শ্রীযুক্ত গঙ্গোপাধ্যায়! শুনতে কি পাচ্ছেন

কেন একজন বিচারপতি রাজনীতিতে যোগ দেবেন? কেন এরকম ঘটনায় ভেঙে যায় বিচার ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

অবসরগ্রহণের পর বিচারপতিদের রাজনীতিতে যোগদান আখেরে বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করে। মন্তব্যটি ভারতের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাইয়ের। তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার। একজন বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) রাজনৈতিক পদের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেটা বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, একে স্বার্থের সংঘাত বা সরকারের অনুগ্রহ অর্জনের প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা যেতে পারে। তাই অবসর-পরবর্তী এই ধরনের কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা কমাতে পারে।

আরও পড়ুন-রাণা নাইডু সিজন ২

কেন এসব কথা উঠছে? আগে তো ওঠেনি।
উঠছে কারণ, অবসরের পরে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-এর রাজ্যসভায় মনোনয়ন নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। হালফিলে কর্মরত অবস্থায় কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির পদ ছেড়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপি-তে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি বিজেপি সাংসদ। বিচারপতির চেয়ারে বসে গেরুয়া পার্টির দালালি করেছেন। আর এখন এক্কেবারে খুল্লম খুল্লা। আর তো কোনও অসুবিধা নেই। বাংলার সব্বোনাশ করাই তাঁর কাজ ছিল, এখনও সে কাজে ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
কিছু দিন আগে সুপ্রিম কোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত (ডিওয়াই) চন্দ্রচূড়কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অবসরের পরে বিচারপতিদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়া উচিত কি না। তিনিও অনেকটা বর্তমান প্রধান বিচারপতির সুরেই জানিয়েছিলেন, অবসরজীবনে নিজে এমন কিছু করবেন না যা বিচারপতি হিসাবে তাঁর কাজ বা বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে সংশয়ের অবকাশও তৈরি করতে পারে।
তাঁর এই বক্তব্যের ভিতরে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বদের প্রতি একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা ছিল।
দেশবাসী তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে যে, বিচার ব্যবস্থাই হল তাদের সবচেয়ে বড়, এমনকী বহু ক্ষেত্রে শেষ ভরসা। ভারতের মতো ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’র মূল সমস্যা হল বৈষম্য। এক শ্রেণির মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। আবার অধিকার সম্পর্কে অবহিত হয়েও অনেক মানুষ আর্থিক এবং সামাজিক দুর্বলতার কারণে তার নাগাল পায় না। এমনই দুর্ভাগ্য যে, সকলের দাবি অভাব অভিযোগের প্রতি কর্ণপাত করে না নির্বাচিত সরকার এবং সরকারি প্রশাসন। স্বভাবতই কোটি কোটি মানুষ জীবনভর বঞ্চনারই শিকার রয়ে যায়। এই বৈষম্য বা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিই দেশের স্বাস্থ্যকর উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। শেষমেশ বিচার ব্যবস্থাই এইসব মানুষের সহায় হলে কমতে পারে তাদের দুর্দশা। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থার পবিত্রতা সবরকমে রক্ষা হওয়া চাই। বিচারপতির আসন অলঙ্কৃত করছেন যেসব বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, সেই দায়িত্ব বিশেষভাবে নিতে হবে তাঁদেরকেই। শুধু বিচারপতির কার্যকাল নয়, তাঁদের সমগ্র জীবন প্রশ্নাতীত হওয়াই কাম্য। গণতন্ত্রের সব ক’টি স্তম্ভের সামনে বিচার ব্যবস্থাই হয়ে উঠবে সর্বজনগ্রাহ্য আদর্শ, এটাই সমাজের আকাঙ্ক্ষা।

আরও পড়ুন-সীমান্তে কাঁটাতার, বকেয়া ৩৫৬ একর জমি দ্রুত হস্তান্তরের নির্দেশ রাজ্যের

প্রাক্তন বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বক্তব্যটি সেই কথাটিই বলেছেন।
দেশবাসী তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছে যে, বিচার ব্যবস্থাই হল তাদের সবচেয়ে বড়, এমনকী বহু ক্ষেত্রে শেষ ভরসা। ভারতের মতো ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’র মূল সমস্যা হল বৈষম্য। এক শ্রেণির মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। আবার অধিকার সম্পর্কে অবহিত হয়েও অনেক মানুষ আর্থিক এবং সামাজিক দুর্বলতার কারণে তার নাগাল পায় না। এমনই দুর্ভাগ্য যে, সকলের দাবি অভাব অভিযোগের প্রতি কর্ণপাত করে না নির্বাচিত সরকার এবং সরকারি প্রশাসন। স্বভাবতই কোটি কোটি মানুষ জীবনভর বঞ্চনারই শিকার রয়ে যায়। এই বৈষম্য বা অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিই দেশের স্বাস্থ্যকর উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। শেষমেশ বিচার ব্যবস্থাই এইসব মানুষের সহায় হলে কমতে পারে তাদের দুর্দশা।
কিন্তু এতৎসত্ত্বেও বিচার ব্যবস্থার প্রতি বহু মানুষ যে আস্থা হারাচ্ছে, তা ফের স্পষ্ট করলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাই স্বয়ং। এজন্য তিনি আঙুল তুলেছেন বিচারপতিদেরই একাংশের দিকে। বুধবার ব্রিটেনে সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিয়ে বিচারপতি গাভাই একাধিক বিস্ফোরক মন্তব্য করেন। তাঁদের আলোচনার প্রতিপাদ্য ছিল—‘বিচারবিভাগীয় যোগ্যতা এবং জনগণের আস্থা রক্ষা’। সেখানেই তিনি রীতিমতো তোপ দেগেছেন সেইসব প্রাক্তন বিচারপতি সম্পর্কে, যাঁরা স্বেচ্ছাবসর নিয়ে ভোটে প্রার্থী হয়েছেন কিংবা অবসরের পর কোনও বৃহৎ সরকারি পদে যোগ দিয়েছেন। তাঁর মতে, এতে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিদের সততা ও নৈতিকতা এবং বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন ব্যক্তিরা বিচারপতি হিসেবে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বা রায় দিয়েছিলেন, সেগুলি জনগণের সন্দেহের তালিকায় থাকবে। প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন, ভবিষ্যৎ ব্যক্তিগত মুনাফা ও স্বার্থসিদ্ধির কথা ভেবেই যে ওই বিচারপতিরা রায় দেননি, তার নিশ্চয়তা কী? তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, অবসর-পরবর্তী জীবনে একজন বিচারপতির কোনও সরকারি পদ কিংবা অন্যকোনও সাংবিধানিক সুযোগ-সুবিধা নীতিগত কারণেই নেওয়া উচিত নয়। রাজনীতিতে যোগদান তো নয়ই।
কিন্তু কেউ কেউ এই লক্ষ্মণরেখা মানছেন না বলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। বিচারপতিদের নৈতিকতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। মত প্রকাশ করেছেন বিচারপতি গাভাই। এ঩তে শুধু বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বক্তব্যেই সিলমোহর পড়েনি, বিচারপতি গাভাই সমস্যাটি নিয়ে আরও বেশি দূর এবং বিশদে ভেবেছেন। বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সম্পদ হল মানুষের আস্থা, বিশ্বাস, নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি এবং স্বচ্ছতা। এই স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থেই বিচারপতি গাভাই মনে করেন, বিচারপতিদের সম্পত্তির প্রকাশ্য ঘোষণা এবং যেকোনও শুনানির সরাসরি সম্প্রচার প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতি যথার্থই বলেছেন, সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়া অথবা তা রক্ষা করা বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। দুর্নীতির সঙ্গে আদালতের সামান্যতম সম্পর্ক থাকলে বিচার ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবেই। সাম্প্রতিক একাধিক অবাঞ্ছিত দৃষ্টান্তেই যেন দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কে ইতি পড়ে। এই প্রত্যাশা রাখব আমরা। খাতায়-কলমে ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ হলেও ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ হয়ে উঠতে ভারতকে এখনও বহু পথ অতিক্রম করতে হবে। বিচার ব্যবস্থা পূর্ণ পবিত্র হলে এই দীর্ঘ চলার ক্লান্তি আমাদের কখনও স্পর্শ করতে পারবে না।
স্মর্তব্য সেই উদ্ধৃতি:
All the rights secured to the citizens under the Constitution are worth nothing, and a mere bubble, except guaranteed to them by an independent and virtuous Judiciary.
হ্যাঁ! বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা আমাদের নাগরিক অধিকারের শেষ আশ্রয়।

Latest article