মীরজাফর
২০২১ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী তথা নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা ব্রাত্য বসু। তাঁর ‘মীরজাফর ও অন্যান্য নাটক’ বইয়ের জন্য। এই বইয়ে রয়েছে যথাক্রমে ‘একদিন আলাদিন’, ‘আমি অনুকূলদা আর ওরা’ এবং ‘মীরজাফর’ নামের তিনটি নাটক।
‘মীরজাফর’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র মীরজাফর। সিরাজ-উদ-দৌল্লার সঙ্গে পলাশির যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাঁকে হত্যা করে তিনি সবেমাত্র মুর্শিদাবাদের তখতে বসেন। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়টুকু এই নাটকের সময়কাল। ক্লাইভ কীভাবে রক্ষা করার নামে মীরজাফরকে দোহন করে চলেন, কীভাবে খনি, খাজনা, তাঁত হয়ে বাংলার অর্থনীতির স্তম্ভগুলো বাগিয়ে নেন, মীরজাফরের ছেলে মীরন কীভাবে সিরাজের বংশ নির্বংশ করতে উঠে পড়ে লাগেন, মীরজাফরের জামাতা মীরকাশিম কীভাবে বেইমানি করেন তাঁর শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে এবং সবশেষে কীভাবে তাঁরা একে একে মারা যান— এইসবই ইতিহাসের পাতা থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরা হয়েছে নাটকে।
‘মীরজাফর’ মঞ্চস্থ করেছে কালিন্দী ব্রাত্যজন। ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায়। নামভূমিকায় ছিলেন গৌতম হালদার। ব্রাত্য বসু অভিনয় করেন ক্লাইভের চরিত্রে। নাটকটি কলকাতার রবীন্দ্র সদনে দেখার সুযোগ হয়েছিল। নাট্যমেলায়। অনবদ্য প্রযোজনা। দীর্ঘ সময় ধরেই সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছে। লাভ করেছে দর্শকপ্রিয়তা। পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি দল কাজ করেছে নাটকটি নিয়ে।
৭ মে, ‘মীরজাফর’ নাটকটি মঞ্চস্থ হল কলকাতার গিরিশ মঞ্চে। এডুকেশান ডাইরেকটরেট কালচারাল ইউনিটের প্রযোজনায়। শিবাশিস মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়। নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন নির্দেশক। তাঁর দাপুটে অভিনয় সমবেত দর্শকমণ্ডলীর প্রশংসা অর্জন করে৷ মীরনের চরিত্রে সুখেন্দু সেনগুপ্ত এবং লুৎফুন্নেসার চরিত্রে কাকলী মৈত্রর অভিনয়ও ছিল নজরকাড়া৷ ক্লাইভ এবং ওয়াটস এই দুই সাহেবের চরিত্রে জ্যোতি বসু এবং সুমন্ত পাল ইতিহাসের পাতা থেকে যেন দর্শকের সামনে নেমে এসেছিলেন৷
নাটকের শেষেও চমক অপেক্ষা করেছিল দর্শকদের জন্য৷ নাটককার ব্রাত্য বসুকে মঞ্চে ডেকে নেন নির্দেশক৷ ব্রাত্য বসু মূল্যবান বক্তব্য রাখেন৷ আলো, আবহ ও মঞ্চনির্মাণের দায়িত্বে থাকা উত্তীয় জানা, কৌশিক সজ্জন এবং মদন হলদারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সংস্থার পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধিত করা হয়৷
সুন্দরবন বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাদাবন। বাঘ, কুমির, সাপ, হরিণ। গভীর জঙ্গল, নদী, প্রতিকূলতার সঙ্গে মানুষের লড়াই-সহ একাধিক ছবি। সেইসব প্রান্তিক এলাকার মানুষের জীবনযুদ্ধের গল্প নিয়ে ৮ মে, মঞ্চস্থ হল উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের নাটক অবলম্বনে ‘বেহুলা এখন’। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়দিঘির শ্রীধরপুর গ্রামে, মণি নদীর পাড়ে খেলার মাঠে। সৌমিত্র মিত্র-র ভাবনা, সংলাপ ও নির্দেশনায়। পূর্ব পশ্চিমের প্রযোজনায়। মুক্তি-র সহযোগিতায়। প্রধান রূপকার এবং কর্মশালা পরিচালক ছিলেন দেবব্রত মাইতি। অভিনয়ে সুন্দরবনের শ্রীধরপুর গ্রামের অধিবাসী, মুক্তি-র স্বেচ্ছাসেবক এবং পূর্ব পশ্চিমের অভিনেতারা। জল-জঙ্গল অঞ্চলের মানুষেরা প্রত্যক্ষ করলেন এক অসাধারণ নাট্য-প্রযোজনা।
আরও পড়ুন-খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে জরুরি বৈঠক করলেন গৌতম
মনসামঙ্গল কাব্যের আধারে সুন্দরবনের বর্তমান পরিস্থিতিকে নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা, শিশু নির্যাতন রোধ, পরিবেশ রক্ষার বার্তা। স্থানীয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে কৃষক, মৌলে, ঘরামি, মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। তাঁদের প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে। বাঘ, কুমিরের সঙ্গে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন প্রত্যেকেই। তাঁদের অভিনয় মন ছুঁয়ে গেছে।
মঞ্চসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে গামছা, কুলো, তালপাতার পাখা ইত্যাদি। প্রচলিত লোকগানের পাশাপাশি এমন কিছু লোকগানের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে, যা তৈরি হয়েছে এলাকায় বসেই। সুর দিয়েছেন এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন দীপেন ভট্টাচার্য। আবহে সন্দীপ ভট্টাচার্য। সহকারী প্রধান রূপকার অরূপরতন গঙ্গোপাধ্যায়।
সুন্দরবনের গ্রামে-গঞ্জে সাপে কাটলেই প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। সেই কুসংস্কার দূর করতেই মঞ্চে বেহুলা চরিত্রের অবতারণা। কথিত আছে, চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দরকে বাসরঘরে সাপে কাটলে এই সুন্দরবনের নেতিধোপানির ঘাট হয়েই বিভিন্ন নদীপথে বেহুলা স্বর্গে পৌঁছন, স্বামীর প্রাণভিক্ষার জন্য। সেই দৃশ্য দেখানো হয়েছে নাটকে। পাশাপাশি বার্তা দেওয়া হয়েছে, সাপে কাটলে ওঝার কাছে নয়, যেতে হবে চিকিৎসকের কাছে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়েছে এই নাটক। গ্রামের মেয়ে সগর্বে বাবাকে জানায়, সে এখন বিয়ে করতে চায় না, ফুটবল খেলতে চায়। চাঁদ, সনকা, বেহুলা, লখিন্দর চরিত্রগুলো নেমে এসেছে মাটির কাছাকাছি। মিশে গেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। নাটকের মূল উদ্দেশ্য, জনসাধারণকে নানা বিষয়ে সচেতন করা। সেই উদ্দেশ্যে তাঁরা যে সফল, বলার অপেক্ষা রাখে না।
নির্দেশক সৌমিত্র মিত্র জানিয়েছেন, স্থানীয় ২৬ জনকে আমরা বেছে নিয়েছিলাম অভিনয়ের জন্য। তাঁদের নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দেখে আমি মুগ্ধ। প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে দিনের পর দিন হয়েছে মহড়া। আমরা চাই এখানকার বেহুলারা সমসাময়িক জীবনে প্রকৃতই নারী হয়ে উঠুক। প্রান্তিক নারীরও ক্ষমতায়ন হোক। আশা করি কলকাতার নাট্যোৎসবেও নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। অভিনয় করবেন এই গ্রামের মানুষেরাই।