বদলে গিয়েছে ছবি
ফাশিচা ডোঙ্গার একটি পরিচিত বনভূমি। মহারাষ্ট্রের নাসিক শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। জানা যায়, এখানেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিলেন। তাই এই নামকরণ। যেন কয়েক দশক ধরে অতীতের বোঝা বয়ে নিয়ে চলেছে বনভূমিটি। একটা সময় অনুর্বর ভূখণ্ডের মতো ছিল। দেখা যেত কয়েকটি গ্লিরিসিডিয়া গাছ। এখন আর সেই পরিবেশ নেই। সম্পূর্ণ বদলে গেছে ছবি। বর্তমানে ফাশিচা ডোঙ্গারে গড়ে উঠেছে মনুষ্যসৃষ্ট অরণ্য। ২৭৫টি স্থানীয় প্রজাতির ৩৩,০০০-এরও বেশি গাছ রয়েছে। সেইসঙ্গে ৭০ প্রজাতির প্রজাপতি, ১০০ প্রজাতির পাখি এবং প্রাণীর আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। মানুষের হাতে তৈরি এই বনাঞ্চলে আছে ময়ূর, শজারু, টিকটিকি, হায়না, চিতাবাঘ প্রভৃতি। এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে স্থানীয় প্রকৃতিপ্রেমী, নাগরিক গোষ্ঠী এবং শহরের ছাত্রদের উদ্যোগে।
সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ
অসাধ্যসাধন করেছেন শেখর গায়কোয়াড়। তিনি এই উদ্যোগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ৫৭ বছর বয়সী হাসি মুখের মানুষটি তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে গাছ সংরক্ষণ এবং ভূদৃশ্য পুনরুদ্ধারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। শহরে এবং তার আশপাশে মাঝে মাঝেই তিনি স্বেচ্ছাসেবক, ছাত্রছাত্রী এবং বাসিন্দাদের সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে গাছ লাগানো এবং জল দেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেন। এই কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৫ সালে নাসিক বন বিভাগ ফাশিচা ডোঙ্গারে ২৮ হেক্টর বনভূমিতে পুনর্জন্ম কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য শেখর গায়কোয়াড়কে অনুমতি দেয়। সেই বছর, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, নাসিক জুড়ে বহু মানুষ শেখর গায়কোয়াডে়র সঙ্গে অনুর্বর বনভূমি পুনরুদ্ধারে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছিলেন। রীতিমতো উৎসবের মেজাজে। প্রত্যেকের হাতে একটি স্থানীয় গাছের চারা এবং এক বোতল জল তুলে দেওয়া হয়। সেইদিন এলাকাজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১১,০০০ স্থানীয় গাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। লোকেরা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। সেই চারা বড় হয়ে পরিণত হয়েছে বৃক্ষে। তিন বছরের মধ্যে গাছের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে গিয়েছে এবং বনভূমি ঘাস, গুল্ম এবং লতার পুরু স্তরে ভরে উঠেছে। পাখি এবং বন্যপ্রাণীও ফিরে এসেছে।
আরও পড়ুন-পূর্ণমকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান কৃতজ্ঞ রজনী
পবিত্র বনভূমি
স্থানীয় সম্প্রদায়ের দ্বারা পরিচালিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা ফাশিচা ডোঙ্গারকে এখন দেবরাই বা পবিত্র বন বলা হয়। শেখর গায়কোয়াড় ব্যাখ্যা করেছেন, পবিত্র বনভূমি হল প্রাকৃতিক গাছপালার টুকরো, যা ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ সম্প্রদায় দ্বারা সংরক্ষিত। সাধারণত পবিত্র বনভূমিতে একটি দেবতা থাকেন, যাঁকে সম্প্রদায়ের সদস্যরা পুজো করেন। তাঁরা কখন বনাঞ্চলে প্রবেশ করতে হবে, কোন ঋতুতে কোন এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে এবং কত সম্পদ আহরণ করতে হবে, সেই সম্পর্কে কঠোর নিয়ম এবং বিধিনিষেধও মেনে চলেন। এই কারণেই, পবিত্র বনভূমি হল উদ্ভিদ এবং প্রাণী প্রজাতির মূল্যবান জেনেটিক সম্পদের ভাণ্ডার। আমরা বনের পবিত্রতা বজায় রেখে এই নীতিটি অনুসরণ করার চেষ্টা করছি। নাসিক দেবরাই তাই শুধুমাত্র সপ্তাহান্তে দর্শনার্থী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সপ্তাহের বাকি সময়গুলিতে বন্ধ থাকে।
উন্মুক্ত গ্রন্থাগার
ক্ষুদ্র-বন তৈরি করে জমি এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধারের জন্য সম্প্রদায়ের অনুরূপ প্রচেষ্টা মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়। বেশিরভাগ জায়গায়, এই উদ্যোগগুলো পরিচালিত হয় ব্যক্তিদের আবেগ থেকে। পুণেতে, নয়না নারগোলকার ১৯৮৯ সাল থেকে একটি পবিত্র বনের লালন-পালন করছেন। তাঁর স্বামী প্রমোদ নারগোলকার ছিলেন একজন উদ্যোক্তা, শহরের উপকণ্ঠে গোড়হে খুর্দে ৫.২ হেক্টর জমি কিনেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন মনুষ্যসৃষ্ট অভয়ারণ্য, সিপনা। তিনি বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী ছিলেন। বীজ এবং গাছপালার চারা সংগ্রহ করতেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে জমিটি কিছু অংশে কিনেছিলেন এবং রোপণ এবং লালন-পালন শুরু করেছিলেন। ২০০০ সালে, একজন কিশোর আনন্দ আল্লাগি কাজের সন্ধানে এসেছিলেন এবং তখন থেকেই সিপনার সঙ্গে আছেন। স্বামী সম্পর্কে ৭০ বছর বয়সী নয়না বলেন, ‘‘তিনি একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন এবং জমিতে মেলঘাট বনের বাস্তুতন্ত্রের প্রতিলিপি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। বছরের পর বছর ধরে আমরা আরও ১৩ হেক্টর জমি কিনে সেখানে স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগিয়েছিলাম।’’ ২০০৪ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণের সময় প্রমোদ নিখোঁজ হয়ে যান। পড়েন ভয়াবহ সুনামির কবলে। তারপর থেকে নয়না এবং তাঁর ছেলে আমোল বনের যত্ন নিচ্ছেন। যেহেতু এতে অনেক টাকা লাগে, তাই সিপনা এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। এত বড় এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ প্রতি মাসে প্রায় ৪০,০০০ টাকা। বন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু খুব বেশি সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। কারণ এটা একটা ব্যক্তিগত বন। তবে বনপ্রেমীদের একটি দল কিছু সাহায্য করেছে। এই অরণ্য এখন শিক্ষার্থী এবং গবেষকদের দ্রুত হারিয়ে যাওয়া জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে জানার জন্য একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার হিসেবে কাজ করছে। গাছ ছাড়াও, জায়গাটি পোকামাকড়, অণুজীব, সরীসৃপ, কৃমি এবং লাইকেনে পরিপূর্ণ।
আরও পড়ুন-রাজ্যে প্রথম, উত্তরদিনাজপুর জেলায় মডেল অঙ্গনওয়াড়ি
বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ
প্রকৃতিবিদ রঘুনাথ ঢোল। পুনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভৌত রসায়নে বিশেষায়িত বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। কৃষিকাজ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, আবাসিক, বাণিজ্যিক, কর্পোরেট এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বাগানের ভূদৃশ্য গঠনে তাঁর ১৫ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে। বেশকিছু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বহু সংবাদপত্রে তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভারতের স্থানীয় বনজ গাছের প্রজাতির একটি বীজ ব্যাঙ্ক তৈরি করেছেন এবং ক্ষুদ্র-অরণ্য বা পবিত্র বন স্থাপন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়কে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি শুধুমাত্র মহারাষ্ট্রের বন থেকে ২০০ প্রজাতির গাছের বীজ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করেছেন। রঘুনাথ ঢোল বলেন, ‘‘কিছু পরিবেশ সচেতন নাগরিক তাঁদের বাড়ির উঠোন, বন বা অন্যান্য জায়গা থেকে স্থানীয় জাতের গাছের বীজ সংগ্রহ করে ডাকযোগে আমাদের কাছে পাঠান।’’ গত দশকে, তিনি মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং কর্নাটক জুড়ে ৩৮৭টিরও বেশি গাছ তৈরিতে সম্প্রদায়গুলিকে সহায়তা করেছেন। তাঁর লক্ষ্য বনের মধ্যে বিশাল জীববৈচিত্র্য এবং বাস্তুতন্ত্রের প্রতিলিপি তৈরি করা। তাই প্রতিটি ক্ষুদ্র বন কমপক্ষে ০.৪ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত এবং প্রায় ১৫০ প্রজাতির বাসস্থান। রঘুনাথ ঢোল জানিয়েছেন, ‘‘একটি প্রচলিত বনায়নে এত বিস্তৃত প্রজাতির গাছ থাকে না। এই স্থানীয় গাছগুলো পাখিদের আবাসস্থল, তাদের খাদ্য সরবরাহ এবং জল সংরক্ষণে সহায়তা করে পরিবেশগত পরিষেবা প্রদান করে।’’ তিনি ব্যাখ্যা করেন, গাছগুলো একটি পদ্ধতিগত গুচ্ছের মধ্যেও রোপণ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিটি প্রজাতির চারটি গাছ একটি বর্গক্ষেত্র বা একটি রেখায় একত্রিত করা হয়, যা মাটিতে পড়লে বীজ সহজেই সংগ্রহ করা যায়।
আরও পড়ুন-বজ্রাঘাত থেকে বাঁচাতে তালগাছ লাগাচ্ছেন শিক্ষক
খরা কবলিত গ্রামে সবুজায়ন
জীববৈচিত্র্যের সম্পদ, যার মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ, প্রাণী এবং ছত্রাক। বিশেষ করে জীবিকার জন্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার ভেলু গ্রামের প্রধান তথা প্রকৃতিপ্রেমী দুর্যোধন নানাওয়ারে কয়েক দশক আগে গ্রামের বাসিন্দাদের সহযোগিতায় ঐতিহ্যবাহী গাছের প্রজাতিগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি পবিত্র বন স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘আজকাল, বেশ কিছু স্থানীয় গাছ খুঁজে পাওয়াও কঠিন। তাই, ১৯৭২ সালে আমরা ভয়াবহ খরা কবলিত গ্রামের একটি কৃত্রিম হ্রদের ধারে প্রায় ১,০০০ গাছ রোপণ করেছি।’’ জানা গিয়েছে, তাঁদের লক্ষ্য ছিল একটি ক্ষুদ্র বন তৈরি করা, যা ছায়া দেবে এবং গবাদি পশুদের জন্য চারণভূমি হিসেবে কাজ করবে। জমিটি বেড়াবিহীন এবং বাঁশের ঝোপঝাড় দিয়ে ঘেরা, যাতে বড় প্রাণীদের থেকে ন্যূনতম সুরক্ষা পাওয়া যায়। ছাগলরা গাছপালা খাওয়ার জন্য অবাধে ঘুরে বেড়ায়। তিনি জানান, ‘‘মানুষের তৈরি বনে পাখি এবং মৌমাছিরা উড়ে উড়ে আসে। দেখতে ভাল লাগে।’’
আরও পড়ুন-চোর অপবাদে আত্মঘাতী নাবালক দায়ী কে, তা নিয়ে চাপান-উতর
আরও সচেতনতা প্রয়োজন
প্রাকৃতিক বনের মতো, এই মানবসৃষ্ট পবিত্র বনগুলোও রোগ, কাঠ কাটা এবং দখলের মতো হুমকির সম্মুখীন হয়। বাবান সাবলে, যিনি প্রায় ০.৮ হেক্টর আখ জমির পরিবর্তে প্রায় ১,০০০ বন প্রজাতির গাছ দিয়ে একটি পবিত্র বন তৈরি করেছেন, তিনি বলেন, ‘‘পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকরা চাননি যে তাঁদের ফসলের বৃদ্ধিতে কোনও ছায়া বাধা হয়ে দাঁড়াক। তাঁরা সীমান্তের কিছু গাছ কেটে ফেলেছেন।’’ তিনি আরও বলেন যে, তাঁর খামারের মাঝখানে একটি বন থাকার ফলে তাঁর ধানের ফলন ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাল পোকামাকড় এবং মাটিতে জৈব পদার্থের বৃদ্ধি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। বনটি বছরজুড়ে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ধরে রাখতে সাহায্য করেছে, যার ফলে তিনি আগের তুলনায় বছরে দুটি ফসল আশাব্যঞ্জকভাবে পাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন যে, জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব বোঝার জন্য মানুষের আরও সচেতনতা প্রয়োজন।
চলছে গাছ কাটা
এতকিছুর পরও চিন্তিত অরণ্যের বন্ধু বা রক্ষক শেখর গায়কোয়াড়। কারণ, দুর্বৃত্তরা প্রায়শই বনের এক টুকরো অংশে আগুন ধরিয়ে দেয় বা নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলে। তাই তাঁরা সম্প্রদায়ের তহবিল এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার অধীনে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে এখন বনে টহল দেওয়ার জন্য দু’জন নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছেন। নয়না নারগোলকারের বনও আগের তুলনায় কিছুটা ছোট হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে, অবহেলা, দখল এবং অবৈধভাবে কাটার কারণে এর অবনতি ঘটেছে। পবিত্র বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের কারণে, বন কর্মকর্তারা এটাকে একটি সম্প্রদায় বন হিসাবে ঘোষণা করার পরামর্শ দিচ্ছেন, যাতে এটা যথাযথ সুরক্ষা পায়। তাই তাঁরা বনের ভেতরে একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছেন, যা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হবে এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।