বাংলার মেয়ে মানেই খুব কাছের কেউ। যাঁর গা থেকে মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যায়। যাঁর কাছে দু-দণ্ড বসতে ইচ্ছে করে, যার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। সেই বাংলার মেয়েরা আবার যুগে যুগে বাংলার বাইরেও স্বনামধন্যা। এমন উদাহরণ এই বঙ্গে ভূরি ভূরি রয়েছে। তবে আজকে যাঁর কথা বলছি তিনি হলেন অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়। সত্তরের দশকের নামকরা অভিনেত্রী মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ছবিতে হাতেখড়ি হয়েছিল তরুণ মজুমদারের ছবি ‘বালিকাবধূ’র মাধ্যমে। এরপর টলিউড এবং বলিউডে চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। এমন কোনও তাবড় নায়ক নেই যাঁর বিপরীতে তিনি অভিনয় করেননি। তাঁর মিষ্টি মুখ, বলিষ্ঠ অভিনয়ে মুগ্ধ ছিলেন সেই যুগে বাংলা তথা ভারতের সিনেমাপ্রেমী দর্শকেরা। যদিও ২০১৬ পরে আর তাঁকে দেখা যায়নি বড়পর্দায়। ‘গয়না বাক্স’তে তাঁর অভিনয় মনে রাখার মতো। এরপর অনেকদিন পেরিয়ে গেছে। ২০২৫-এ আবার বড়পর্দায় ফিরলেন মৌসুমী যশ দাশগুপ্ত এবং নুসরত জাহানের প্রযোজনা সংস্থা ওয়াইডি ফিল্ম-এর ছবি ‘আড়ি’র হাত ধরে। চলচ্চিত্র দুনিয়ায় এই বছরটা উল্লেখযোগ্য কারণ অনেক নামজাদা কিংবদন্তিরা কামব্যাক করলেন বড়পর্দায় বিশেষ করে বাংলা ছবিতে। যেমন শর্মিলা ঠাকুর, রাখী গুলজার। ‘পুরাতন’ ছবিতে দীর্ঘ ১৪ বছর পর শর্মিলা ঠাকুর এবং নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বস’ ছবিতে দীর্ঘ ২২ বছর পর রাখী গুলজার ফিরলেন। ওঁদের মতোই মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়েরও এটা কামব্যাক বছর। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ছবিটা নিয়ে দর্শকদের আগ্রহ ছিলই। মৌসুমীর সেন্স অফ হিউমার ওঁকে অন্য অভিনেত্রীদের থেকে আলাদা করে। ওঁর বেশিরভাগ ছবি মনকে হালকা করে দেয়। এতদিন পরে ‘আড়ি’ (Aarii) দেখলেও দর্শকদের সেটাই মনে হবে। বয়স বাড়লে মৌসুমীর সেই সাবলীলতা বদলায়নি। এই ছবির বিষয়বস্তু ডিমেনশিয়া আক্রান্ত মাকে নিয়ে ছেলের জীবনযুদ্ধ। স্মৃতি-বিস্মৃতির টুকরো, কোলাজ হাসি-কান্না, আনন্দ, খুনসুটি আর তার মধ্যে মধ্যেই চলা গল্পের বুনন।
আরও পড়ুন: যোগীর মোরাদাবাদে বেসরকারি স্কুলে দলিত ছাত্রীকে গণ.ধর্ষণ
সমুদ্রের পাড়ে একটি মাছকেন্দ্রিক বন্দর শহর চন্দ্রপুর এই গল্পের প্রেক্ষাপট। এখানকার বাসিন্দা বৃদ্ধা জয়া সেন আর তাঁর একমাত্র ছেলে জয়। জয়া অ্যালঝাইমার-ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। স্বামীকে হারিয়েছেন বহু আগেই। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আজ তিনি স্মৃতিভ্রংশের শিকার। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে জয়া তাঁর সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। নিজের বাড়ির ঠিকানাও মনে করতে পারেন না। ছেলে এখনও তাঁর কাছে সেই আদরের ছোট্টটি রয়ে গেছে। আবার সেই ছেলেই কখনও কখনও হয়ে ওঠে স্বামীর প্রতিরূপও। এহেন মা জয়াকে ঘিরেই আবর্তিত ছেলে জয়ের জীবন। একাই অসুস্থ মাকে আগলে রাখেন। নিজে হাতে সংসারের সবটা সামলান। রেষারেষি, মারদাঙ্গা নেই এই ছবিতে। বেশ একটা হালকা চালে হাসি, মজার মোড়কে সুন্দর গতে এগোয়। ছেলে জয়ের তাঁর মায়ের জন্য উদ্বেগ, ভালবাসা, সাহচর্য— এগুলোই ছবির মূল উপজীব্য। ছবির আরেকটি চরিত্র হল তরুণী সাংবাদিক অদিতি। কাজ করেন এক সাপ্তাহিক পত্রিকার অফিসে। ছিমছাম, সাদামাঠা অদিতি মা-ছেলের সেই ভালবাসার আকর্ষণে কখন যেন ঢুকে পড়ে তাঁদের জীবনে। এদিকে রয়েছে দুই ভিলেনও। মাছের ব্যবসাদার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক দুই দলের নেতামার্কা লোক ত্রিলোক আর সামন্ত। হঠাৎ জয়ের টাকার প্রয়োজন পড়ে সেই সুযোগে গ্যাং লিডার ত্রিলোক তাকে টেনে আনতে তৎপর হয় অপরাধ জগতে। জয় কী করবে? সমাজ, রাজনৈতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সে কতটা সফল হবে সেই নিয়ে এরপরে ঘটনার ঘনঘটা।
ছবিটি পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন জিৎ চক্রবর্তী। পরিচালক হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে তুলনামূলক ভাবে নতুন জিৎ। এর আগে তিনি পরিচালক, অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ও অপরাজিতা আঢ্যকে নিয়ে ‘কথামৃত’ ছবিটি করেছিলেন। ওয়েব সিরিজেও কাজ করেছেন তিনি। জিতের পরিচালনা ভালই। তাঁর এই ছবি প্রসঙ্গে প্রযোজক, অভিনেতা যশ বললেন, একটা অন্য রকম কিছু করতে চাইছিলাম। বাংলায় মা ও ছেলেকে নিয়ে অনেক ছবিই হয়েছে। তবে এই ছবির সঙ্গে অন্য কোনও ছবির মিল খুঁজে পাবেন না দর্শক। এখানে এক-একটা চরিত্র এক-একটা সম্পর্কের কথা বলবে। আমরা শুরু থেকেই এই ছবির জন্য মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়কেই ভেবেছিলাম। যশ, নুসরতের প্রযোজনা সংস্থা নতুনদের নিয়ে কাজ করে। নতুন পরিচালকরা তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছে এর আগেও। জিৎ-ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁদের মতে নতুনদের সুযোগ দিলে তাঁরা উৎসাহ পায়, প্ল্যাটফর্ম পায় এবং ভাল কাজ করতে সক্ষম হয়। আগামীতেও আরও নতুন তাঁদের ব্যানারে কাজের সুযোগ পাবে।
টলিউডে এখন মায়েদের জয়গান। এ-বলে আমায় দ্যাখ তো ও-বলে আমায়। ‘আড়ি’তে (Aarii) মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের সহজ, সাবলীল, দুর্দান্ত অভিনয়, রসবোধ— এ-ছবির আসল পাওনা। ছবির নায়ক যশ দাশগুপ্তই। যিনি মৌসুমীর পাশে অনেকটাই উতরে গেছেন। মা ছেলের, খুনসুটি, কপট রাগ, আবেগ তাঁদের রসায়ন খুব মনে ধরবে দর্শকদের। নুসরতের চরিত্রটা বেশ লেগেছে। গ্ল্যামার সরিয়ে দিয়ে তিনি এখানে শুধুই অভিনেত্রী। ছিমছাম সাধারণ একটা মেয়ে। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় সুদূর মুম্বই থেকে কলকাতায় এসে শ্যুটিং করেছেন। যশ আর নুসরতও রয়েছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। এছাড়া ছবিতে আর যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, রাজনৈতিক নেতা পার্থ ভৌমিক, উন্মেষ গঙ্গোপাধ্যায়, সোহিনী সেনগুপ্ত, অভিজিৎ গুহ, সুমিত পাঁজা প্রমুখ। শ্রাবন্তীর আইটেম নাচ এবং ইমন চক্রবর্তীর গান জমিয়ে দেবে। ছবির সুরকার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, লিংকন রায়চৌধুরী, সৌভিক বসু, কেশব দে। কাহিনি অমিতাভ ভট্টাচার্য।