গৌতম বুদ্ধের দর্শন ও রাবীন্দ্রিক ভাবনা

মহাকারুণিক তথাগতের একটি বিখ্যাত শিক্ষা হল শত্রুতার দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায় না। মিত্রতা দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায়। অক্রোধ দ্বারা ক্রোধকে জয় করা যায়। সত্য দ্বারা মিথ্যাকে জয় করা যায়। এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ করেছিলেন। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

গৌতম বুদ্ধকে ‘অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব’ হিসাবে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দেশে বা দেশের বাইরে যখন অসহিষ্ণুতা, হিংসার আবহ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, তখন গৌতম বুদ্ধ (gautam buddha), অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে সেই ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মানব’-এর শরণাপন্ন হওয়ার বোধ হয় এটাই আদর্শ সময়। আজও পৃথিবীর বহু দেশ, বহু অঞ্চল তাঁর পদানত, কিন্তু এ জন্য তাঁকে কোনও তরবারি ব্যবহার করতে হয়নি। এই জয় আইডিয়ার জয়, দর্শনের দিগ্বিজয়। পৃথিবীতে এর আগে বহু দিগ্বিজয় হয়েছে, রামচন্দ্র থেকে পঞ্চপাণ্ডব অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়েছেন। কিন্তু মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য কাষায় বস্ত্র পরিহিত, মুণ্ডিতমস্তক শ্রমণদের দিগ্বিজয় এই প্রথম। এখন নেপালে জন্মালে, তিন দশকের বেশি সময় ধরে বিহার উত্তরপ্রদেশে ঘুরে বেড়ালে, এই দিগ্বিজয়ীর হাতে হয়তো থাকত কালাশনিকভ। কিন্তু তিনি তো সময়ের হাতে বন্দি নন। নইলে তাঁর কয়েক হাজার বছর পরে জন্মেও ভারতের সংবিধান-প্রণেতা অম্বেডকর কেন আশ্রয় খুঁজবেন বৌদ্ধধর্মে? মায়ানমার থেকে তাইল্যান্ড, চিন, জাপান হয়ে ইংল্যান্ড, আমেরিকাতেই বা কেন তিনি হয়ে উঠবেন মানুষের প্রেরণা! শুধু দেশ নয়, কালও সেই দিগ্বিজয়ীর অধীনে।
হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান যাঁর হাতে, সেই শঙ্করাচার্য প্রবল বুদ্ধ-বিরোধী হয়েও, কখনও বুদ্ধের তত্ত্বের বাইরে বেরোতে পারলেন না। বোধিবৃক্ষের নিচে বুদ্ধ আকাঙ্ক্ষা বা তৃষ্ণাকেই দুঃখের কারণ জেনেছিলেন। বহু পরে শঙ্করাচার্য তাঁর গীতাভাষ্যেও বৌদ্ধ তৃষ্ণা শব্দটি নিয়ে এলেন। বিদ্রোহী সন্তানের সঙ্গে লড়তে না পেরে, জাঁদরেল হিন্দুধর্ম শেষকালে তাকে মেনে নিতে বাধ্য হল। বুদ্ধ না জন্মালে হিন্দুধর্ম আজকের চেহারায় আসে না।
বুদ্ধ জানিয়েছিলেন অনন্য এক দার্শনিক সিদ্ধান্ত, ‘কর্মমাত্রেই খারাপ নয়। কর্ম মানে মানসিক উদ্দেশ্য।’ হিংসা, চুরি, ব্যাভিচার যদি কুকর্ম হয়, তার বিপরীতে অবিহিংসা, চুরি না করা, অব্যাভিচারের মতো সুকর্মও আছে। কর্ম মানে মানসিক উদ্দেশ্য— কথাটা এর পর মহাকাব্য থেকে হিন্দু নিয়ম, সবেতে ঢুকে পড়বে। মাংসবিক্রেতা ব্যাধও ঋষিকে ধর্ম শিখিয়ে দেবে। মনুসংহিতা বলবে : পরদ্রব্যের অভিলাষ, কুপথ অবলম্বন, অন্যের অনিষ্টচিন্তা— এই তিন রকম মানসিক কর্মই পাপ।
এক ভিক্ষু তাঁকে আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘এত দিন সংঘে থাকলাম, এখনও আপনি স্পষ্ট ভাবে জানালেন না, ঈশ্বর আছেন কি নেই।’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘মনে করো, বিষাক্ত তিরে বিদ্ধ হয়েছে এক জন। তুমি তাকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে। সে বলল, না, তিরটা কোন দিক থেকে এল, কে মারল, সে মোটা না রোগা, ফরসা না কালো, আগে জানতে হবে। তার পর ওষুধ খাব। লোকটি সেক্ষেত্রে আর বাঁচবে না। তাই ঈশ্বর আছেন কি নেই, তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। দুঃখবিদ্ধ লোকটির যন্ত্রণার উপশমই আমার প্রতিপাদ্য।’ ভিক্ষুর ফের প্রশ্ন, ‘তা হলে আপনার ধর্মমত সম্বন্ধে লোকে প্রশ্ন করলে কী বলব? সবই অনিত্য এবং দুঃখ?’ এ বার হাসলেন তিনি, ‘আমি তোমাদের একটা সেতু দিয়েছি। দুঃখের নদী পার হওয়ার জন্য। নদী পেরিয়ে গেলে সেতুটাকে আর মাথায় নিয়ে বইবার দরকার কী?’ এতটা উদার কোনও ধর্মগুরু আছেন, ‘মামেকং শরণং ব্রজ’-র দেশে?
নির্বাণের পথে অপার মৈত্রী ও করুণার চর্চায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা এই বুদ্ধ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মননে প্রতিনিয়ত বিচরণ করেছেন ঋদ্ধিময় আলোকনে। সেই আলোক উৎসের ঝরনাধারাতেই কখনো কখনো রবীন্দ্র রচনা হয়েছে কিরীটময়। লুম্বিনীর কাঠগোলাপের ছায়ায় মহাকারুণিক তথাগতের শেষ মানবজন্মে আগমনের আগে জগতের দুঃখময়তা, দুঃখের কারণ ও দুঃখের নিরোধের বিষয়ে অজ্ঞ ছিল মানুষ। পরম শিক্ষক, অপার করুণাঘন গৌতমই দুঃখ জয়ে, দুঃখ মুক্তির সোপান হিসেবে নির্দেশ করেছেন নির্বাণ। মানবমুক্তির ইতিহাসে গৌতমের (gautam buddha) অনন্য আলোকনপ্রাপ্তির ইতিবৃত্ত রবীন্দ্র-মনন-সরোবরেও তৈরি করেছে প্রজ্ঞা-তরঙ্গ।
‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তরতর হে’ বলে রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধিক মনন ঋদ্ধ হয়ে অন্তরের ভেতরের নাথের স্মরণ নিয়েছেন। এ নাথ কোনও স্রষ্টা নয়, এ নাথ কোনও দেবতা নয়। এ নাথ সেই অনন্য আলোকনের অপরূপ বিভূতি, যার সন্ধান মেলে গৌতম বুদ্ধের ভাবনায়। অন্তহীন মৈত্রীর আধার বুদ্ধ বলেছেন, মাতা যেমন স্বীয় একমাত্র পুত্রকে নিজের আয়ু দিয়ে রক্ষা করে তেমনি জগতের সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রী পোষণ করবে। এই বুদ্ধবাণী যেন সর্বদা রবীন্দ্রমননে করুণার ফল্গুধারা তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ তাই রাজর্ষি উপন্যাসে পশুবলির বিরুদ্ধে, রক্তপাতের বিরুদ্ধে, অহেতুক প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে রাজা বীর চন্দ্র মাণিক্যকে জাগ্রত করেছেন। তিনি রাজা হয়েও তাই ঋষি, যেমন শাক্যপুত্র গৌতম, যিনি রাজপুত্র হয়েও সন্ন্যাসী, ভিক্ষুজীবনের মহান ব্রতী।
বৌদ্ধিক মননে আপ্লুত রবীন্দ্রনাথ ‘প্রার্থনা’ কবিতায় লিখেছেন,
‘……। হেনকালে জ্বলি উঠে বজ্রাগ্নি সমান
চিত্তে তাঁর দিব্যমূর্তি, সেই বীর রাজার কুমার
বাসনারে বলি দিয়া, বিসর্জিয়া সর্ব আপনার
বর্তমান কাল হতে নিষ্ক্রমিলা নিত্যকাল মাঝে
অনন্ত তপস্যা বহি মানুষের উদ্ধারের কাজে
অহমিকা বন্দিশালা হতে। —ভগবান বুদ্ধ তুমি,
নির্দয় এ লোকালয়, এ ‘ক্ষেত্রেই তব জন্মভূমি।’
মহাকারুণিক তথাগতের একটি বিখ্যাত শিক্ষা হল শত্রুতার দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায় না। মিত্রতা দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায়। অক্রোধ দ্বারা ক্রোধকে জয় করা যায়। সত্য দ্বারা মিথ্যাকে জয় করা যায়। এই শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ আত্মস্থ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’, রচিত হয়েছিল বুদ্ধের স্মরণে ১৯৩৩ সালে বুদ্ধ জন্মোৎসব উপলক্ষে। আরও একটি গান রবীন্দ্রনাথ লেখেন, বুদ্ধদেব (gautam buddha) স্মরণে,
“সকল কলুষ-তামসহর
জয় হোক তব জয়,
অমৃত বারি সিঞ্চন কর’
নিখিল ভূবনময়।…”
রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য বিশ্বমনীষা, এক আশ্চর্য মানবপ্রতিভা। মহাকারুণিকের প্রতি তাঁর অনন্য ভক্তি, অনন্য নিবেদন তার মননের উদারতা ও অসাধারণত্বকে প্রস্ফুটিত করেছে কল্লোলময়তায় মহামৈত্রীর উদ্বোধন ঘটিয়ে।
এ-কথাটি অনস্বীকার্য।

আরও পড়ুন-অসমে শক্তি বৃদ্ধি তৃণমূলের: ৫টি পঞ্চায়েত আসনে জয়, অভিনন্দন অভিষেকের

Latest article