আক্রান্ত বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতি, আক্রান্ত বাঙালির অস্মিতা

বঙ্গবিরোধী এক শক্তি গ্রাস করতে চাইছে। ভাঙতে চাইছে আমাদের সংহতি, ঐক্য, মিলেমিশে যাপনের সংস্কৃতি। এই অশুভ শক্তির হানাদারি থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে একজোট হতেই হবে আমাদের। আসুন দুর্বৃত্তদের বুঝিয়ে দিই, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি। চেতনা উন্মীলনের সুর বেঁধে কলম ধরলেন শমিত ঘোষ

Must read

উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি কি ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে বাঙালির জীবনে? গোবলয় কি তবে গিলে খাবে আমাদের? ট্রেনে বাসে, রাস্তা-ঘাটে চলতে ফিরতে আজকাল প্রায়ই এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায়। বাঙালীর নিজস্ব যে অস্মিতা, তা কি বিপন্ন? আগামী একটা বছর বাঙালীর কাছে অগ্নিপরীক্ষা। সে, তাঁর নিজস্ব অস্মিতা, নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে, নাকি গোবলয়ের ভয়াবহ ‘ডিজে’র তাণ্ডব তাকে গিলে খাবে?

আরও পড়ুন-বজ্রাঘাত থেকে বাঁচাতে তালগাছ লাগাচ্ছেন শিক্ষক

বিজেপি দিনের শেষে একটি গোবলয়ের রাজনৈতিক দল! তাদের আচার আচরণে, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁর প্রতিফলন স্পষ্ট! ধরা যাক, রামনবমী পালন। প্রথমত, শ্রীরামের জন্মতিথি একটি অত্যন্ত পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। এটি কোনও মতেই রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে না। কিন্তু, প্রতিবছর এপ্রিল মাস এলেই বঙ্গীয় বিজেপির নেতারা হঠাৎই প্রবলভাবে জেগে ওঠেন! ইংরেজিতে যাকে বলে ‘হাইপার অ্যাক্টিভ’ হয়ে ওঠেন। পাড়ায় পাড়ায় ফ্লেক্স লাগানো হয়, ‘রামনবমী পালন করুন’। তারপরে অস্ত্র এবং ডিজে-সহ মিছিল বের হয় বাংলার নানা প্রান্তে। বিজেপি নেতাদের একইরকম উন্মাদনা বাংলার বড় উৎসব দুর্গাপুজোর সময় কি দেখা যায়? অথবা, এই যে ক’দিন আগে পয়লা বৈশাখ গেল। কতজন বিজেপি নেতাকে পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে দেখেছেন? দেখেননি! দেখবেন না। কারণ, বিজেপি আরএসএস আসলে তাদের উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিকেই বাংলায় চাপিয়ে দিতে চায়। এই সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বিজেপি বা সংঘ পরিবার তাদের ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানে’র সেই বহুচর্চিত নীতিটিরই প্রয়োগ ঘটাতে চান! এখানে ‘হিন্দু’ শব্দটির প্রয়োগ দেখে কোনও এক হিন্দু বাঙালি পাঠক চোখ কুঁচকাতেই পারেন। তাঁর মনে হতেই পারে, তিনিও তো হিন্দু বাঙালি! তাহলে বিরোধ কোথায়?
আসলে বিজেপির হিন্দুত্ব ও আমাদের বাংলার যে হিন্দুত্ব তাঁর মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য! বিজেপির কাছে ‘সেহী হিন্দু’র সংজ্ঞা হল এমন এক ব্যক্তি যিনি ‘শুদ্ধ শাকাহারি’! যিনি আমিষভোজন করেন না! যেমনটা উত্তর ভারতের নিয়ম। কয়েকদিন আগেই দিল্লিতে মাছের বাজার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা স্মর্তব্য। অথচ, বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে ভোগ হিসেবে দেবতাকে মাছ এবং পাঁঠার মাংস দেওয়ার নিয়ম রয়েছে কয়েকশো বছর ধরে।

আরও পড়ুন-সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী-তে ফোন ৩৬ দিনমজুরের কর্মসংস্থান

এই বাংলার নদীয়ার কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো তন্ত্রসাধকের হাত দিয়ে শ্মশানচারিণী দেবীর যে অর্চনা কিংবদন্তিতে পরিণত হয়, সময়ের স্রোতে ক্রমে সেই শ্মশানচারিণী দেবীকে ঘরের মেয়ে করে তোলেন আরেক সাধক রামপ্রসাদ সেন। শ্মশানচারিণী রুদ্রমূর্তি দেবী হয়ে ওঠেন বাংলার ঘরের মেয়ে। যার কাছে আবদার করা যায়। অভিমান করা যায়। আবার রাগও করা যায়! রামপ্রসাদ লিখে ফেলেন—
‘‘এবার কালী তোমায় খাব।
(খাব খাব গো দীনদয়াময়ী)
তারা গণ্ডযোগে জন্ম আমার॥
গণ্ডযোগে জন্ম হলে
সে হয় যে মা-খেকো ছেলে।”
এভাবেই দশমহাবিদ্যার অন্যতম রূপ কালী হয়ে উঠলেন বাংলার ঘরের মেয়ে। বিজেপি বা আরএসএস এই লৌকিক ধর্ম বুঝবে কী করে? কারণ, তাদের রাজনীতির ডিএনএ-তে রয়েছে উত্তরভারতীয় হিন্দুত্বের সংস্কৃতি! যার সঙ্গে বাংলার হিন্দু ধর্মের যোজন যোজন পার্থক্য! আবার ধরুন, শিব বা মহাদেব। বাংলায় শিবের যে ‘ইমেজ’ তা কিন্তু গোবলয়ের শিবের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গোবলয়ের শিব, হল যাকে বলে ‘হিম্যান’। তাঁর রয়েছে সিক্স প্যাক অ্যাবস! রুদ্রমূর্তি! আর বাংলায় সেই শিব আত্মভোলা। নন্দীভৃঙ্গিকে নিয়ে ছাই মেখে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ান। কলকে থেকে গাঁজা খান। তার বউ পার্বতী তাকে ঝাঁটা নিয়ে তাড়া করে। এখানে শিব যেন, বাঙালির ঘরের সেই পুরুষ মানুষ, যিনি তাঁর রাগী কড়া স্ত্রী’কে ভয় পাচ্ছেন। কালীঘাটের পটচিত্রে এমন বহু ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি। বাংলার লৌকিক সংস্কৃতি চড়ক বা গাজনে আমরা শিবকে নিয়ে এরকম নানা মজা করতে দেখছি! আবার উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিশেষত মালদহ এবং খানিকটা দিনাজপুরে একটি স্থানীয় লোকজনাট্য হল ‘গম্ভীরা’। যে-নাট্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয় নিয়ে রঙ্গ তামাশা হয়। এবং সবকিছু নিয়ে অভিযোগ জানানো হয় ‘নানা’র কাছে। ‘নানা’ কে? না শিব! শিব বা নানা সেই সব নাট্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বাংলার নিজস্ব যে লৌকিক সংস্কৃতি, তা এভাবেই নিজস্ব জল হাওয়া বাতাসে তাঁর দেবতাকে গড়ে নিয়েছে।
গোবলয়ের বিজেপি নেতারা এইসব সংস্কৃতি বোঝে না। বোঝার দায়ও নেই! তারা চায় আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। একটি জাতিকে কবজা করতে হলে সবার আগে জরুরি তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বহিরাগত সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়া। এবং জাতির নিজস্ব লৌকিক ধর্মকে ধ্বংস করা!
‘হিন্দুত্ব’ নিয়ে বড় বড় আওয়াজ তোলা বিজেপি নেতাদের কোথাও কখনও দেখেছেন, চড়ক, গাজন নিয়ে কোনও কথা বলতে? এই যে গোটা চৈত্র-বৈশাখ মাস জুড়ে অসংখ্য শীতলার থানে, বাংলার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পুজো দেয় তা নিয়ে একটা শব্দ খরচ করেছেন বিজেপি নেতারা? কারণ, এটা ওদের ‘আউট অফ সিলেবাস’! বঙ্গীয় বিজেপির নেতাদের (পড়ুন তোতাপাখিদের) গোবলয়ের বিজেপি নেতারা ঠিক যতটুকু বলতে বলেন, ওঁরা ততটুকুই বলেন। আর উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা অমিত মালব্য, সুনীল বনসলরা তো জানেনই না বাংলার লৌকিক ধর্মটা কী? খায় না মাথায় দেয়? এই বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে বনবিবি, ওলাবিবির থানে পুজো দেয় এই বাংলার হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মেরই মানুষেরা এটা ওরা জানেন না। তাই, গোবলীয় সাম্রাজ্যবাদীরা আপনার সংস্কৃতিকে মুছে দিতে চায়। রামনবমী পালিত হয় বাসন্তী পুজোর নবমী তিথিতে। আর বাসন্তীপুজোর অষ্টমীর দিনে পালিত হয় মা অন্নপূর্ণার পুজো। বাংলার প্রাচীন মঙ্গলকাব্য অন্নদামঙ্গলে মা অন্নপূর্ণার গুণকীর্তন করে লিখেছিলেন রায়গুণকার ভারতচন্দ্র। সেই মঙ্গলকাব্যের চরিত্র ঈশ্বরী পাটনি মা অন্নপূর্ণাকে বলছেন, ‘‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে…” অথচ, দুর্ভাগ্য আমাদের গোবলয়ের সংস্কৃতি আমাদের এতটাই গ্রাস করেছে যে আমরা আজ ‘অন্নদামঙ্গল’ ভুলে গেছি। রামনবমীর আগের দিন যে অন্নপূর্ণা পুজো হয়, সেটাই আজ বাঙালিকে ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে গোবলয়ের রাজনীতির কারবারিরা। সত্যপিরের মাজারের গাছে যে হিন্দুবাড়ির মহিলারাও মানত করে, ঢিল বাঁধে। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কালু রায়, দক্ষিণ রায়ের পুজো করে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই মানুষ। এসব সত্যিকে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন।

আরও পড়ুন-৮ বছর পর টেস্ট দলে করুণ, সুযোগ অভিমন্যুকেও, নেতা শুভমনই, বাদ শামি

মনে রাখা দরকার, ঠিক একবছর বাদে বাংলায় যে নির্বাচন হবে তা কেবলই একটি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের নির্বাচন নয়৷ তা, আসলে বাংলার সংস্কৃতির ওপর গোবলীয় আগ্রাসনকে রুখে দিয়ে নিজেদের অস্মিতাকে বাঁচানোর নির্বাচন। রাজনৈতিক পাকদণ্ডীর চেয়েও যা বহু গুরুত্বপূর্ণ! একটি জাতি যদি নিজস্ব লৌকিক সংস্কৃতি, নিজস্ব ধর্মকেই রক্ষা করতে না পারে, ভবিষ্যতে সেই জাতির ধ্বংস হওয়া সময়ের অপেক্ষা। কারণ, একটি জাতির নিজস্বতা নির্ণয় করে তাঁর নিজস্ব লৌকিক আচার। লৌকিক ধর্ম। যা তাকে স্বতন্ত্র করে।
বাঙালি জাতি একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে৷ এই একটা বছর পক্ষ নেওয়ার। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দাঁত-নখ বের করে বাঙালির নিজস্ব অস্মিতাকে ধ্বংস করতে তৎপর। যে শক্তি বাঙালির খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে বাঙালির বিয়েবাড়ির রীতি-রেওয়াজ অবধি বদলাতে তৎপর। এই গোবলয়ীও শক্তি যদি আরও জাঁকিয়ে বসে, তাহলে ভবিষ্যতের কোনও এক ইতিহাস বইয়ে লেখা হবে, ‘‘বাঙালি বলে কোনও একদিন একটি জাতি ছিল। গোবলয়ের সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণে সেই জাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়…”।
সুতরাং, আসুন! রুখে দিই ওদের দাঁত আর নখ। হারিয়ে দিই ওদের অপচেষ্টা। পর্যুদস্ত করি ওদের নোংরামিকে।

Latest article