কী করতে আর বলতে চাইছে ওরা?

‘দয়া করে কাশ্মীরি বা মুসলিমদের টার্গেট করবেন না। আমরা শান্তি চাই। শুধু শান্তি চাই।’ কথাটা মহিলা হিমাংশী নারওয়ালের। নৌসেনার বাহাদুর লেফ্টেন্যান্ট বিনয় নারওয়ালের স্ত্রী। কিন্তু সে-কথা শুনলাম কই? উল্টে হিমাংশীকে ট্রোল করা হল। বিদ্বেষের বিষ ঢালা হল কর্নেল সোফিয়া কুরেশির ওপর। লিখছেন দেবলীনা মুখোপাধ্যায়

Must read

পহেলগাঁওয়ের ঘটনার চেয়েও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল! বিষ ছড়িয়ে হামলায় ঘি ঢালার উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। এই সুযোগে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে মেরুকরণের অস্ত্রে শান দেওয়ার চেষ্টা। বঙ্গ বিধানসভার বাইরে একে একে ২৬টি পাক পতাকা সাজিয়ে জনৈক বিজেপি নেতার প্রতিবাদের লক্ষ্য তবে কী? সীমান্তপারের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান নাকি এ-রাজ্যের বিরোধীরা? আগামী নির্বাচনে সংগঠন-শূন্য একটি দলকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে ‘যুদ্ধ জিগির’-এর আড়ালে রাজ্যের বিরোধী শক্তিই প্রত্যাঘাতের লক্ষ্য? ভোট রাজনীতির স্বার্থে একটা ধর্মসর্বস্ব রাজনৈতিক দল এতটা নীচে নামতে পারে! ভাবা যায় না!
পরের বছর ভোট বলে এই বঙ্গেই শুধু নয়, উত্তরপ্রদেশের আগ্রা থেকে শুরু করে চলন্ত ট্রেনেও আক্রান্ত হয়েছেন কেউ কেউ পহেলগাঁওয়ের ঘটনার ‘বদলা’য়। ছোট থেকে বড় এমন ধর্ম-বিদ্বেষের ঘটনার বিরাম নেই। কোথাও জুটছে মার, কোথাও প্রাণ নিয়ে টানাটানি। বোঝা গেছে, সীমান্ত পেরিয়ে প্রত্যাঘাত হোক বা না হোক, এই সুযোগে মুসলিম-বিদ্বেষ বাড়িয়ে ফায়দা লোটার আয়োজন সম্পূর্ণ। ভারতের প্রো-অ্যাক্টিভ নীতির জোরে কূটনৈতিকভাবে সিন্ধুজলচুক্তি বাতিল হয়েছে। আটারি সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তানিদের ভিসা বাতিল করে ওপারে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের আকাশসীমায় এবং বন্দরে কোনও পাকিস্তানি বিমান কিংবা জাহাজের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে। এমনকী গ্রাউন্ড জিরোতে গিয়ে পাকিস্তান নিবাসী জঙ্গিদের ঘাঁটিতে আক্রমণ করাও হয়েছে। এমন মারার কথা বলা হয়েছে যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। ৩৬টা রাফাল, অগুনতি সুখোই, মিরাজ, অত্যাধুনিক এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নিয়ে শত্রু দেশকে উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ভারতের সেনার সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। আধা সেনা ১৬ লাখ। মোট ৩১ লাখ আধুনিক যোদ্ধা তৈরি। পাকিস্তানের সেনা সংখ্যা সাড়ে ৬ লক্ষ। আড়াই লক্ষের কিছু বেশি আধা সেনা। কোনও তুলনাতেই আসে না। কিন্তু এই পাল্টা আঘাত ঘিরে ‘জিঙ্গোইজম’ আসন্ন নির্বাচনে বিরোধীদের পর্যুদস্ত করার অস্ত্র হবে কেন?
হিন্দুদের বেছে বেছে মারার নোংরামিকে কেন এভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে? টার্গেট যেখানে পাকিস্তান সেখানে মুসলমানকে টার্গেট করা হল কোন যুক্তিতে? যুদ্ধের সুযোগে বিরোধীদের টার্গেট করে মেরুকরণের আদিম মনোবৃত্তিতে হাওয়া দেওয়াও সমান অপরাধ।
এই প্রসঙ্গে একটু ইতিহাসের পাতা ওল্টানো যাক।

আরও পড়ুন-চেন্নাইতে কড়া বার্তা স্বরূপের, বাংলাই পথ দেখাচ্ছে কলাকুশলীদের প্রতিবাদে

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করলেই পরের এক দশক নির্বাচনে আর শাসক দলকে ভাবতে হয় না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জয়লাভের পরও চার্চিল ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর দলের লোকেরা তো বটেই বিরোধীরা পর্যন্ত ‘দেবী দুর্গা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ইন্দিরার পরাজয় এবং দেশে প্রথম অকংগ্রেসি সরকারের ক্ষমতা দখলের কথা সবার জানা।
একইভাবে ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধে জয়লাভের পর অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের গ্রহণযোগ্যতাও খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পাঁচবছরের মধ্যেই ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর হার হয়।
আর ৫৬ ইঞ্চির নরেন্দ্র মোদি?
তিনি অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণ করে রামলালাকে ঘর দিয়েছেন, কিন্তু হিন্দুদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারেননি। কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়েছে বলে কৃষক মানতে চায় না। নোটবাতিলে কালো টাকা বিদায় নিয়েছে, একথা মানতে রাজি নয় কোনও অর্থনীতিবিদ। কোনও শিক্ষিত যুবক বলবে না মোদিজি সরকারি চাকরিকে সহজলভ্য করেছেন।
আগামীতে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ চালু হওয়ার আগে পাকিস্তানের বিষ দাঁত মোদিজিকে ভাঙতেই হত। সেই কাজটাই উনি করার চেষ্টা করেছেন।
ইতিমধ্যেই চিন ও তুরস্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছে ইসলামাবাদের পাশে। পাকিস্তানও তুরস্ক থেকে নতুন নতুন সমরাস্ত্র কেনার অর্ডার দিচ্ছে। যদিও তাতে তেমন কোনও বড় প্রতিবন্ধকতা ভারতের সামনে তৈরি হবে না। কারণ ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট যেখানে ৮০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের সেখানে মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ইসলামাবাদের বন্ধু চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের প্রায় তিন গুণ। সেটাও চিন্তার বিষয় নয়। কারণ, চিনা মালের মুরোদ সাম্প্রতিক কালেই দেখা গিয়েছে। আসলে চিন্তা একটাই। ইসলামাবাদের উগ্রপন্থী নিয়ন্ত্রিত সরকারের হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে। চাপে পড়লে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যে তা ব্যবহার করা হবে না, এমন গ্যারান্টি নেই। ২৫ কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তানের তো কিছুই হারানোর নেই। যুদ্ধ হলে যা কিছু হারানোর তা ১৪০ কোটি জনসংখ্যার বিশ্বের চতুর্থ শক্তি ভারতেরই।
ভারত-বিরোধিতাই পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। আমরাও যদি উন্নয়ন ও প্রগতিশীলতাকে ঘুম পাড়িয়ে ধর্মকে ভোট জেতার তাস হিসেবে ক্রমাগত ব্যবহার করি একদিন পাকিস্তানের মতোই দুরবস্থা হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যদি পরাজিত হয়, বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের উজ্জ্বল উপস্থিতিও কলঙ্কিত হতে বাধ্য।
এটা যেন ভুলে না যাই।

Latest article