ইতিহাস বইয়ে নেতাজি কোথায় ?

নেতাজি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধী ছিলেন। তাই কি তিনি পাঠ্যক্রমে প্রায় অনালোচিত? তথাকথিত সর্বভারতীয় পাঠ্যক্রমে ‘নেতাজি’র অবদানের সংক্ষিপ্ত আলোচনা রয়েছে। এই উপেক্ষার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন স্কুলছাত্রী শ্রেয়সী রাউৎ

Must read

সাম্প্রতিককালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, সারা ভারতে, সব কটি রাজ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর করার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার কোনও অবকাশ নেই।
সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদ কেন এক্ষেত্রে বলবৎ হবে না, সেটা অনুধাবন করতে হলে আইনি প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যক। সেই গভীরতা, পরিণত মনস্কতা ও শিক্ষা সামর্থ্য আমার নেই। তবে, একজন ছাত্রী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তথাকথিত সর্বভারতীয় বোর্ডগুলোর পাঠ্যক্রমে যেভাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মহান দেশপ্রেমী আলোচিত ও উপেক্ষিত হন, কেবল সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি দেখলে, ইতিহাস ও সমাজ বিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কেন তথাকথিত জাতীয় শিক্ষানীতি একটি পরিত্যাজ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু (Netaji) ছিলেন প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতন্ত্রী এবং আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাবের ধারক। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে ছিল মানবতা, জাতি ভেদ নয়। আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণা দিয়েই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ধর্ম, বর্ণ, জাতির ভেদাভেদ ছাড়িয়ে সকল ভারতবাসী এক ছাতার নিচে এসে দেশকে স্বাধীন করার জন্য লড়বে। কিন্তু আজকের দিল্লির শাসকদের আদর্শ অনেকটাই এই মূল্যবোধের বিপরীতমুখী, আমাদের ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে কতটা ‘হিন্দুত্ববাদের’ প্রবর্তক ও সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের ঘৃণা, তাদের প্রতি অনীহা কিন্তু ভারতবাসীর চোখ এড়ায়নি। এটা কোথাও গিয়ে নেতাজির মতাদর্শের সঙ্গে কোনও ভাবেই মেলে না। তাই বোধহয় তথাকথিত সর্বভারতীয় বোর্ডগুলোর সিলেবাসে নেতাজি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হন না!
তিন হাজার ভারতীয় সৈন্যকে নিয়ে নেতাজির গড়ে তোলা আজাদ হিন্দ বাহিনীতে তিনি প্রথমেই এমন একটা দারুণ কাজ করে ফেলেন যা আজকের দিনেও আমাদের অবাক করে। তিনি বলেছিলেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ যে যাই হোক না কেন সকলে একসঙ্গে খেতে বসবে, সবাই সবাইকে নিজের মনে করবে, একসঙ্গে থাকবে। তাদের পারস্পরিক সম্বোধনে ‘নমস্কার’, ‘সেলাম আলাইকুম’ কিংবা ‘জয় শ্রীরাম’ নয়, বলা হবে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ উচ্চারণ ‘জয় হিন্দ’।
আজ যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন, ইতিহাসের পুনর্লিখন, এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেখানে নেতাজির সমন্বয়বাদী ও প্রগতিশীল আদর্শ যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
এই আদর্শগত ফারাকের জন্যই হয়ত আজকের ভারতবর্ষে পাঠ্যপুস্তকে নেতাজিকে ‘সীমিত’ রাখা হয়। কারণ একজন নেতাজি যদি পুরো দাপট নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে আসেন, তবে তিনি কেবল ব্রিটিশ বিরোধী নেতাই হবেন না— তিনি হয়ে উঠবেন এক জীবন্ত চেতনার প্রতিবিম্ব, যে বর্তমান শাসকের ভ্রান্তিগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। নেতাজির দর্শন, ভাষণ ও অবস্থান যদি খুঁটিয়ে দেখা যায়, তাহলে এটা স্পষ্ট হয়— তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদ, সাম্প্রদায়িকতা বা বিভাজনমূলক রাজনীতির একেবারে বিরুদ্ধে ছিলেন। এটাই আজকের শাসক শ্রেণির জন্য অস্বস্তির জায়গা।

নেতাজি (Netaji) সবসময়ই বিশ্বাস করতেন, ভারতের মুক্তির পথ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সর্বধর্ম সমন্বয়ের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান—সব ধর্মের মানুষেরা একসঙ্গে লড়াই করেছিলেন এবং তিনি একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমরা এমন একটি ভারত গড়তে চাই, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, শিখ— সবাই সমান অধিকার পাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ধর্মকে রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তিবিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, ব্যক্তি হিসেবে মানুষ যে ধর্ম পছন্দ করে তাহা অনুসরণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকিবে, কিন্তু ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়। ইহা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধু অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচার-বুদ্ধির দ্বারা’।
এই আদর্শ বর্তমান উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঠিক বিপরীত। এখন তো ধর্মের ভিত্তিতে জাতীয়তা নির্ধারণ করাটাই দস্তুর।
আমাদের বর্তমান বিজেপি হল ভারতীয় জনসংঘের ধারাবাহিক উত্তরসূরি, আর শ্যামাপ্রসাদ সেই ধারা ও চিন্তার আদিপুরুষ। বিজেপি তাঁকে তাদের আদর্শ ও পথপ্রদর্শক মনে করে। অনেক বক্তৃতা ও নির্বাচনী প্রচারে তাঁকে ‘বিজেপি-র আদ্যপুরুষ’ বলেও অভিহিত করা হয়।
শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার সদস্য, যিনি নেতাজির (Netaji) সঙ্গে একাধিকবার আদর্শগত বিরোধে জড়িয়েছেন। নেতাজি কলকাতায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে শ্যামাপ্রসাদের নিয়োগের বিরুদ্ধে ছিলেন, তখন থেকেই তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। নেতাজির মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের জায়গা নেই।
নেতাজি কট্টর হিন্দু মহাসভার ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য ক্ষতিকর মনে করতেন। তিনি সর্বদা একটি inclusive secular India-র স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে কোনও ধর্মের আধিপত্য থাকবে না।
এই আদর্শগত অবস্থানগুলো বর্তমান শাসক দলের ইতিহাস-বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আজ যেভাবে পাঠ্যক্রমে ইতিহাসকে পুনর্লিখন করা হচ্ছে, তাতে এমন একজন নেতা যিনি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও একচেটিয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাঁকে একদম সামনে নিয়ে আসা শাসকদের নিজস্ব রাজনীতির জন্য অস্বস্তিকর। তাই তাঁর গল্প হয় ‘ছোট্ট অনুচ্ছেদে’ গুম করে দেওয়া হয়, নয়তো ‘ঐতিহাসিক বিতর্ক’ বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।
মনে করিয়ে দিই, কোনও অভিযোগ ছাড়াই ১৯৩২ সালের শুরুতেই ব্রিটিশ সরকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে মান্দালয় জেলে পাঠিয়েছিল এবং তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতিতে তাঁকে অস্ট্রিয়ায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেই অস্ট্রিয়াতেই তিনি গড়ে তোলেন ‘অস্ট্রিও-ভারতীয় সমিতি’, প্রতিষ্ঠা করেন ‘চেক ভারত সমিতি’। কে না জানে, তিনি হিটলারের কাছেও হাত বাড়িয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’— যেখানে হিটলার মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে, আর সেই মিত্রশক্তির এক প্রভাবশালী সদস্য ছিল ব্রিটেন, ভারতের তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক। মনে করিয়ে দিই, ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সহযোগী আবিদ হাসানের সাথে, ব্রিটিশ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতে, জার্মান থেকে টোকিও পর্যন্ত সেই রোমাঞ্চকর, দুর্গম এবং ভয়াবহ সাবমেরিন যাত্রার কথা। কতজন জানেন যে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম ভারতীয় যিনি সাবমেরিন যাত্রা করেছিলেন?
ইতিহাস পড়ানো হয় যাতে পূর্বের ভুলগুলো দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি না হয়— কিন্তু এহেন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর জানার ক্ষেত্রে শেখার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা টেনে দেয় আমার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। একজন নেতার প্রকৃত মূল্যায়ন হয় তাঁর আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের আলোকে, না যে রাজনৈতিক পক্ষ তাঁর পাশে ছিল। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন এমন একজন বীর, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে জাতিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। অথচ আজকের পাঠ্যক্রমে তাঁর সেই অসামান্য আত্মত্যাগ যেন নীরবে গুম হয়ে গেছে কিছু সংখ্যক পাতার মধ্যে। ইতিহাস কেবল কীর্তির দলিল নয়— এটি একটি জাতির চেতনাকে নির্মাণ করে।
নেতাজি মনে করতেন, লড়াই শুধু নিজের ভূখণ্ডে বসে করলেই হবে না— এই লড়াইকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে হবে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে, সিঙ্গাপুর থেকে বার্লিন— তাঁর মতন করে কে ছুটেছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। আর যতদিন তা না থাকবে, ততদিন ইতিহাসের একটি বড় অধ্যায় থাকবে অন্ধকারে।

আরও পড়ুন-প্রতিহিংসা শেষপর্যন্ত আওয়ামি লিগকে নিষিদ্ধই ঘোষণা করল ইউনুসের সরকার

Latest article