মধ্যরাতের সেনা অভিযানের পর গতকাল দুপুরে কর্নেল সোফিয়া কুরেশি, পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি, উইং কমান্ডার ভ্যামিকা সিং প্রেস কনফারেন্স করে অপারেশন ডিটেলস ব্রিফ করা দেখতে দেখতে আমার ভারতীয় পরিচয়টা যেন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। আজন্মলালিত বিশ্বাসটা আরও একবার পোক্ত হল যে আমার দেশ তার ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ খোয়াতে পারে না।
সম্প্রতি পহেলগাঁও অ্যাটাকের পর থেকেই ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি খুল্লামখুল্লা ঘৃণার বিষ উগরে দেওয়া দেখে মনে মনে বেশ শঙ্কা হচ্ছিল তবে কি ধর্মান্ধ মৌলবাদী অন্ধকারের ছায়া এদেশের মানুষের মনকেও ঘিরে ফেলছে ধীরে ধীরে?
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই স্পষ্ট দেখা যায় পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই হিন্দু মহাসভা যা বর্তমানে বিজেপি আরএসএসের মোড়কে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্য পূরণে রাজনৈতিক কূটকৌশলের পাশাপাশি মিডিয়াকে ব্যবহার করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। উদ্দেশ্য একটাই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব সংকট সৃষ্টি করা।
অথচ গান্ধীর দেশে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনাও থাকা উচিত ছিল না। কারণ দেশভাগের পর স্বয়ং তিনিই বলেছিলেন, ‘সকল হিন্দু, মুসলিম, শিখ, পার্সি, খ্রিস্টান এবং ইহুদি যারা এই দেশের মানুষ, এদেশে তাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার আছে। কেউ যাতে বলতে না পারে ভারত শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠদের। কেউ যেন সংখ্যালঘুদের অসম্মান করার কথা বলতে না পারে।’
নেহরু, প্যাটেল শেষ নিঃশ্বাস অবধি সর্বতো চেষ্টা ছিল এদেশ ধারণ করবে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী চরিত্র। হিন্দুগরিষ্ঠ জনসংখ্যা হলেও সকল ধর্মের, জাতির মানুষের অধিকার রক্ষিত করা হবে সমানভাবে। আমাদের সংবিধানও সেইভাবেই লেখা হয়েছে।
এমনকী বিজেপির সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশকে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে নিয়েছিলেন যা ভারতীয় রাজনীতি এবং সামাজিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। মণ্ডল কমিশনের সুপারিশেই ১৯৯০ সালে ওবিসিদের জন্য ২৭% সরকারি চাকরি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পরের নির্বাচনে উনি হেরে গেলেও সংখ্যালঘুদের অধিকার আইনি সুরক্ষা পেয়েছিল বলেই আজ তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরির কিছু সুযোগ-সুবিধা নিতে পারছে। নাহলে এই ২০২৫ সালেও মুসলিম পিটিয়ে মেরে ফেলার খবর তো রোজই দেখছি।
সারা বিশ্ব জুড়ে দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারের উদাহরণ ভূরি ভূরি। যে কারণেই সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রসংঘের আইন রয়েছে। যে আইনে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ তার নির্ধারিত সীমার মধ্যে বসবাস করা ধর্মীয়, ভাষাগত, জনগোষ্ঠীগত, সংস্কৃতিগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থকে রক্ষা করবে এবং তাদের উন্নতির পথে সহায়তা করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি যে আইন শুধু বইয়ের পাতাতেই লেখা হয়েছে। সবার মনে জায়গা পায়নি। ঘৃণার দৃষ্টিকে ভালবাসা জয় করতে পারেনি।
এই না পারার কারণটা লজ্জাজনক হলেও এদেশের সংখ্যাগুরু জনগণের একাংশকে আজও ধর্ম জাতের হিড়িক তুলে মোহগ্রস্ত করে রাখার মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতার রাজনীতি। যাকে হাওয়া দিয়ে ধোঁয়া জোগানো চলে সগৌরবে। অথচ এই মাটি তো দেশভাগে রক্তাক্ত হয়েছিল বলেই শপথ গ্রহণ করেছিল বিবিধের মাঝে মিলন মহান হয়ে থাকার, সংবিধান প্রণীত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার সেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পালাবদলের কুটিলতা দিনে দিনে এমন কুৎসিত চেহারা নিল যে কুর্সির ক্ষমতা দখল জাতপাত, ধর্মের তাস খেলা থেকে বিরত থাকতে পারল না।
আরও পড়ুন-রামগড় BSF ক্যাম্পে পাক-ড্রোন হানা, গুলি করে নামাল ভারতীয় সেনা
স্বাধীনতার আগে থেকেই যে কংগ্রেস নেতৃত্ব নেহরু প্যাটেল আম্বেদকরের আদর্শ মেনে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখত ধর্মকে সেই কংগ্রেসেরই প্রধানমন্ত্রী বন্ধ রামমন্দিরের দরজা খুলে দিয়ে ধর্মীয় রাজনীতিকে জায়গা করে দিয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়াটা যেমন ছিল সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার আস্ফালন। তেমনি পরবর্তীতে ওই স্থানেই রামমন্দির গড়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণা তাচ্ছিল্যের বার্তাটাই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে প্রবলভাবে।
আমরা সকলেই জানি দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় মুসলিমদের ভূমিকা ছিল সর্বাত্মক। আর আজ তাদের দেশপ্রেমের ধারণাকে ভুলিয়ে দিতেই উগ্রতার বীজকে বুনে দেওয়া হচ্ছে লাগাতার। এমনকী সংখ্যালঘুদের অধিকারের কথা বললেই দাগিয়ে দেওয়া হয় দেশবিরোধী তকমায়। দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষ নেয় না কেন্দ্রীয় রোষের ভয়ে।
একমাত্র ব্যতিক্রম আমাদের বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গোটা দেশের রাজনৈতিক নেতারা যেখানে মাথা নত করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে বিজেপির আগ্রাসনের সামনে সেখানে সিংহগর্জনের মতো তাঁর রাজনীতি সর্বধর্ম সমন্বয়কে আগলে রেখেই উচ্চকিত হয় বাংলা জুড়ে। তাঁর কাছে ধর্ম জাতির উপর স্থান পেয়েছে মানুষ। সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু ভেদাভেদের কথা কখনও তিনি রাজনৈতিক হাতিয়ার করেননি। বাংলার মেয়ে তো তাই বাংলার চিরাচরিত সকলের তরে সকলে আমরা এই ভাবধারাতেই বড় হয়েছেন। শ্রেণি সম্প্রদায় নয় মানুষের বিপদে তিনি ছুটে চলেন আজও বাংলার পথে প্রান্তরে। বিজেপির বিভেদের রাজনীতি তাঁকে ছুঁতেও পারে না।
আমার দীর্ঘকাল সাংবাদিকতা এবং বর্তমান কাজের সূত্রে বাংলার অলিগলি নিয়মিত ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, যে কেউ তাঁর কাজের ক্ষেত্রে সমালোচনা করতে পারেন। রাজ্য পরিচালনায় ভুল ধরতে পারেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার মাপকাঠিতে তাঁকে ফেলতে পারবেন না। ধর্মান্ধ ক্ষমতালোভীদের কুৎসা, কটূক্তির ঊর্ধ্বে তিনি তাঁর রাজনৈতিক মননকে এমন একটি জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন যেখানে শুধুই মানুষের কোলাহল শোনা যায়। আর তাই আগামী ছাব্বিশের নির্বাচনেও এই মানুষই মমতাকে জেতাবে।
ভারত জুড়ে বিজেপির বিজয়রথ আবারও মুখ থুবড়ে এই বাংলাতেই পড়বে। কারণ রবীন্দ্র-নজরুলের এই বাংলার মাটিতে কেউ কোনওদিন হিন্দু কিংবা মুসলিম হয়নি। এখানে জাতপাত ধর্মের নামে অধর্মের জাল বোনা যায় না। বাঙালি হিন্দু-মুসলিম হাতে হাত রেখে দুর্গাপুজো করে। ইদের আলিঙ্গন নেয়। বাংলা বুক ফুলিয়ে বাঁচে ধর্ম যার যার উৎসব সবার…এই মেজাজে।
এই বাংলার সুর যে দেশেরই সুর তা আজ আমার দেশবাসীর হৃদয়ে দেখতে পাচ্ছি। এই যে দেশের সামনে এক সংকটের সময় উপস্থিত হয়েছে দেখুন চারপাশের ঘৃণার কারবারিরা সব কর্পূরের মতো উবে গেছে। গোটা দেশ এক হয়েছে… ভুলে গেছে কে হিন্দু কেই বা মুসলমান?? এই একটাই মাত্র কারণে ভারতবাসী পরিচয়টা বারবার গর্বিত করে। যুগযুগ ধরে আঘাতে জর্জরিত একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দেশটা যে ধর্ম, ভাষা, জাতির বিভিন্নতায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে বিশ্বের দরবারে। বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যকে যেভাবে ভারতবাসী ধরে রেখেছে তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে বিস্ময়কর চর্চার বিষয়।
বাবরের দেখা সেই ভারতবর্ষ আজ কয়েকশো বছর পরও বিজেপির নানা নামের হিন্দুরক্ষা বাহিনীর ভারত থেকে মুসলমান মুছে দেবার হুমকিগুলো শুনে অতীত ইতিহাসও বোধয় মুচকি হাসে। আর তাই প্রবল মোদিহাওয়া দিল্লির মসনদে দশ বছর পূর্ণ করে ফেললেও ভারতবর্ষের চিরকালীন ঐতিহ্যকে কোনমতেই ধ্বংস করতে পারে না। কারণ দিনের শেষে ভারতবর্ষের গনতন্ত্রকে উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে রাখতে সোফিয়া কুরেশিদেরই কিন্তু কুর্নিশ করে দেশবাসী।