বলিউডের অভিনেত্রী বিপাশা বসুও স্বীকার করেছেন, তাঁর হাঁটুর অবস্থা ৮০ বছরের বৃদ্ধার মতো! তাঁর পক্ষে আর ছোটাছুটি, লাফালাফি করা সম্ভব নয়! বাতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন অলিম্পিক্স পদকজয়ী তারকা সাইনা নেহওয়ালও। তাঁর হাঁটুর অবস্থাও খারাপ।
এত কম বয়সেই ভাবতে শুরু করেছেন অবসর নেওয়ার কথা। বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষের আর্থ্রাইটিস বা বাত রয়েছে। আর ১ কোটি ৮০ লক্ষ লোকের শুধু রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রয়েছে। ৮০ বছরের বেশি যাঁদের বয়স তাঁদের মধ্যে প্রায় ৫৫% শতাংশ আর্থ্রাইটিসের শিকার।
ভারতে অস্টিও-আর্থ্রাইটিস হল দ্বিতীয় সর্বাধিক বাতজনিত সমস্যা। এখানে অস্টিও-আর্থ্রাইটিস হার ২২ থেকে ৩৯ শতাংশ। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অস্টিও-আর্থ্রাইটিসে বেশি আক্রান্ত হন। অস্টিও-আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত ৬২ শতাংশই নারী।
আমাদের পঙ্গুত্বের একটি বড় কারণ কিন্তু আর্থ্রাইটিস। পরিসংখ্যান বলছে, মোট পঙ্গুত্বের ১৮% এই আর্থ্রাইটিসের জন্যই। ক্রনিক কোনও অসুখে ভুগলে আর্থ্রাইটিসের আশঙ্কা বাড়ে। বাতের কোনও বয়ঃসীমা নেই।
যে-কোনও অসুখের নামের পিছনে যখন আইটিস জুড়ে যায় তখন সেটা ইনফ্লামেশন বা প্রদাহকেই বোঝায়। যেমন হেপাটাইটিস, প্যানক্রিয়াটাইটিস, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। আর্থ্রাইটিস হল অস্থিসন্ধির প্রদাহ। এই প্রদাহ কী? একাধিক জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধি, যেমন— হাঁটু, কবজি, গোড়ালিতে যখন ফোলাভাব আসে, লালচে হয়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা হয়, জ্বালাভাব বা প্রদাহ তৈরি হয় তখন সেটাকেই আর্থ্রাইটিস বলে। কিছু আর্থ্রাইটিস বয়স বাড়লে বেশি হয়। আর কিছু আর্থ্রাইটিস যেমন রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, লুপাস হল অটোইমিউন রোগ। যা যে কোনও বয়সের মানুষের হতে পারে। ১০০টিরও বেশি আর্থ্রাইটিস রয়েছে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস যার মধ্যে সবচেয়ে কমন অটোইমিউন ধরন।
অস্টিও-আর্থ্রাইটিস
অস্টিও-আর্থ্রাইটিস কার্টিলেজ ক্ষয়ে যাওয়ার কারণে হয়, কার্টিলেজ হল হাড়ের প্রান্তগুলিকে ঢেকে রাখার একটি নরম এবং পিচ্ছিল টিস্যু। এই কার্টিলেজ ক্ষয়ে গেলে হাড়ের প্রান্তগুলি সরাসরি একে অপরের সঙ্গে ঘষা লাগে, ফলে জয়েন্টগুলোতে ব্যথা ও প্রদাহ দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ আর্থ্রাইটিসকে রোগ ভেবে ভুল করে থাকেন। আর্থ্রাইটিস আদতে কোনও রোগ নয়। অতিরিক্ত ওজন হয়ে গেলে অস্থিসন্ধিতে চাপ পড়ে এর ফলে আর্থ্রাইটিস হতে পারে। এছাড়া, বার্ধক্যজনিত কারণেও আর্থ্রাইটিস হয়। এই রোগের কোনও প্রতিকার নেই। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শে যথাযথ নিয়ম মানলে বা ওষুধ খেলে এই ব্যথা অনেকটাই শিথিল করা সম্ভব। বয়স্করাই কিন্তু বেশিরভাগ ‘অস্টিও-আর্থ্রাইটিস’-এর সমস্যায় ভোগেন। এই সমস্যায় হাঁটাচলা করতে খুবই অসুবিধা হয়। সমস্যা বাড়লে ধীরে ধীরে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে গিয়ে হুইলচেয়ারের সাহায্য নিতে হয়। এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে যখন অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায় তখন ‘নি-রিপ্লেসমেন্ট’ করার প্রয়োজন পড়ে।
আরও পড়ুন-ধোনিরা লাস্ট বয়, ফার্স্ট বয় বৈভব
উপসর্গ
ব্যথা এবং প্রদাহ হালকা থেকে মাঝারি হতে পারে। তবে চিকিৎসা না করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা খারাপের দিকে গড়ায়। পেশির দুর্বলতাও দেখা যায়। জয়েন্ট ফুলে যেতে পারে এবং গরম হয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষণ বিশ্রামে থাকলে জয়েন্টগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং তখন নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। বিশেষ করে চড়াই বা ওপরে হাঁটার সময় ব্যথা বেশি হয়। হাঁটু বাঁকানোর সময় একটি কড়-কড় শব্দ হতে পারে অস্থিসন্ধিতে। পা ধনুকের মতো বেঁকে যায়। জয়েন্টের চারপাশে হাড়বৃদ্ধি পায়। আক্রান্ত স্থানে ব্যথাযুক্ত ফোড়া বা ফোস্কা হতে পারে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা (RA) এক দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যা প্রাথমিক ভাবে অস্থিসন্ধিকে প্রভাবিত করে। আপাতভাবে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসকে শুধু অস্থিসন্ধি এবং পেশির ব্যথা বলেই মনে করেন। কিন্তু রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস শুধু তা নয়। এর জেরে হাড়ে ব্যথার সঙ্গে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ফুসফুস, হৃদযন্ত্র এবং রক্তনালিতেও সমস্যা হয়। এমনকী রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের কারণে দৃষ্টিশক্তিও কমে যেতে পারে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখ। পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবার ঝুঁকিও থাকে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস প্রথমে ছোট ছোট অস্থিসন্ধিগুলির ক্ষতি করে। রোগটা যত বাড়তে থাকে, কবজি, হাঁটু, গোড়ালি, কনুই, কাঁধে যন্ত্রণা বাড়তে থাকে। রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত পর্যায় পৌঁছলে চোখ, ত্বক, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও রক্তনালিতে সমস্যা হয়।
উপসর্গ
গাঁটে গাঁটে ব্যথা হয়। পাশাপাশি হাত-পা অবশ হয়ে যেতে থাকে। হাত এবং পায়ের জোরও কমে যেতে পারে। মাঝেমধ্যেই জ্বর আসতে পারে। ভিতরে জ্বর-জ্বর ভাব থাকে। অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতাও এই রোগের লক্ষণ। চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়। এছাড়া অনবরত জল পড়া, চোখে জ্বালা, চুলকানি হলেও সতর্ক হতে হবে কারণ চোখের সংক্রমণ ভেবে অনেকে বুঝতে পারেন না এড়িয়ে যান। এতে অন্ধত্ব আসতে পারে।
আরও পড়ুন-রিজিজুর ফোন মুখ্যমন্ত্রীকে, সর্বদলীয় প্রতিনিধি দলে অভিষেক, প্রমাণিত হল তৃণমূলের অবস্থানই ঠিক
রোদে সেঁকে সুস্থ
শরীরে ভিটামিন ডি ও ক্যালশিয়ামের ঘাটতি হলেই আর্থ্রাইটিস হবার সম্ভাবনা বাড়ে। যে খাবার থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যেতে পারে, সে-সব খাবার খাওয়ার চল আমাদের দেশে কম। কয়েক রকম বাদাম, সবজি থেকে যতটুকু ভিটামিন ডি পাওয়া যায়, তা শরীরের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই ভিটামিন ডি-র সবচেয়ে ভাল উৎস হল সূর্যের আলো। রোদে কিছুক্ষণ শরীর সেঁকলে সেই প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি পাওয়া যাবে। তবে ভরদুপুরের চড়া রোদে নয়। দিনের কিছুটা সময় সূর্যের আলো গায়ে লাগান। নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। খুব বাড়াবাড়ি হলে অস্ত্রোপচারই পথ। তবে বেশি বয়সে অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে স্টেরয়েডবিহীন যন্ত্রণানাশক ওষুধ, স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন, ফিজিওথেরাপি, গরম বা ঠান্ডা সেঁক— এগুলোই পথ। তবে কোনও কিছুই কাজে না এলে হাঁটু প্রতিস্থাপনের দিকে এগতে হবে। এই মুহূর্তে নি-রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি যে-কোনও ধরনের আর্থ্রাইটিসের জন্য সফল চিকিৎসা। অনেকেই এটা করে সুস্থ জীবন ফিরে পেয়েছেন।