হিন্দু ধর্মে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেন জগন্নাথকে ঘিরেই এত আগ্রহ, এত উন্মাদনা, এত আকুতি?
উত্তরটা সহজ। জগন্নাথই তাবৎ সংস্কৃতির মিলনের আধার। আর এটাই একমাত্র কারণ। জগন্নাথই গণসংস্কৃতির প্রতিভূ। যৌথ সাধনার প্রতীক। সমন্বয়ী পরম্পরার ধারক। আদিবাসী, দ্রাবিড়, আর্য, সনাতনী হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ জগন্নাথদেবে একীভূত হয়েছে। জগন্নাথেই মিশেছে আর্য ভারতের হিন্দু সংস্কৃতির নানা শাখা-উপশাখাও। জগন্নাথই বৈষ্ণবের বিষ্ণু, শৈবের শিব, গাণপত্যের গণেশ, সৌর সাধকের সূর্যদেব, শাক্তের শক্তি। তাঁর মূর্তিতে কোনও লিঙ্গ চিহ্ন নেই। তাই তিনি কখনও নারী, কখনও পুরুষ। কখনও শাক্তদের দক্ষিণাকালিকা, কখনও আবার শৈবদের ভৈরব। গাণপত্যদের মহাগণপতি, আবার সৌর সাধনার সূর্যনারায়ণ। তাঁকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত পার্বণগুলির উৎসে আছে পুরাণ, আবার বেদে উল্লিখিত পুরুষোত্তম তিনিই। ব্রাহ্মণদের কাছে তিনি দারুব্রহ্ম, কিন্তু শবররাই তাঁর আদি উপাসক।
আরও পড়ুন-মুম্বইয়ে সক্রিয় আইএস স্লিপার সেল! এনআইএর হাতে ধৃত ২
অবাধ এবং অগাধ তিনি। সেজন্যই সম্পূর্ণতা তাঁর অনন্তময়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই-ই তিনি বাহ্যত অসম্পূর্ণ। জগন্নাথ মহাজাগতিক এবং অনন্ত মহিমান্বিত। তাই দৃশ্যত ও প্রাণত, উভয়তই জগন্নাথদেব আনন্দঘন। তাঁর পূজা রীতিতে আদিনিবাসী অনার্যদের সারল্যের সঙ্গে মিশেছে শাক্ত তান্ত্রিকের ন্যাস ও মুদ্রা, বৈষ্ণবদের যাগ-যজ্ঞ। বৌদ্ধতন্ত্রের মহাযান তন্ত্রে অনুসৃত আচার-উপচার জগন্নাথ পূজনের যেমন অচ্ছেদ্য অঙ্গ, তেমনই আদিবাসী অনার্য গোষ্ঠীর শবরী তন্ত্রের বিশ্বাস এখানে মিশেছে উড্ডীয়ান তন্ত্রের পূজাচারে। জগন্নাথের মন্ত্রে বৈদিক ওঙ্কার ধ্বনির সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে তান্ত্রিকের হ্লীং, শ্লীং, ক্লিং। আবার জগন্নাথের শুকনো মহাপ্রসাদ যখন কৈবল্য পরিচয়ে গৃহীত হয়, তখন বোঝা যায়, তাঁর উৎসে জৈন-ধর্ম সংস্কৃতি অবস্থিত। জগন্নাথের নির্মাল্যতে মিশে আছে শৈবসংস্কৃতি।
জগন্নাথে দেবতার মানবায়ন ঘটেছে। ফলে ঐশ্বরিকের সঙ্গে জাগতিকের সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। মানুষের মতোই জগন্নাথ মহাপ্রভুর নিত্যযাপন। তিনি দাঁত মাজেন, স্নান করেন, পোশাক বদলান, অলঙ্কার ভূষিত হন। বিশেষ বিশেষ পার্বণে তাঁর অঙ্গে শোভা পায় হিরা আর নীলা। ছাপান্ন ভোগ আস্বাদন করেন তিনি। ছত্রিশ রকমের সেবায়েত নিযুক্ত তাঁর নিত্যসেবায়। খাতানি বিধি মেনে নির্দিষ্ট হয় তাঁদের সেবা-খাটনি। জগন্নাথ পতিতপাবন। তাই দর্শনার্থী অহিন্দু হলেও তিনি দর্শন দেন পতিতপাবন রূপে। আবার আপামর মানুষ, জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে যাতে তাঁর দর্শন লাভে বঞ্চিত না-হন, সেজন্য তিনি নিজেই বেরিয়ে আসেন মন্দির থেকে, নামেন পথে, উঠে বসেন রথে।
জগন্নাথ-সংস্কৃতির সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য জীবনের প্রতি এরকম ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন। তাতে নেতিবাচকতার কোনও জায়গা নেই। এই সংস্কৃতি বিশ্বাস করে, আত্মার পরিশুদ্ধকরণের জন্য ধর্মাচরণ, পার্থিব চাহিদাপূরণ তার অভীষ্ট হতে পারে না।
আরও পড়ুন-খ্রিস্টানদের পরিচালিত সংগঠনগুলির ভূমিকা তুলে ধরলেন ডেরেক
জগন্নাথ বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাস করেন না, সংহতিকে ধারণ করেন। তাই বিভেদ পন্থার অন্যায় দানা বাঁধতে পারে না জগন্নাথ সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে। সেখানে কেবল ঐক্যের উদ্গীরণ, অচৈতন্য থেকে চৈতন্যে উত্তরণ। জগন্নাথ-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল দুটি বিষয়। জগন্নাথ ভক্তমাত্র সেই দুটি আচার পালনে সদা তৎপর। দর্শন আর মহাপ্রসাদ সেবন। জগন্নাথ ধামে মানুষ যান দুটি বাসনা নিয়ে। এক, প্রভুকে দেখবেন দু-চোখ ভরে। দুই, মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে ধন্য হবেন। ব্রাহ্মণ হোক বা শূদ্র, সবারই ওই দুটিই মনোবাসনা। জগন্নাথের মহাপ্রসাদ গ্রহণকালে ব্রাহ্মণে অব্রাহ্মণে ভেদাভেদ থাকে না। উচ্চবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের বিভেদ রেখা মুছে যায়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, সবাই এক পঙক্তিতে বসে মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেন। এই মিলন দীক্ষাই জগন্নাথ সংস্কৃতি। এই মিলন বীক্ষাই জগন্নাথ সংস্কৃতি।
অনুরূপ ঐক্যচেতনা প্রতিফলিত জগন্নাথদেবের সেবাকর্মেও। সেবায়েত হিসেবে ব্রাহ্মণদের সমান্তরালে অবস্থান অব্রাহ্মণদেরও। অব্রাহ্মণ সেবায়েতদের মধ্যে আছেন সুধাসুয়ার, পানিপত, মুদালি, গণমালী, চাপ বেহারা, মুলিয়া সুয়ানসিয়া, দেউলকরণ, তদাকুকরণ প্রমুখ। আর, ব্রাহ্মণ সেবায়েতদের মধ্যে আছেন পূজাপাণ্ডা, পুষ্পলোক, প্রতিহারী, খুন্টিয়া, পত্রীবাদু, সৌরাবাদু, গোচ্ছীকর, পতি মহাপাত্র, তালুচ্ছ মহাপাত্র, মুদিরাস্ত, মেইকাপ প্রমুখ। এঁরা সবাই একযোগে মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের পূজা-অর্চনা শাস্ত্রবিধি অনুসারে নিষ্ঠাভরে সম্পন্ন করেন। সামাজিক বর্ণ বিভাজন তাই জগন্নাথ ধামের প্রাঙ্গণে অপসৃত। একই পাত্র থেকে অকুন্ঠ চিত্তে মহাপ্রসাদ গ্রহণও এই পরম্পরায় স্বীকৃত।
জগন্নাথ যেখানে অবস্থান করেন সেখানেই কুণ্ঠার প্রতি বৈরিতার আবহ নির্মিত হয়। সেজন্য সেই স্থানই বৈকুণ্ঠ। সেই স্থানই ‘ধাম’। ‘ধামন’ শব্দ থেকে ‘ধামে’র উৎপত্তি। ‘ধামন’-এর প্রথমা এক বচনের রূপ হল ধাম। অর্থ, ‘স্থান’ বা ‘গৃহ’। যেখানেই জগন্নাথের গৃহ বা যেটাই জগন্নাথের স্থান, সেটাই জগন্নাথ ধাম। তা সে পুরী হোক বা দিঘা। জগন্নাথ ধামই জগন্নাথ সংস্কৃতির কুণ্ঠাবিহীনতার আকর ভূমি। ভারতবর্ষের পরাণ কথা পুরাণ এর সপক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। ব্রাহ্মর্ষি বশিষ্ঠ একদিন মহাপ্রভু জগন্নাথের বিষয়ে বেদপতি ব্রহ্মাকে প্রশ্ন করেন। ব্রহ্মা যা যা বলেছিলেন উত্তরে, অবিকল সেই কথাগুলোই ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠ বলেছিলেন জগন্নাথ চর্চার আদিকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রদ্যুম্নকে। দিবাকর দাস বিরচিত ‘শ্রীজগন্নাথ চরিতামৃত’-এ সেই বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেখানে বলা আছে, কষ্টক্লিষ্ট ব্রত পালন, জপ, হোম, তপস্যার মাধ্যমে অর্জিত পুণ্য চেতনায় যে শান্তি প্রবাহ আবাহন করে, জগন্নাথদেবের নির্মাল্য সেবন নয়, নির্মাল্য দান করলেও সেই পুণ্য লাভ হয়, ভক্তির দ্বার সহজে উন্মোচিত হয়। অপসারিত হয় মনের বিকার ভাব। ভক্তি মিশ্রিত জ্ঞান ঠেলে খুলে দেয় মুক্তির দুয়ার।
ব্রহ্মা এই কথাগুলোই বলেছিলেন ব্রহ্মর্ষি বশিষ্ঠকে। কিন্তু বশিষ্ঠদেব সেটুকুতেই সন্তুষ্ট হননি। তিনি বলেন, আগে কহ আর।
ব্রহ্মা তখন বলেন, নির্মাল্যের সুবাস মনে উঁকি মারতে থাকা বিকারকে উড়িয়ে দেয় আর নির্মাল্য দর্শনে দৃশ্যমান পাপসমূহ দ্রষ্টা বিস্মৃত হয়। নির্মাল্য স্পর্শ করলে মিথ্যা বলার প্রাচীরটাও ভেঙে পড়ে, ভক্তির পাথুরে ভিত নির্মিত হয়। মহাপ্রভু শ্রীজগন্নাথ স্বয়ং অন্নপতি। এ হল তাঁর অন্ন ব্রহ্মলীলার ভাবের ইস্তাহার।
নির্মাল্য আস্বাদনে নিজের বলা পাপ যেমন লুপ্ত হয়, তেমনই নির্মাল্যের কথা শ্রবণে সেই মুহূর্তে কৃত পাপের অবসান ঘটে। আর, শরীরে যদি কোনও-না-কোনও ভাবে নির্মাল্যের ছোঁয়া লাগে, তাহলে সেই শরীরের যাবতীয় পাপ ঘুচে যায়।
মহাপ্রসাদের এমনই ইতিবাচক মাহাত্ম্য।
জগন্নাথ ধাম তাই শ্রীক্ষেত্রে অবস্থিত না হলেও সৎক্ষেত্র। যেখানে জগন্নাথ অধিষ্ঠান করছেন সেখানে নঞর্থকতার, অসততার, কোনও ইশারা নেই। সেখানে ‘নেতি নেতি’ বলে কিছু নেই। সবই ‘ইতি ইতি’। সেখানে দুঃখ নেই, সবই আনন্দময়। সেই বৈকুণ্ঠে বৈরিতা নেই, আছে কেবল আত্মীয়ময়তা, অনাবিল ঐকান্তিকতা। লোকায়ত বিশ্বাস, অন্য কোনও ধর্মস্থান এমন প্রগাঢ়ভাবে এমন সদর্থক চৈতন্য পরম্পরার দ্যোতনা হতে পারে না। সংকীর্ণমনারাই কেবল এই কথাগুলো বুঝতে বা মানতে চায় না। তারাই কেবল জগন্নাথকে ভাগাভাগি করে, তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করে মরে।
আরও পড়ুন-বিকাশ ভবনে আটকে থাকা দুই মহিলা কর্মীর বিস্ফোরক পোস্ট
বাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতি ধর্মচর্চা পরম্পরায় দেবতার সান্নিধ্য লাভের, তাঁর আশিস লাভের বাসনা প্রকট। প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষও এখানে প্রতি মরশুমে গাছের প্রথম ফল বা খেতের প্রথম ফসল দেবতাকে নিবেদন না-করে নিজে মুখে তোলে না। অন্নপ্রাশনে শিশুর মুখে দেবতার প্রসাদ তুলে দেওয়া এখানকার পরম্পরা। বিয়ের সময় মন্দিরের দেবতাকে বিবাহ-অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ জানানো পূর্ব ভারতের এই প্রদেশে একটি বহুকালাগত রীতি। বিয়ের পর নব দম্পতির মন্দির দর্শন এরাজ্যে একটি প্রচলিত প্রথা।
বাংলার মানুষের শেষকৃত্যের জুড়ে থাকে তাঁর অক্ষয় স্বর্গবাসের প্রার্থনা। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি এমন অধ্যাত্ম প্রণোদনার অভিজ্ঞান তাই জগন্নাথধাম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের নির্মাণ। প্রাণের ঠাকুর জগন্নাথকে ভৌগোলিকভাবে আরও কাছে এনে দেওয়ার প্রয়াস। দেব ভাবনাকে জীবনের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে অন্বিত করার সুবিধা দান।
সত্যনারায়ণ পূজার উৎসভূমে জগন্নাথ পূজনের মন্ত্রোচ্চারণ অতি স্বাভাবিক। কারণ তাতেই মিলন-সংস্কৃতির বৈভবের আরও ঐশ্বর্যময় প্রকরণের সুনিশ্চিতকরণ। কলিঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জগন্নাথের প্রভাব দুর্লক্ষ্য নয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মৌর্য সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ আক্রমণের কথা সে রাজ্যের উদয়গিরি ও খণ্ডগিরির শিলালিপিতে বর্ণিত। সেখানে বলা আছে, জগন্নাথের নামে ঐক্যবদ্ধ ওড়িশাবাসীর সংহত দৃঢ়তা দেখে বহিরাগত কেউ কলিঙ্গ আক্রমণে সাহস দেখাত না। অশোক দেখিয়েছিলেন। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে কলিঙ্গকে জয় করেছিলেন। কিন্তু সেই জয়ের অভিজ্ঞতা শেষপর্যন্ত তাঁকে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে বিবর্তিত করেছিল। কলিঙ্গই জিতে নিয়েছিল অশোককে। ওড়িশায় মহামেঘবাহন খারবেল প্রথম খ্রিস্টাব্দে অধুনা ভুবনেশ্বরের সন্নিকটে শিশুপালগড় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তারই প্রচেষ্টায় পুরীতে জিনাসনের রূপে জগন্নাথ সংস্কৃতির পুনর্বিকাশ সম্ভবায়িত হয়। ইতিহাস বলছে, শবরদের নীলমাধব পাহাড়ের কন্দর থেকে নেমে এসে সমুদ্র উপকূলে দারুব্রহ্ম রূপে পূজিত হন। আদিবাসীদের দেবতা ক্ষাত্র ও ব্রাহ্মণ্য গোষ্ঠীর উপাস্য হয়ে ওঠেন। বৌদ্ধ ও জৈন অধ্যাত্ম দর্শনকে অঙ্গীভূত করতেও জগন্নাথ সংস্কৃতির কোনও অসুবিধা হয়নি।
আরও পড়ুন-মুম্বই বিমানবন্দর ও তাজ হোটেল উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি ই-মেইল
বাংলার প্রাণের ঠাকুর মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যও তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বে নীলাচলবাসী হয়েছিলেন। বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে চৈতন্যাবদান একটি অনস্বীকার্য বিষয়। শ্রীচৈতন্য ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক ধর্ম সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন। সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ভক্তি আন্দোলন। আর তাতে জগন্নাথের প্রভাব অনস্বীকার্য। এই জগন্নাথ বিভেদ রেখা মুছে মিলনের গান শোনান। কীভাবে? ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেওয়া যাক।
ওড়িশার ভজন সংগীতে যাঁরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে সালবেগ ছিলেন মুসলমান। গজপতি রাজা নরসিংহদেবের রাজত্বকালে মুঘল সুবাদার আহম্মদ বেগ পুরীর জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করলেন। মন্দিরের সেবায়েতরা চিলকার রাস্তা ধরে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার বিগ্রহ তিনটিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে অন্ধারীগড়ে, তারপর খোরদার গড় মানিত্রীতে। ২২২ দিন জগন্নাথ মূর্তি ছিল মন্দিরের বাইরে। আর এই ২২২ দিন সালবেগ জগন্নাথ মূর্তির পাশেপাশে ছিলেন, তাঁর চামর সেবা করতেন। সেই মুসলমান কবির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আজও তাঁর সমাধিস্থলে রথযাত্রার সময় বড়দাণ্ডে জগন্নাথদেবের রথ দাঁড়ায়। জগন্নাথ মুসলমান ভক্তকে অগ্রাহ্য করেন না ব্রাহ্মণ্য অহংয়ের আধিক্যে।
সম্বলপুরের রেমড়ার কাছে শতাধিক বর্ষ ধরে পালিত হয় জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। রেমড়া মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রাম। নাগপুর আদালতে মুন্সেফের কাজ করতেন মাসুল আলি। সম্বলপুরের রাজা তাঁকে ডেকে রেমড়া পঞ্চায়েতের ছ’টি গ্রামকে একত্রিত করে তার প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন মাসুল আলিকে। এই মাসুল আলির ছেলে মহম্মদ হানিফ রেমড়াতে রথযাত্রা উৎসবের সূচনা করেন। সুনারী গ্রাম থেকে রথযাত্রার সময় জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ নিয়ে আসা হত। আজও রেমড়ার রথযাত্রায় ছেরাপহরা বা রথযাত্রা শুরুর আগে রাস্তায় ঝাঁট দেওয়ার প্রথা পালন করেন সেখানকার গ্রাম প্রধান, যিনি ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান। আজও রেমড়ায় রথযাত্রার সময় হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে সেটাকে জাতীয় পার্বণ হিসেবে পালন করেন। তাতে অংশ নেন মুসলমান মহিলারাও। পুরীর রথযাত্রার তিন দিন পর, অর্থাৎ আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে পালিত হয় এই রথযাত্রা উৎসব। জগন্নাথ এভাবেই হয়ে ওঠেন হিন্দু-মুসলমান যৌথ সাধনার প্রতীক। কিন্তু পুরীর জগন্নাথ ধামে ঐতিহাসিক কারণে মুসলমানের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আর পুরীর মন্দিরে এই বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিটি বসানো হয়েছে ব্রিটিশ জমানায়। বঙ্গের জগন্নাথ ধামে ঐতিহাসিক কারণেই সেরকম বাধা নিষেধ নেই।
ইতিহাস বলছে, পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ওপর প্রায় ১৮ বার বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়েছিল। আক্রমণের কারণে বা আক্রমণের আশঙ্কায় ২১ বার জগন্নাথ বিগ্রহকে পুরীর মন্দির থেকে স্থানান্তরিত করতে হয়েছিল। এগুলির মধ্যে কালাপাহাড়ের আক্রমণ ছিল সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। বঙ্গীয় আফগান শাসক সুলেমান কররানির সেনাপতি ছিলেন কালাপাহাড়। সুলেমানের পুত্র বায়জিদের সঙ্গে তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দির আক্রমণ করেন। কালাপাহাড়ি আক্রমণের সময় জগন্নাথদেবের বিগ্রহ মন্দিরে ছিল না। সেটি তখন সরিয়ে ফেলা হয়েছিল চিলকা হ্রদের কূলে হাতি পাটনার কাছে। নিমত আলির ‘মখজন-ই-আফগানি’ অনুসারে, কালাপাহাড়ের আফগানি সেনারা পুরীর মন্দির থেকে কমপক্ষে ৭০০টি সোনার মূর্তি লুঠ করেছিল। এরকম বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পুরীর মন্দিরে অহিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
আরও পড়ুন-১৪ বছর পর খুনের সাজা দোষীর
পক্ষান্তরে, এই বঙ্গে আজও পঠিত হত মুসলমান শাসক পরাগল খাঁয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বরের লেখা বাংলা ভাষায় সংস্কৃত মহাকাব্যের অনুবাদ। সেই পরম্পরা মেনেই বঙ্গের জগন্নাথ ধাম সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রে অহিন্দুদের জন্য যেমন পতিতপাবন মূর্তি আছে, তেমনই আছে জগন্নাথ দর্শনের জন্য পৃথক ঘরও। আধুনিক বাস্তবতা মেনে পরম্পরা অনুসরণ করার ফলে জগন্নাথ কেন্দ্রিক অধ্যাত্ম দর্শনে বিভাজন রেখার অপসারণ। জগন্নাথ সংস্কৃতিতে এটুকু অন্তত স্পষ্ট। প্রাদেশিক সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে জগন্নাথ। বাংলার কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িয়া কবি পুরুষোত্তম দাস বিরচিত কাব্যের অনুসরণে ‘কাঞ্চী কাবেরী কাব্য’ রচনা করেন। সেই আখ্যানকাব্যে বর্ণিত জগন্নাথ ও বলভদ্রের কাঞ্চী অভিযানের বৃত্তান্ত। সেই কাব্যের ভূমিকায় রঙ্গলাল লিখেছিলেন, “(উৎকল ও বঙ্গ) উভয় দেশীয় লোকের মধ্যে… সৌহার্দ্য যত বর্ধিত হয় ততই সুখের বিষয়। সেই সৌহার্দ্য-রজ্জুর খণ্ডেক ক্ষীণ সূত্র বা তৃণবৎ আমি এই ঐতিহাসিক কাব্যখানি বঙ্গীয় এবং উৎকলীয় বন্ধুগণের হস্তে সমর্পণ করিলাম।”
চৈতন্যদেব হোন বা রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, আধ্যাত্ম্যপুরুষ হোন বা বঙ্গভাষী কবি, তাঁদের সূত্রে যেমন জগন্নাথদেব বঙ্গ সংস্কৃতিতে কোনওভাবেই বহিরাগত নন, ঠিক তেমনই মুসলমানরা জগন্নাথদেবের প্রীতি বঞ্চিত নন। কোনওভাবেই নন।
বৈষ্ণব আচার্য রামানুজের বিশ্বাস ছিল, জগন্নাথদেব কেবল বৈষ্ণবদের মোক্ষ প্রদান করেন। পুরী থেকে ফিরে শ্রীরঙ্গমে তখন অবস্থান করছিলেন রামানুজাচার্য। জনৈক যবন শ্রীরঙ্গমে অধিষ্ঠিত দেবতা শ্রীরঙ্গনাথের কৃপা প্রার্থনা করল। রাতে সে স্বপ্নাদেশ পেল, ‘প্রসন্ন মোক্ষদানে হং দীক্ষিতো যবনেশ্বর’। পতিতানাং মোক্ষদানে জগন্নাথঃ প্রদীক্ষিতম।‘ অর্থাৎ, হে যবন! আমি শরণাগত বৈষ্ণবদের মোক্ষ দান করি। কিন্তু জগৎপতি জগন্নাথ পতিতদেরও মোক্ষদাতা। তুমি শ্রীজগন্নাথের শরণাগত হও।’
স্বপ্নাদেশের পর সেই অহিন্দু মানুষটি ছুটলেন পুরীতে, জগন্নাথের কাছে। আর সেকথা জ্ঞাত হয়ে রামানুজও উপলব্ধি করেছিলেন, হিন্দু-অহিন্দু, বৈদিক-পাষণ্ড, সবারই মোক্ষদানকারী দেবতা জগন্নাথ। তাঁর কৃপা জাতি ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার উপরেই বর্ষিত হয়। নির্দিষ্ট কোনও সাম্প্রদায়িক ভাবনার পুঁথিতে নয়, ভারতের অধ্যাত্মভাবনার কেন্দ্রতে যুগ যুগ ধরে এই কথাটিই প্রতিষ্ঠিত।
জয় জগন্নাথ।