্র প্রাণীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পোকামাকড়, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং অন্যান্য অণুজীবরা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে। তারা জৈব পদার্থ বিচ্ছিন্ন করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়, পরাগ-আয়নের মাধ্যমে গাছপালার প্রজনন নিশ্চিত করে এবং খাদ্যশৃঙ্খলে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষুদ্র প্রাণী বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া, কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধেও সহায়ক। এদের অনুপস্থিতি বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে। তাই ক্ষুদ্র প্রাণীদের সংরক্ষণ করা আমাদের পরিবেশ রক্ষার জন্য অপরিহার্য।
আরও পড়ুন: জলাধার বন্ধ করে পাকমুখী চেনাবের জল রুখল ভারত