গরম পড়লেই মন চল পালাই। এমন কোনও শান্ত, শীতল আশ্রয়ে যেখানে নেই রৌদ্রদহন জ্বালা। তাই ভ্রমণপিপাসুরা সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে পাহাড়ে, সমুদ্রে। কিন্তু এর বাইরেও এমন জায়গা আছে যেখানে পাহাড় বা সমুদ্র নেই, আছে শুধু রাশি রাশি আমগাছের সারি, তাদের শীতল ছায়া, মৃদুমন্দ হাওয়া আর অনন্ত নিরিবিলি।ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সম্প্রতি গড়ে উঠেছে কিছু সামার হাউস যা আমগাছের ছায়া ঘেরা। শহুরে জীবনের আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্য হয়তো নেই, রয়েছে রকমারি গাছগাছালির শীতল ছায়া, পাখপাখালির কলতান, ফুলের গন্ধ। মূলত আমগাছকে কেন্দ্র করে এইসব খামার বাড়িগুলি গড়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত বলার, আমগাছ শুধু কিন্তু একটা ফলদায়ী বৃক্ষ নয়। প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় এটি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণও করতে পারে।
এই সামার হাউসগুলি তৈরি করার ক্ষেত্রে পরিবেশ সচেতনতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। গাছ বাঁচিয়ে, গাছ লাগিয়ে এবং প্রকৃতির উপাদানের ওপর নির্ভর করে এই বাড়িগুলি তৈরি হয়েছে। আজ যখন প্রকৃতি ধ্বংস করে বড় বড় হোটেল-লজ গড়ে উঠছে, সেখানে প্রকৃতিকে নষ্ট না করে বরং তাকে আশ্রয় করে এমন নির্মাণ বিশেষ মর্যাদার দাবি রাখে। চণ্ডীগড়, কেরল, তামিলনাড়ু, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি জায়গায় গড়ে উঠেছে এমনই কিছু সামার হাউস।
আরও পড়ুন-বিশিষ্টদের আম-বিলাস
চণ্ডীগড় সামার হাউস
ছবির মতো সুন্দর শহর চণ্ডীগড় যা বিখ্যাত তার সবুজ পরিবেশ ও বৈচিত্র্যময় স্থাপত্যের জন্য। শহরের এক নির্জন প্রান্তে গড়ে উঠেছে ‘দ্য হাউস অব ম্যাঙ্গো শ্যাডোজ’। এটি এমন একটি গ্রীষ্মাবাস যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নিরিবিলি অবকাশ উদযাপন করতে পারে। জার্মান-আমেরিকান স্থপতি লুডউই মায়েস ভ্যান ডার রোহের উক্তি ‘God is in the Details’ যার অর্থ কোনও কাজ নিখুঁত করতে গেলে সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোতে মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন, এই মন্ত্র দ্বারা চালিত হয়ে পালক এবং সৌরভ সিংলা এই বাড়িটি নির্মাণ করেছেন। ১.১ একর জায়গার ওপর নির্মিত দুই কক্ষ বিশিষ্ট এই বাড়িতে চারজন মানুষ থাকতে পারেন। এখানে রয়েছে ৪৯টি আম, চিকু ও পেয়ারার গাছ। বাড়িটি নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁরা জোর দেন প্রকৃতির ওপর। প্রতিটি গাছ ৪০ মিটার সমদূরত্বে বসানো ছিল। তার মাঝখানে যে খোলা জায়গা ছিল সেখানে অত্যন্ত সুন্দর ও সুচারুভাবে তাঁরা বাড়িটি নির্মাণ করেন। একটি গাছও তাঁরা কাটেননি। উল্টে প্রকৃতির শোভাবর্ধন করতে চলার পথের দু’পাশে ফিকাস, অ্যারেকা পাম, ক্যান লিলি প্রভৃতি গাছ লাগান তাঁরা। এখানে দেখা যায় প্রকৃতির সঙ্গে স্থাপত্যের অপূর্ব মেলবন্ধন। বসার ঘর, খাওয়ার ঘর, রান্নাঘর অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে। বসার ঘরে স্কাইলাইটের মাধ্যমে প্রকৃতি ঢেলে দেয় আলো। শয়নকক্ষ থেকে বাগানের মুখোমুখি হওয়া যায়। স্থাপত্যের অপূর্ব দক্ষতার নির্মিত এই গ্রীষ্মাবাস ভিন্নতার দাবি রাখে।
স্থপতি জিওফ্রে বাওয়ারের অনুপ্রেরণায় এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আলিবাগের এই সুন্দর গ্রীষ্মাবাসটি নির্মাণ করেছেন স্থপতি কুণাল মানিয়ার ও রাহুল মালহোত্রা। বাড়িটির নির্মাণ কৌশল ও উপকরণে এমন ব্যাপারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যাতে করে তা গরম, আর্দ্র এবং বৃষ্টি, সব আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। বাড়ির উঠোনে আছে একটি ঝুলন্ত চাঁপা ফুলের গাছ, যার সুগন্ধ গোটা ঘরকে মাতিয়ে রাখে। এখানে বেশকিছু আমগাছ একসঙ্গে মিলে তৈরি করা হয়েছে বরফ গুহার মতো কিছু জায়গা। তার নিচে রয়েছে খাটিয়া। সেখানে বসে মানুষ প্রকৃতির শীতল ছায়া উপভোগ করতে পারে। আমগাছের পাশাপাশি এখানে লাগানা হয়েছে অনেক ফল ও ফুলের গাছ। বাগানটির নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে করে পাখি, মৌমাছিরা সেখানে অবস্থান করতে পারে। আমের ছায়া ঘেরা এই গ্রীষ্মাবাস মানুষকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম করে দেয় নির্মল আনন্দময় সুখ।
আরও পড়ুন-মহার্ঘ ইলিশ, তিস্তার বোরোলিতেই জামাই আদর
বেঙ্গালুরু সামার হাউস
বেঙ্গালুরুর করমঙ্গল এলাকায় এক শান্ত নির্জন পরিবেশে শতবর্ষপ্রাচীন আম ও নারকেল গাছের বাগানের ভেতর অবস্থিত এই গ্রীষ্মাবাস। প্রকৃতি আর স্থাপত্য এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ইন্টেরিয়র প্রতিষ্ঠান স্টুডিও রূহ স্টাম্বা আর্কিটেক্টের সঙ্গে মিলে যৌথভাবে এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন, যেখানে রয়েছে শন্তির সুর। ডিজাইনার কাব্যা শেঠ ও কীর্তনা দুরাইয়ের নেতৃত্বে প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে এই দুই তলা বাড়িটি তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির প্রবেশদ্বারের দুপাশে রেয়েছে পদ্ম ও মাছের পুকুর। ভবনের ভেতরের কাঠামোয় মিশেছে ইতালিয়ান রান্নাঘর, কোটা পাথরের মেঝে, ওয়ালনাট কাঠ এবং প্যাস্টেল রঙের ছায়া। এখানে থাকেন এক দম্পতি আর তাঁদের দুই সন্তান। উপরের তলায় রয়েছে একটি পরিবারিক কার্যক্রমের ঘর, শিশুদের পড়াশোনার উপযোগী ঘর। শোয়ার ঘরের পাশ থেকে দেখা যায় নিচের সবুজ উঠোন। সবুজের মাঝখানে বাড়িটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যার মধ্যে খেলা করে প্রকৃতির আলো। প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা এই বাড়িটি কেবল নান্দনিকভাবে সুন্দর নয়, প্রকৃতি ও আধুনিক স্থাপত্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
রাজাপালয়াম গ্রীষ্মাবাস
তামিলনাড়ুর রাজাপালয়ামে রয়েছে একটি সুন্দর গ্রীষ্মাবাস যা তিন প্রজন্মের ভালবাসার এক অপূর্ব নিদর্শন। ১৭ একর বিস্তৃত নারকেল বাগানের মধ্যে অবস্থিত এই বাড়ি। বাড়ির মালিক প্রসন্না রাজা, তাঁর মেয়ে-জামাই বেদিকা প্রশান্তরা শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকেন। তাঁরা চেয়েছিলেন শহরের বাইরে এমন একটি নির্জন শান্তিপূর্ণ আবাস গড়ে তুলতে যেখানে নিজেদের অবকাশ কাটাতে পারবেন। স্থপতি নন্দ কিশোরের প্রথম কাজ ছিল এই বাড়ি তৈরি করার জন্য সঠিক জায়গা নির্বাচন করা। তিনি দেখেন খামারের জলসেচ কালভার্টের চারপাশে রয়েছে চারটি বড় আমগাছ। এই পরিবারের পূর্বপুরুষেরা গাছগুলি লাগিয়েছিলেন। এই জায়গাটিকে তিনি বেছে নেন। প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি এই বাড়ির নকশায় রয়েছে সূক্ষ্মতা ও চিন্তাভাবনার ছাপ। একটি ধূসর অক্সাইড সুইমিং পুলের কাজ করার সময় আমপাতার প্রাকৃতিক রঙে তার রং বদলে যাওয়ায় স্থপতিরা বুঝেছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে কাজ করার চ্যালেঞ্জ কতটা কঠিন। শেষপর্যন্ত তাঁরা আমপাতার প্রভাব মেনে নিয়ে হলদে অক্সাইডই ব্যবহার করেন—যা প্রকৃতির সঙ্গে আরও সাযুজ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাড়িটির প্রতিটি অংশে রয়েছে প্রকৃতির ছোঁয়া। বড় বড় গাছ, মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের দৃশ্য, জলস্রোত সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এমন এক সংযোগ গড়ে তোলা হয়েছে যাতে করে এখানে অবকাশ যাপনের অভিজ্ঞতা সুখদায়ক হয়ে ওঠে।
আলিবাগ সামার হাউস
আলিবাগের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে দাড়িয়ে সুন্দর গ্রীষ্মাবাস ‘আনেই ভিলা’। আমগাছের ছায়াঘেরা এই ভিলার আয়তন চার হাজার বর্গফুট। এটির ডিজাইন করেছেন ওয়ার্ড আর্কিটেক্টের যশ ও প্রাচী ওয়ার্ডে। খোলা ছাদ, টেরাকোটা জালি, প্রাকৃতিক আলো আর শিল্পের ছোঁয়ায় নির্মিত ভিলাটি শান্তির আশ্রয়। ভিলাটি এমনভাবে তৈরি যার একটি কক্ষ থেকে দেখা যায় বিস্তৃত ধানখেত, অন্যটি থেকে দেখা যায় আমের বাগান। ভিলার ঘরগুলিতে রয়েছে বিচিত্র শিল্পকর্মের নিদর্শন। এর ঘেরা বারান্দায় বসে ধানের খেত এবং আমের বাগান থেকে বয়ে আসা শীল মনোরম বাতাস উপভোগ করা যায়। বাড়ির প্রবেশদ্বার পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তার পাশে রয়েছে সবুজ ফলের বাগান। এখানকার সুইমিং পুলটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যার ওপর সকালের নরম সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে বসার ঘরকে ঝলমল করে তোলে। বাড়ির ভেতরকার নকশা বোহো স্টাইলে নির্মিত। ভিলাটির বিশেষত্ব তার পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনায়। দ্বিগুণ উচ্চতার ছাদ, ল্যাটেরাইট পাথরের দেওয়াল, স্কাইলাইট জানালা এবং ছাদে বসানো সৌর প্যানেল সবমিলিয়ে স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। ছয় কেভিএ ক্ষমতার সৌরশক্তির সাহায্যে বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কাজ হয়। বাড়ির ছাদগুলি এমনভাবে তৈরি যাতে করে বাড়ির মধ্যে সবসময় শীতলতা বজায় থাকে। এই ভিলা শুধু বসবাসের জায়গা নয়, প্রকৃতির ছায়াঘেরা যেন একটি স্বপ্নলোক।
আরও পড়ুন-বন্দুকনীতির কড়া নিন্দায় সুস্মিতা দেব
কৃত্রিমতা যখন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সেখানে আমের ছায়া ঘেরা এই আবাসগুলি আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় প্রকৃতির কাছাকাছি। এইসব সামার হাউসগুলি আদতে একটি অনুভব, এক অদ্ভুত চেতনা। যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তির মাঝে এইরকম নির্জন, ছায়াঘেরা সামার হাউসগুলি তাই একান্ত নিজের মতো থাকার আর প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার এক নিঃশব্দ আমন্ত্রণ।