বন্যপ্রাণীর গল্পকার

বাবার মতোই ছকভাঙা জীবন বেছে নিয়েছেন তিনি। দেশের প্রথম সারির ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে অন্যতম ঐশ্বর্যা শ্রীধর। সম্প্রতি ভূষিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্মানে। তাঁর কথায় সোহিনী মাশ্চারক

Must read

একটা ছবি হাজার শব্দের সমান। ফটোগ্রাফি হল অনুভূতি, স্পর্শ ও ভালবাসার তথা ভাললাগার একটি বিষয়, পর্যবেক্ষণের শিল্প। একজন আলোকচিত্রী জীবন এবং মুহূর্তকে স্মৃতির পাতায় চিরজীবনের জন্য ধরে রাখে। উত্তর আধুনিক সময়ে আজকের নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে সব ধরনের পেশাতেই দক্ষ। লরি গাড়ি চালানোই হোক বা আকাশপথ এবং আরও নানান পেশায় যে পেশা কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল সেই অচলায়তন ভেঙে বিজয়কেতন উড়িয়েছে নারী। গার্ডা টারো ছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রের এক আলোকচিত্রী— যে-যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে একজন নারীর পক্ষে যাওয়া ছিল কল্পনার অতীত যে-যুগে তিনি তাঁর কর্মদক্ষতার সাক্ষর রেখে কালজয়ী হয়েছিলেন। সেরকমই আজকের যুগের এক নারী হলেন ঐশ্বর্য শ্রীধর— যিনি আলোকচিত্রী হিসাবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। দেশের প্রথম সারির ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে অন্যতম নাম এখন এই ঐশ্বর্যা শ্রীধর (Aishwarya Sridhar)। যিনি কেবলমাত্র একজন ভারতীয় বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার এবং বন্যপ্রাণী উপস্থাপকই নয়, একজন তথ্যচিত্র নির্মাতাও।

ছেলেবেলা থেকেই ছবি তুলতে খুব ভালবাসত মেয়েটা— ১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি ভারতের মুম্বইয়ে একটি তামিল পরিবারে ঐশ্বর্যার জন্ম, সেখানেই বড় হয়ে ওঠা। তাঁর বাবা শ্রীধর রঙ্গনাথন এবং মা রানি শ্রীধর। বম্বে ন্যাচরাল হিস্ট্রি সোসাইটি-র সদস্য ছিলেন শ্রীধর রঙ্গনাথন। কর্মসূত্রে তাঁকে প্রায়ই যেতে হত দুর্গম পাহাড়ের বনে জঙ্গলে। সে-সব অভিযানে সঙ্গী হত ছোট্ট মেয়ে ঐশ্বর্যা (Aishwarya Sridhar)। বাবার মতোই ছকভাঙা জীবন বেছে নিয়েছিল ঐশ্বর্যা। ফটোগ্রাফির সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাতেও তুখোড় সে। ড. পিল্লাই গ্লোবাল অ্যাকাডেমির এই ছাত্রী ২০১৩ সালে কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল পরীক্ষায় বিজনেস স্টাডিজে বিশ্ব শীর্ষস্থানীয়। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণমাধ্যমে স্নাতক।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে ফটোগ্রাফির প্রতি ভালবাসা শুরু হয়। ছোটবেলা থেকেই ঐশ্বর্যা মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরির জঙ্গলে ট্রেকিং শুরু করেছিল।
তার প্রথম তথ্যচিত্র ‘পাঞ্জে-দ্য লাস্ট ওয়েটল্যান্ড’ ২০১৮ সালে ডিডি ন্যাশনাল-এ সম্প্রচারিত হয়। এটি ছিল পাঞ্জে নামের উরানের শেষ অবশিষ্ট জলাভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে। জলাভূমি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই তথ্যচিত্র ছিল প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। ছবিটি জলাভূমি পুনরুদ্ধার বন্ধ করার জন্য বোম্বে হাইকোর্টের একটি আদেশ আনতে সাহায্য করেছিল।
ঐশ্বর্যা সর্বকনিষ্ঠ মেয়ে যিনি স্যাঙ্কচুয়ারি এশিয়া-ইয়ং ন্যাচারালিস্ট অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন ২০১১ সালে। ২০২০ সালে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার জিতেছিলেন। এর আগে কোনও ভারতীয় মেয়ে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিতে বর্ষসেরার পুরস্কার জেতেননি। প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসাবে এবার সেই ইতিহাস গড়েছেন ভারতের ঐশ্বর্য শ্রীধর। যে ছবিটার জন্য ঐশ্বর্য বর্ষসেরার খেতাব পেয়েছে তার নাম লাইটস অফ প্যাশন। বনের মাঝে দাঁড়িয়ে একটি গাছ। আর সেই গাছটিকে ঘিরে ঘিরে ঘুরছে হাজারো জোনাকি। গাছটির উপর প্রকৃতির আলো ঠিকরে পড়েছে। আর ব্র্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে রয়েছে তারা-ভরা আকাশ। মূলত রাতের অন্ধকারে জঙ্গল ঘিরে জোনাকিদের ছায়াপথ বা জোনাকিদের নক্ষত্রপুঞ্জকে লেন্সবন্দি করেছিলেন, ঐশ্বর্য যে ক্যাটেগরি-তে পুরস্কার জিতেছেন সেখানে শর্ত ছিল, মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর ছবি দিতে হবে। সেটা জলে, ডাঙায় বা বাতাসে, যে-কোনও জায়গায় হতে পারে। ভান্ডারদ্বারাতে ট্রেক করার সময় সেই ছবিটি তুলেছিলেন ঐশ্বর্য। তবে ছবিটি তুলতে গিয়ে পথে নিশাচর বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে গাছের শিকড়ে পা বেঁধে হোঁচট খাওয়া— এই সব ধরনের অভিজ্ঞতাই হয়েছিল তার কিন্তু সব কষ্ট ম্লান হয়ে গিয়েছিল জোনাকিদের লক্ষ আলোর সৌন্দর্য দেখে এবং তাকে লেন্সবন্দি করতে পেরে। আর সেই লেন্সবন্দি করার ফলাফল এই আন্তর্জাতিক খেতাব তা বলাইবাহুল্য। তিনি জানতেন পশ্চিমঘাট জঙ্গলে বর্ষায় জোনাকিদের মেলা বসে। তাই সেই ছবি তুলতে পানভেলে নিজের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন ভান্ডারডারা। তার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে আড়াই ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছেছিলেন সহ্যাদ্রির ঢালে ঘন বনে। সেখানেই জোনাকিদের ছায়াপথ সামনে এনেছিলেন তার ক্যামেরার সাহায্যে। ইংল্যান্ডের ন্যাচরাল হিস্ট্রি মিউজিয়ম আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় সারা পৃথিবীর ৮০টি দেশের আলোকচিত্রীদের মোট ৫০ হাজার ছবির মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল যে ১০০টি ছবি তার মধ্যে আছে ঐশ্বর্যার তোলা ছবিটিও। প্রথম মহিলা ভারতীয় আলোকচিত্রী এবং কনিষ্ঠতম প্রতিযোগিনী হিসেবে এই সম্মান ঐশ্বর্য পেয়েছেন।

আরও পড়ুন-ঘরে ফিরলেন পূর্ণম সাউ

সুন্দরবনের বাঘিনি মায়াকে নিয়ে ঐশ্বর্যার তথ্যচিত্র ‘দ্য কুইন অব তরু’ সাড়া জাগিয়েছিল। মহারাষ্ট্রের তাড়োবা অভয়ারণ্যে ৬ বছর ধরে মায়াকে লেন্সবন্দি করেছেন ঐশ্বর্যা। সেই ছবি ও ভিডিও সম্পাদনা করেই তৈরি হয়েছে এই তথ্যচিত্র। নবম ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (WCFF) বা বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ চলচ্চিত্র উৎসবেও পুরস্কৃত হয়েছিল। ২৮ বছরের ঐশ্বর্যার ঝুলিতে এরই মধ্যে রয়েছে তামিলনাড়ুর গভর্নরের তরফ থেকে পাওয়া ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড এবং ‘ওম্যান আইকন ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ তবে এতেই শেষ নয় প্রকৃতির প্রতি তাঁর অবদানের জন্য অসংখ্য পুরস্কার ঐশ্বর্যা (Aishwarya Sridhar) পেয়েছেন।

শ্রীধর কন্যাটি যে নিজেকে কেবলমাত্র আলোকচিত্রী হিসাবে সীমাবদ্ধ রেখেছে তা কিন্তু নয়, ছোট থেকেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠেছেন বলে তিনি খুবই অনুভূতিপ্রবণ আর ঠিক সেই জন্যই প্রকৃতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা। তিনি পরিবেশ সংরক্ষণেও সক্রিয়ভাবে জড়িত। ঐশ্বর্যা বোম্বে হাইকোর্ট কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছেন রাজ্য জলাভূমি শনাক্তকরণ কমিটির সদস্য হিসেবে।
তবে ঐশ্বর্যা জানিয়েয়েছন, অন্যান্য পেশার মতো এখানেও তাঁকে বারবার লিঙ্গ বৈষ্যম্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে কিন্তু তাঁর নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার অদম্য ইচ্ছে ও প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে এবং কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বেশ কিছু উৎসাহী মানুষের উপস্থিতি তাঁর চলার পথকে সহজ করেছে। অতিসম্প্রতি রাজস্থানের ঝালনায় পুরুষ চিতাবাঘ ‘রানা’র উপর নির্মিত তাঁর সাম্প্রতিক তথ্যচিত্রের জন্য তিনি আবার খবরের শিরোনামে এসেছেন। এই তথ্যচিত্রটির মূল চরিত্র রানা নামক চিতাবাঘটি। এই চিতাবাঘটি কীভাবে তার নিজের বাবাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে সে কীভাবে বেড়ে ওঠে, তার জীবনকাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। সদ্য অস্ট্রিয়া/ জার্মানিতে ServusTV-তে এই তথ্যচিত্রটির প্রিমিয়ার হয়েছে এবং এখন ফ্রান্সে Arte-তে এটি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সম্মান ও খেতাব ২৮ বছর বয়সি এই তরুণীর ঝুলিতে, তাঁর বিভিন্ন কাজ বিবিসি ওয়াইল্ডলাইফ, দ্য গার্ডিয়ান, স্যাংচুয়ারি এশিয়া, সেভাস, হিন্দুস্তান টাইমস, মুম্বাই মিরর, ডিজিটাল ক্যামেরা, মাতৃভূমি এবং মঙ্গাবেতে প্রদর্শিত হয়েছে। তবে এসব নিয়ে না ভেবে ঐশ্বর্য নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে ভবিষ্যতেও আরণ্যক গন্ধ গায়ে মেখে বন্যপ্রাণকে ফ্রেমবন্দি করে যেতে চান।

Latest article