(গতকালের পর)
কী হতে চলেছে—
শুরুটা উত্তরবঙ্গ থেকেই হোক। বাম আমলে উত্তরবঙ্গের মানুষদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। কারণটা ছিল উত্তরবঙ্গের মানুষদের বঞ্চনার চোখে দেখা। একটা সময় আন্দোলনের রূপ এতটাই তীব্র হয়েছিল যে পশ্চিমবঙ্গের থেকে উত্তরবঙ্গ প্রায় আলাদা হতে বসেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শাসনভার নিজ হাতে নেওয়ার পর উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে। উত্তরবঙ্গে সচিবালয় গঠন হওয়ার পর থেকে সেখানকার মানুষকে বিভিন্ন কাজে আর দক্ষিণবঙ্গে ছুটে আসতে হয় না, বরং প্রকৃতির টানে লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ উত্তরবঙ্গে ছুটে যায়। তার পুরো কৃতিত্ব দাবি রাখে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তর। পর্যটনে যেভাবে তারা নজর দিয়েছে এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর ঘন ঘন উত্তরবঙ্গ সফর আজ উত্তরবঙ্গের মানুষের মনে বিশ্বাসের ভিতটা মজবুত করেছে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে আবার কিছু প্রকল্প পাইপ লাইনে রয়েছে। এছাড়াও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখনই সাধারণ মানুষের সামনে আসেন নতুন কিছু ঘোষণা তাঁর ঝুলিতে থাকে। তারই কিছু ঝলক দেখে নেওয়া যাক—
সুদূর উত্তর দিনাজপুর জেলার স্পিনিং মিল অঞ্চলে তন্তুজ একটি রেডিমেড গার্মেন্টস মানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট সেন্টার তৈরি করেছে। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫.৮৫ কোটি টাকা। এই সেন্টারটির কাজ চালু হলে প্রায় ৩৫০০০ জন মানুষ তাতে উপকৃত হবেন।
টি টুরিজম অ্যান্ড বিজনেস পলিসি, ২০১৯-এর অধীনে ২৭টি কোম্পানির থেকে ৩২টি প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে যার আনুমানিক বিনিয়োগ ২২০৫.৪৩ কোটি টাকা হবে, যাতে প্রায় ৭০০০ জনের ও বেশি কর্মসংস্থান হতে পারে।
বিগত দিনের ঘোষণা অনুযায়ী শিলিগুড়িতে বিশ্বমানের কনভেনশন সেন্টার নির্মিত হতে চলেছে ১০ একর জমির ওপর, যেখানে ব্যবসায়িক আদান-প্রদান ছাড়া ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং নানাবিধ কর্মসূচি নেওয়া যাবে।
জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, মালদা, আলিপুরদুয়ার এবং রায়গঞ্জ থেকে সরাসরি দিঘা যাওয়ার বাসেরও ব্যবস্থা করার ফলে পরিবহণ ব্যবস্থার এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল।
এবার আসি পশ্চিমাঞ্চলের দিকে, একাধারে পশ্চিম বর্ধমানের গৌরাঙ্গডি অপরদিকে বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি কোল মাইন আগামী সময়ে কয়লা উত্তোলনের কান্ডারি হতে চলেছে। ১২৪০ মিলিয়ন টন কয়লা এবং ২৬০০ মিলিয়ন টন ব্যাসেল্ট এর সম্ভার-সহ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে দেউচা-পাঁচামি। যার যেরে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের শুধু কর্মসংস্থানই নয়, এলাকার ভোল ও বদলে যাবে।
২০৩০-এর মধ্যে জোগান ও চাহিদার ব্যবধান মেটাতে Tarrif Based Competitive Binding মোডে রাজ্য মন্ত্রিসভা ২.৮০০ MW গ্রিনফিল্ড পাওয়ার প্লান্টস-এর মাধ্যমে ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হতে চলেছে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইকোনমিক করিডর পলিসি 2023-এর অধীনে ইকনমিক করিডর ও পরিকাঠামো খাতে ৪৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হবে। যেখানে ৩৪৮৫ কোটি টাকা ADB ঋণ দেবে বাকি ৮৭৭.৪০ কোটি টাকা রাজ্য সরকার দেবে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল লজিস্টিক পলিসি ২০২৩-এর অধীনে লজিস্টিক ব্যবস্থা উন্নয়নে ২০৭২.৬৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে যেখানে ১২৪৩.৬১ কোটি টাকা বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে এবং বাকি ৮২৯.০৭ কোটি টাকা রাজ্য সরকার দেবে।
অমৃতসর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত ইস্টার্ন ফ্রেট করিডর নির্মাণের স্বার্থে রঘুনাথপুর পুরুলিয়ায় ২৪৮৩ একর জমিতে ৭২০০০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘জঙ্গল সুন্দরী কর্মনগরী’ নির্মাণ হতে চলেছে।
আরও ঐতিহাসিক কিছু পদক্ষেপ যা সামাজিক জীবনে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছে এবং আগামীতেও ফেলবে।
স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের আওতায় ২.৪৫ কোটি পরিবার সুবিধা পাচ্ছেন। ১১০৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৮৫ লক্ষেরও বেশি রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা প্রদান করা হয়েছে। তারই সূত্র ধরে বলতে পারি বাংলা আগামী দিনে ভারতবর্ষকে পথ দেখাবে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বাংলায় ৯টি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে উঠছে। যেখানে নতুন ক্রিটিক্যাল কেয়ার ব্লক, লাইফ সাপোর্ট, আইসোলেশন ওয়ার্ড, প্রসূতি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার— সব থাকবে এক ছাদের তলায়।
বাংলার মাটিতে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হল ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেশন টেকনোলজি এন্টারটেইনমেন্ট অ্যান্ড কালচারাল পার্ক (IITEC PARK) যার আক্ষরিক নাম হলো ‘বিশ্বঅঙ্গন’। বাংলার মুকুটে পশ্চিমের জগন্নাথ মন্দির, উত্তরের পর্যটন হাব, পূর্বের স্কাইওয়াক, দক্ষিণের জঙ্গল সাফারি যেমন বিরাজমান, তার সাথে ‘বিশ্বঅঙ্গন’ হল বাংলার মুকুটে এক নয়া পালক। ‘বিশ্বঅঙ্গন’ হল নিউ টাউন-এর জমিতে পরিকল্পিত এক আন্তর্জাতিক মানের পার্ক, যেখানে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা, সাংস্কৃতিক পার্ক, বিনোদন পার্ক-এর মতো যৌথ স্থাপত্য থাকবে। হিডকোর সাথে যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলার স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে যে নতুন মাত্রা যোগ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলার আধ্যাত্মিক ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা জগন্নাথধাম নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল যে কুৎসার আশ্রয় নিয়েছিল তার উত্তর স্বয়ং জগৎপ্রভু জগন্নাথ তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় হয়তো দিচ্ছেন, যেখানে মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে ২০ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয়েছে। দিঘাকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ জুড়েই ব্যবসা বাণিজ্যের যেন অনুকূল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ৭১ কোটি টাকার মনরেগা দুর্নীতি নিয়ে গুজরাতে হইচই পড়লেও পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যে মনরেগার প্রাপ্য টাকা আজও এল না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজ উদ্যোগে নিজস্ব তহবিল থেকে মনরেগা কর্মীদের কাজের ব্যবস্থা করেছে নানান প্রকল্পের মাধ্যমে। ১২৩৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কর্মশ্রী প্রকল্প’র আওতায় ৬১ কোটি শ্রমদিবস সৃষ্টি করা হয়েছে যা এক কথায় নজির। এছাড়াও ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জল্পেশ মন্দিরের স্কাইওয়াক নির্মাণ, শিলিগুড়িতে মেয়েদের জন্য রেসিডেন্সিয়াল গ্লোবাল স্কুলের স্থাপন এবং জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারে ৪টি নতুন শিল্প পার্ক গঠন পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে নবজাগরণের সৃষ্টি করবে। বাংলার অগ্রগতির ধ্বজাধারী মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও প্রমাণ করলেন পাহাড় থেকে সমতল, সমভূমি থেকে মালভূমি, জঙ্গল থেকে সমুদ্র, সর্বত্র রাজ্য সরকারের উন্নয়নের পতাকা পৌঁছে গেছে। নানান প্রতিকূলতা, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা সত্ত্বেও মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে অর্থের সংস্থান করে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা এক কথায় অকল্পনীয়। নর্থ বেঙ্গল হোক বা সাউথ বেঙ্গল শিল্পই যে পাখির চোখ তা আগামীর কান্ডারি বুঝিয়ে দিলেন বিশ্বদরবারে। (শেষ)
আরও পড়ুন: ইডেনের ম্যাচ সরানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, প্রতিপদে বঞ্চনা বাংলাকে : অরূপ