ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছিল তমলুক। সেই আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায় (Ajoy Mukherjee)। ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন তমলুকে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কারণ ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন ‘মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ ঘোষণা হয়েছিল। স্বাধীন সরকার গঠনের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন তিনি।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরোদমে চলছে। পাশাপাশি ভারতে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা পুঞ্জীভূত হচ্ছে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু তখন ভারতের বাইরে। সেখান থেকে চালাচ্ছেন তাঁর সংগ্রাম। দেশে রয়েছেন মহাত্মা গাঁধী। তাঁকে ঘিরেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছেন তামাম ভারতবাসী। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দিলেন মহাত্মা গাঁধী। আর তাঁর একডাকে ভারত জুড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পথে নামলেন ভারতবাসী। ওই ঘটনায় প্রমাদ গুনল ব্রিটিশ শাসকরা। আন্দোলনের শুরুতেই একাধিক কংগ্রেস নেতাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ। গ্রেফতার করা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকেও। নেতৃত্বের একটা বড় অংশ জেলে চলে যাওয়ার ফলে প্রভাব পড়েছিল আন্দোলনেও। সেই সময়ে পুরো আন্দোলনের রাশ নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছিল জনগণ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশের বড় শহরগুলির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শহর, গ্রাম-জনপদেও আন্দোলন ছড়িয়ে যায়। ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক হিসেবে থানা থেকে আদালত, ডাকঅফিস— সবকিছুর উপরই হামলা হতে শুরু করে। বেশ কিছু এলাকায় হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। অনেক জায়গায় স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে আন্দোলন। ঠিক এই সময়েরই আশেপাশে দেশের বেশ কিছু এলাকায় তৈরি হয়েছিল জাতীয় সরকার। সেগুলিরই মধ্যে একটি হল বাংলার বুকে তৈরি হওয়া তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। যাঁদের হাতে এই সরকার তৈরি হয়েছিল তাঁরা হলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীলকুমার ধাড়া। তাঁরা তিনজনই মেদিনীপুরের কংগ্রেস নেতা ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হওয়ার পরপরই দমনমূলক নীতি নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। সারা দেশের মতোই মেদিনীপুর জেলাতেও গ্রেফতার করা হয়েছিল জেলার একাধিক নেতাকে।
ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরুর পর একমাস কেটেছে। সেই সময়েই তৎকালীন মহিষাদল থানা এলাকায় থাকা দানিপুর গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে। ওই এলাকায় একটি গুদাম থেকে ব্রিটিশদের জন্য পাঠানো হচ্ছিল ধান ও চাল। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেখানে ভিড় করেন বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী। মিলের মালিককে বলা হয় এভাবে বাইরে খাদ্যশস্য না পাঠাতে, তাহলে এলাকায় খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এই ঝামেলার কথা শুনে সেখানে আসে ব্রিটিশ পুলিশ। নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর গুলি চালিয়েছিল তারা। ওই ঘটনায় প্রাণ দিয়েছিলেন তিনজন গ্রামবাসী। ওই ঘটনার পরেই যেন বিদ্রোহের বীজ নিহিত হয়ে গিয়েছিলে গোটা তমলুকের বাসিন্দাদের মনে।
১৯৪৩ সালের ২৬ জানুয়ারি এই বিষয়ে একটি ঘোষণাপত্র বেরোয় ‘বিপ্লবী’ পত্রিকায়। সেখানে বলা হল, মহকুমার মানুষ তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠা করেছে। সেই সরকারের স্বরাষ্ট্র এবং অর্থের দায়িত্বে ছিলেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়। ঘোষণা পত্রে বলা হল, ভারত যখন স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, তখন সেখানে এই জাতীয় সরকার যোগ দেবে।
প্রায় সবক্ষেত্রেই অসাধারণ সাফল্যের চিহ্ন রেখেছিল তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। যদিও লড়াই কম ছিল না। ব্রিটিশরা টানা খোঁজ করে যাচ্ছিল সতীশ সামন্ত, অজয় মুখোপাধ্যায়, সুশীল ধাড়াদের। কিন্তু খোঁজ পাচ্ছিল না। কারণ, স্থানীয়রাই অপার মমতা ও শ্রদ্ধার আড়াল করে রাখতেন, সাহায্য করতেন নেতা এবং কর্মীদের। যাঁরা এই সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তঁরা সকলেই মনেপ্রাণে ছিলেন গান্ধীর শিষ্য। অহিংসায় বিশ্বাসী, কিন্তু পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন সময় এই আন্দোলনে হিংসার আশ্রয় নিতে হয়েছে। বিভিন্ন অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে, পুলিশের কাছে খবর পাঠায় এমন বিশ্বাসঘাতক ধরা পড়ার পরে কড়া সিদ্ধান্ত নিতেই হয়েছে।
সতীশ সামন্ত গ্রেফতার বরণ করলেন ১৯৪৩ সালের ২৬ মে। তিন বছরের কারাদণ্ড হয় তাঁর। তখন জাতীয় সরকারের দায়িত্ব নেন অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনিও গ্রেফতার হন ১৯৪৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সেই সময়ে বাংলায় চলছে তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সেই কঠিন সময়েও অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, চালিয়েছে ত্রাণের কাজও।
সেই অজয় মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতার পর রাজ্যের মন্ত্রী হলেন। বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার সেচ ও জলপথ বিভাগের মন্ত্রী। বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পরে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের মন্ত্রিসভাতেও তিনি সেচ এবং জলপথের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রী থাকাকালীন কোনও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন না। দেহরক্ষী রাখতেন না। একবার কংগ্রেস কর্মী অজয় মালাকারকে পুলিশ এসে খবর দিল, মন্ত্রী পুরুলিয়া থেকে ফিরছেন। রাত ১১টার সময়ে নামবেন মেচেদা স্টেশনে। স্টেশনে ট্রেন এল। হঠাৎ মন্ত্রীর গলা, ‘‘এই অজয় আয় আয়, আমি এখানে।’’ ট্রেন থেকে নেমেই বললেন, ‘‘এত রাতে আমি বাড়ি যাব কী করে?’’ অজয় মালাকার একটা ট্যাক্সি জোগাড় করেছিলেন। তিরিশ টাকা ভাড়া। সেই ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরলেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী। ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ উপনির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ালেন নিজের ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। মুখ্যমন্ত্রী হলেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের।
রাজ্যের তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ। নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশে নিজের সরকারকে ‘অসভ্যের সরকার’ আখ্যা দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর কার্জন পার্কে বাংলা কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে অনশন সত্যাগ্রহে বসেন। তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হলে ছেঁড়া জুতোর মতো মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যাব। তবুও আদর্শভ্রষ্ট হব না’। পদত্যাগ করেন। বেতার ভাষণে বলেন, ‘এই অবস্থায় গদি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা মানে জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা’। ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোদ্ধা সতীশ সামন্ত সুশীলকুমার ধাড়ার কাছে পরাজিত হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।
সরল ছিল জীবনযাপন। নিরামিষ খেতেন। পরনে চটি জুতো। হাঁটুর উপর পর্যন্ত খদ্দরের কাপড় আর হাতকাটা জামা পরতেন।
১৯৮৬ সালে ২৭ মে মারা গেলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। রাজ্যে তখন বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যুক্তফ্রন্ট সরকারে অজয় মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য জ্যোতি বসু।
আজ থেকে ৩৯ বছর আগে আজকের দিনে বাঁশের খাটিয়ায় শোয়ানো ছিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়ের মরদেহ। দড়ি দিয়ে বাঁধা। পাশে দাঁড়িয়ে গীতা মুখোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়। হাঁটু গেড়ে বসে হরিপদ দোলই। তিনি তমলুকের কংগ্রেস অফিসে রান্না করতেন। পরে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, শেষযাত্রার দিনে প্রণব মুখোপাধ্যায় পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে শেষযাত্রার খাট এনেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু দেহ আসেনি তমলুকে।
আরও পড়ুন-মেট্রো আসার আগে হলুদ লাইন পার করলেই জরিমানা! জারি নির্দেশিকা