ভারতে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। এই বৃদ্ধির হার যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ছাত্রছাত্রীদের আত্মহত্যার হারটি দেশে সাধারণভাবে আত্মহত্যার হার এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এক কথায়, পড়ুয়াদের আত্মহত্যা ভারত জুড়ে এক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। দেশে আত্মহত্যা বৃদ্ধির সার্বিক হার যেখানে ২ শতাংশ সেখানে সংখ্যাটি পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে ৪! ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার সব খবর সরকারিভাবে রিপোর্ট করা হয় না। সংখ্যাটি তার পরেও জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ! সব খবর নথিবদ্ধ হলে ছবিটা যে আরও হৃদয়বিদারকই হত, সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন-রাবাংলার হাতছানি
মেয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যা বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ। গত এক দশকে ০-২৪ বর্ষীয় তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ৫৮ কোটি ২০ লক্ষ থেকে কমে হয়েছে ৫৮ কোটি ১০ লক্ষের মতো। অথচ ওই সময়ে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মঘাতী হওয়ার প্রবণতা বাড়তে বাড়তে মৃতের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ। ৬,৬৫৪ থেকে ১৩,০৪৪।
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশে।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও মনের মতো রেজাল্ট হয় না সকলের। এই ধাক্কা সইতে না-পেরে কিছু পড়ুয়া আত্মঘাতী হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে সবচেয়ে দুর্নাম ছড়িয়ে পড়েছে রাজস্থানের ‘কোচিং হাব’ কোটার। কিন্তু জাতীয় স্তরেও তাদের র্যাংক অনেক নিচে— দশম। তাই শুধু একটা কোটার দিকে নজর রেখে বাকি জায়গাগুলি সম্পর্কে উদাসীন বা নিশ্চিন্ত হওয়ার সুযোগ যে মোটেই নেই।
শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কিছু মানুষ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই অপূরণীয় ক্ষতি কেবল কিছু পরিবারের নয়, গোটা সমাজের এবং সারা দেশের। এর পিছনে শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের অবনমন মূলত দায়ী। অথচ মোদি সরকার শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি অনুসন্ধান করে তাকে সময়োপযোগী করে তোলার ব্যাপারে উদাসীন। তাই শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সদিচ্ছা তাদের নেই।
মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে খরচ করার পরামর্শ দিয়েছে এনইপি ২০২০। কিন্তু এবারের (২০২৫-২৬) কেন্দ্রীয় বাজেটে শিক্ষামন্ত্রকের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ১,২৮,৬৫০ কোটি টাকা। বোঝাই যাচ্ছে, গলদটা কোথায়। টাকার অঙ্কটা বড়সড় দেখালেও তা জিডিপির ৬ শতাংশের ধারেকাছেও নয়, এবং শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির হার গত চারবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
স্কুলছুটের শতাংশ হার (প্রাথমিকে ১.৯, উচ্চতর প্রাথমিকে ৫.২ এবং মাধ্যমিকে ১৪.১) এখনও মারাত্মক। একা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী, সবুজ সাথী, মিড মিল দিয়ে এই ফারাক ঘোচাতে পারবে না। শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ দ্রুত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বাড়াতেই হবে। গোড়ার গলদ দূর না-হলে বিশ্বসেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ভারতের উজ্জ্বল উপস্থিতির স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
এখানে দুটো উদাহরণের কথা বলা দরকার।
আরও পড়ুন-ইডেন জুড়ে জয়ধ্বনি, কার্যত বিদায় নাইটদের
প্রথম উদাহরণ, পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল। বাম আমলে এখানে এমন ত্রাসের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল যে, তাতে আক্ষরিক অর্থেই লাটে উঠেছিল সাধারণ মানুষের রুটিরুজি। নিজের গ্রামে এবং ঘরে থাকাই দায় তখন। স্কুল-পাঠশালায় যাতায়াত ভুলতে বসেছিল ছোট ছেলেমেয়েরা। ২০১১ থেকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক আন্তরিক উদ্যোগে সেখানে শান্তি ফিরতেই ছবিটা দ্রুত বদলে গিয়েছে। বেড়েছে চাষ-আবাদ, ব্যবসাপত্তর। আয় বেড়েছে নারী, পুরুষ উভয়েরই। আসছে নতুন বড় শিল্পও। জঙ্গলমহলের ছেলেমেয়েরা শুধু স্কুলেই যাচ্ছে না, তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় ভাল ফলও করছে।
আর একটি উদাহরণ অবশ্য এ রাজ্যের নয়। কর্নাটকের। কয়েক দিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো কর্নাটকের দশম শ্রেণির পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ফল প্রকাশ হতেই দেখা গিয়েছে কর্নাটকের বাগালকোটের বাসিন্দা এক পড়ুয়া অনুত্তীর্ণ হয়েছে। স্থানীয় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ওই পড়ুয়ার নাম অভিষেক চোলাচাগুড্ডা। ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় মাত্র ৩২ শতাংশ নম্বর পেয়েছে অভিষেক। তবে, অনুত্তীর্ণ হলেও ছেলেকে উৎসাহ দিতে নানা আয়োজন করে পরিবার। কেক কাটা, মিষ্টি খাওয়ানোর পর্ব চলে বাড়িতে।
অভিষেকের বাবা-মায়ের বক্তব্য, ‘এই পরীক্ষায় ও হয়তো অসফল হয়েছে। তবে জীবনের পরীক্ষায় ফেল করেনি। আগামী পরীক্ষাতে পরিশ্রম করে নিশ্চয়ই সফল হবে। আমরা সব সময় ওর পাশে রয়েছি।’ মা-বাবার এই উদ্যোগে খুশি অভিষেকও। তাঁর কথায়, ‘পরীক্ষায় ফেল করার পরেও গোটা পরিবার যে ভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি খুশি। আমি পরের বছর ফের পরীক্ষায় বসব। নিশ্চয়ই সফল হব।’
তাহলে জাতীয় মানব সম্পদের সংরক্ষণের জন্য দ্বিবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে সরকারকে শিক্ষা খাতে ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর পাশে বাড়ির লোকদের থাকাটা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই ভাল থাকবে আমাদের আগামী।