তুঝে সব কুছ পাতা মেরি মা। মায়েরা সব বোঝে। ফোনের ওপার থেকে আমার গলা শুনেই বুঝে যায় আমার মনে কী চলছে। মুখ দেখে বুঝে যায় সারাদিন খাওয়া হয়নি। দরজা দিয়ে ঢুকলেই ধরে ফেলে অফিসে বেজায় চাপ। কিন্তু মা কি সারাজীবন আমাদের আগলে রাখতে পারে? জীবনে কত লড়াই একাই তো করতে হয়। বিশেষ করে কর্পোরেট জগতে। সেখানে টার্গেট অ্যাচিভ করতে প্রতিনিয়ত নাভিশ্বাস ওঠে কর্মীদের। না করতে পারলে ‘বস’-এর কথার প্রহার। পান থেকে চুন খসলে অপমান। কর্মচারীর পারিবারিক পরিস্থিতি, তাঁর মনের খবর ক’জন বস বা মালিক রাখেন! তাঁদের কাছে পারফরমেন্সটাই শেষ কথা। ভাল কাজের প্রশংসাও নেই আবার ভুলের ক্ষমাও নেই। বসের কাছে সোম থেকে রবি, দিন থেকে রাত অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস— বসকে না বলতে শিখলে সমূহ বিপদ।
আচ্ছা ধরুন এহেন পরিস্থিতিতে একদিন দেখলেন আপনার মা অফিসে ঠিক আপনার পাশের চেয়ারটিতে এসে বসলেন। তিনি এবার থেকে আপনার সঙ্গেই কাজ করবেন? তখন কী হবে ভেবে দেখেছেন? হয়তো দেখলেন এই মা-ই একদিন আপনারই বস হয়ে গেল। তা হলে কী হত? তাহলে হয়তো অফিসের পরিবেশটাই বদলে যেত। হার্ডকোর কর্পোরেট অফিসেও লাগত কোমলতার স্পর্শ। সদ্যমুক্তিপ্রাপ্ত শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায়ের ছবি ‘আমার বস’ (Aamar Boss) দেখতে বসলে এমনই অনেক প্রশ্নের এবং ভাবনার মুখোমুখি হবেন আপনি। মনের অলীক ইচ্ছেগুলো নতুন করে উসকে উঠবে। ছবিটা দেখতে দেখতে মনেই হবে প্রত্যেক অফিসেই যদি এরকমটা একটি মা থাকত!
‘রবিবার ছুটির দিনেও কাজ! টক্সিক বসকে না বলতে শিখুন’। ‘আমার বস’ মুক্তির আগে ছবির পোস্টারে এমনই একটা বার্তা দিয়েছিলেন পরিচালক-জুটি শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়। শিবপ্রসাদ তাঁদের এই ছবির প্রোমোশনে একটা অভিনব উদ্যোগও নিয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর টিম ‘আমার বস’ (Aamar Boss) মিলে সুকুমার রায়ের কালজয়ী ‘গন্ধবিচার’ কবিতাটি একসঙ্গে পাঠ করেছেন ভিডিওতে। যেটা ভাইরাল এবং বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। আসলে আমার বস-এর প্রেক্ষাপট এটাই। একটি কর্পোরেট অফিস, যেখানে বস রাজা আর তার মন্ত্রিপরিষদ তাঁর কর্মচারীরা।
ছ্যাঁচড়াপুরের ‘বহুরূপী’ ব্যাঙ্ক ডাকাত এবার ‘আমার বস’-এ (Aamar Boss) টক্সিক বসের ভূমিকায়। পরিচালক শিবপ্রসাদ কতটা দক্ষ অভিনেতা আবারও একবার তা প্রমাণ করলেন। ছবির অনবদ্য কাহিনি এবং চিত্রনাট্য নন্দিতা রায়ের। এই ছবিটা সম্পর্কে সম্প্রতি পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় খুব সুন্দর বলেছেন— ‘ছবিটা ৯৮% মানুষের মনে মধ্যে গেঁথে থাকবে, তার কারণ আমরা প্রায় সকলেই কমবেশি ভিকটিম। এটা অধিকাংশ নাগরিকের বায়োপিক।’
আরও পড়ুন-চেন্নাইতে কড়া বার্তা স্বরূপের, বাংলাই পথ দেখাচ্ছে কলাকুশলীদের প্রতিবাদে
কী আছে গল্পে? একটি বই প্রকাশনা সংস্থার বেশ কড়া বস অনিমেষ গোস্বামী। অনিমেষ নিজের কাজে খুবই দক্ষ। কর্মচারীদের ভাল কাজের প্রশংসা তো কোনও দিন করেনই না বরং পান থেকে চুন খসলে তাঁদের ছেড়ে কথা বলেন না, রেগে কাঁই হয়ে যান। তাঁদের ওপর ছড়ি ঘোরানোটাই অনিমেষের কাজ, এর সঙ্গে সময়মতো অফিসে না এলেই চটে যান। এমনকী চাকরি থাকবে না, অন্য চাকরি দেখে নেবার হুমকিও দিয়ে থাকেন। অনিমেষের ব্যক্তিগত জীবনেও বেশ চাপ। স্ত্রী মৌসুমির সঙ্গেও সম্পর্ক ঠিক নেই। তাঁদের দুজনের লাইফ-স্টাইল এক্কেবারে আলাদা। দিনের শেষে তাই মা শুভ্রা গোস্বামী তাঁর একমাত্র আরামের জায়গা। মায়ের কাছে তিনি সেই ছোট লাড্ডুই (অনিমেষের ডাকনাম) রয়ে গেছেন। তাই জরুরি মিটিংয়ের মাঝেই দুম করে ফোন করে ট্যাক্সি ডাকতে বলে ফেলেন শুভ্রা। ছেলে যেন শুধু তারই ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ছেলের সঙ্গে মায়ের অদ্ভুত রসায়ন। বয়স হলেও ছেলের ওপর মিঠেল দাপট ধরে রেখেছেন। আবার মাকে ছোট্ট শিশুর মতো বুঝিয়েসুঝিয়ে ঠান্ডা করতে অনিমেষই পারেন। ওয়ান ফাইন মর্নিং শুভ্রা একপ্রকার জোর করেই ঢুকে পড়লেন ছেলের অফিসে। কোনও ওজর আপত্তি ধোপে টিকল না। কখনও ট্রেনি কর্মচারী, কখনও আবার প্রুফ রিডার হয়ে কাজ সামলালেন এবং একটা সময় শুভ্রা হয়ে উঠলেন অনিমেষেরই বস! অফিসের যে কর্মচারীরা রাগী অনিমেষের কারণে সারাক্ষণ তটস্থ, তাঁদের বন্ধু হয়ে উঠলেন শুভ্রা। কর্মচারীদের ওপর অনিমেষের হম্বিতম্বির মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তাঁর মা। কর্মচারীদের চাপমুক্ত করে শান্তির বাতাবরণ নিয়ে এলেন তিনি। এই পর্যন্তও ঠিকই ছিল সব। কিন্তু গোল বাধল অফিসের-ই একটা ফ্লোরে কর্মীদের বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের জন্য ক্রেশ খুলে বসলেন শুভ্রা দেবী। শুরু হল মা-ছেলের বিরোধ। বাকিটা তোলা থাক প্রেক্ষাগৃহের জন্য।
ঠিক ২২ বছর পর ‘আমার বস’-এ শুভ্রা গোস্বামীর চরিত্রে রাখী গুলজার। তাঁর অভিনয় দেখে মনেই হবে না কোথাও তিনি সংলাপ বলছেন। ভীষণ জীবন্ত। মন ছুঁয়ে গেলেন। বস অনিমেষের ভূমিকায় শিবপ্রসাদ। এই ছবির আসল আকর্ষণটাই মা-ছেলের অনবদ্য রসায়ন। এ এক অদ্ভুত সমঝোতা। তাই বহু দৃশ্য যেমন হাসাবে তেমনই অজান্তেই চোখের পাতা ভিজিয়ে দেবে। ছবিতে অন্যান্য ভূমিকায় রয়েছেন শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়, শ্রুতি দাস, সৌরসেনী মৈত্র, গৌরব চক্রবর্তী, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাঞ্চন মল্লিক প্রমুখ। প্রত্যেকেই দুর্দান্ত। সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার ছিলেন ক্যামিও চরিত্রে, তিনি দারুণ। চমক রয়েছে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়। সব মিলিয়ে ছবির শেষে রেশটুকু থেকে যাবেই অনেকদিন। ৫৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এবং ২২তম চেন্নাই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এই ছবি। সিনেমাটি ভারতীয় প্যানোরামা বিভাগে নির্বাচিত হয়েছিল। ছবির সুরকার অনুপম রায়। গান গেয়েছেন প্রস্মিতা পাল, উপল সেনগুপ্ত, শান। প্রযোজনায় ‘উইন্ডোজ’।