ছাত্রী থেকে সফল উদ্যোক্তা

মাত্র পঁচিশেই সফল উদ্যোক্তা তিনি। শুধু তাই নয়, খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন খাদ্য প্রযুক্তিবিদও। যাত্রা শুরু করেছিলেন মাত্র ৪টি পণ্য নিয়ে। আজ তিনি একটা ব্র্যান্ডের কর্ণধার। তিনি মহিলা উদ্যোগপতি পলক অরোরা। তাঁর কথা লিখলেন শীলা রাজবংশী

Must read

বয়স মাত্র ২৫। এর মধ্যেই সফল উদ্যোক্তা তিনি। একটি প্রাচীন খাদ্য বাজরা (মিলেট) নিয়ে এগিয়ে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের দিশায়। আজ ‘সতগুরু সুপারফুডস’ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। যাত্রা শুরু করেছিলেন মাত্র ৪টি পণ্য নিয়ে। আজ তিনি একটি ব্র্যান্ড চালাচ্ছেন যার মধ্যে রয়েছে বাজরাভিত্তিক (রেডি টু কুক) ১৫ খাদ্যপণ্য।
কোনও পেশা ছোট নয় তবে স্বপ্নের সঙ্গে আপসও নয়। লড়াই করতে হবে স্বপ্ন পূরণের জন্য। তারই নজির গড়লেন পলক অরোরা। বাকিদের থেকে তিনি কেন আলাদা।
পলক সত্যি বাকি অনেকের থেকে আলাদা। যে বয়সের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা শেষ করে বুঝতে পারে না এর পরে তারা কী করবে? সেই বয়েসের আগেই পলক একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি যখন খাদ্য প্রযুক্তি নিয়ে বি-টেক পড়ছিলেন (২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত) তখনই তিনি প্রথমবারের মতো ‘অ্যান্টিনিউট্রিয়েন্টস’ শব্দটি শুনতে পান। পলক জানান, আমরা সবাই ভেবেছিলাম রান্নার সময় কমানোর জন্য ডাল এবং শস্য ভেজানো হয় কিন্তু আমার বাবা-মা-সহ কেউই জানত না যে এটি অ্যান্টিনিউট্রিয়েন্টস কমিয়ে দেয়। এটি আমাকে ভাবতে বাধ্য করে যে আমরা পুষ্টি সম্পর্কে কতটা কম জানি। পুষ্টিই হল উচ্চরোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চাবিকাঠি।

আরও পড়ুন-

ক্রীড়ামন্ত্রীর অনুরোধে লিগে ভূমিপুত্র বেড়ে ৬স্বপ্নের শুরু
সালটা ২০২১, পলক তখন একটি বিক্রয় ও বিপণন সংস্থায় কাজে নিযুক্ত হন। সংস্থায় কাজ করতে গিয়ে বিপণনের খুব ভাল অভিজ্ঞতা হল তাঁর। পলকের মতে, এটা ছিল তাঁর জন্য সেরা সুযোগ। তবে কাজে যুক্ত হওয়ার দু’মাস পর থেকেই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি কাজটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
সেই সময়টা করোনার দ্বিতীয় পর্যায়। পলককে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনা ভাবিয়ে তোলে। যেমন করোনার সেইসময় আমরা সকলেই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে বিভিন্ন পথ অবলম্বন করেছি। পলক আমাদের জন্য সেই পথকে আরও সহজ করে তুললেন। তিনি বাজরাভিত্তিক বিভিন্ন পণ্য নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। বাজরাভিত্তিক পণ্যের পুষ্টিগুণকে কাজে লাগিয়ে এক-একটি নতুন খাদ্যপণ্য তৈরি করতে শুরু করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রথমে রান্নাঘরের এক কোণে ছোট্ট ল্যাব থেকে শুরু হয়। যদিও ২০২৪-এর মে মাসের মধ্যে একটি উৎপাদন ইউনিটের জন্য একটি জমিও কিনে ফেলেন তিনি। দিন সত্যি বদলায়, যে মেয়ের স্বপ্নযুদ্ধ শুরু রান্নাঘরের কোণ থেকে এখন তাঁর নিজস্ব জমি আছে উৎপাদন ইউনিটের জন্য। ইচ্ছাশক্তি আর শ্রম মানুষকে তাঁর স্বপ্নের শিখরে নিয়ে যায় এটা তারই উদাহরণ।
ছোট্ট ছোট্ট পায়ে
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা এখন কলকবজার মানুষ— এটা বললে ভুল হবে কি? সত্যি সবাই ব্যস্ত আমরা। সময় নেই ভাল করে খাবার খাওয়ার বা রান্না করার। এই দৃশ্য পলক হয়তো আগেই দেখে ফেলেছেন। তাই বাজরাভিত্তিক এই খাবারগুলো যাতে অল্প সময়ে রান্না করা যায়, সেই ভাবে তৈরি করেছেন। কিন্তু স্বাদ আর পুষ্টিগুণের সঙ্গে আপস করেননি। সমস্তরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করে বাজরাভিত্তিক খাদ্যটি তৈরি করেছেন। তিনি ১৫টির বেশি রেডি টু কুক পণ্য তৈরি করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিলেট নুডলস, মিলেট পাস্তা, মিলেট পোলাও, ওটমিল, প্যানকেক মিক্স, ফ্লেক্স ইত্যাদি। প্রিজারভেটিভ-মুক্ত এই খাবারগুলি ১০ মিনিটেরও কম সময়ে রান্না করা যায়। হস্টেল পড়ুয়াদের জন্য এটি একটি স্বাস্থ্যসম্মত খাবার।
বহু বাধা পেরিয়ে
কী মনে হয় এই পথটি তাঁর জন্য সোজা ছিল? কারও জন্যই নতুন কোনও কিছু সহজ নয়। পলকের জন্যও তা ছিল না। কিন্তু তিনি সেই কঠিন পথ অতিক্রম করেছেন। এই ছোট জীবনে বাধা এসেছে বারংবার। পলক জানান, ২০২২ সালের জুলাই মাসে সরকার কর্তৃক আয়োজিত একটি বাজরা রন্ধন উৎসব হয়েছিল। সেখানে তিনি শেষ মুহূর্তে জানতে পারেন এবং কর্তৃপক্ষ তাঁকে সকাল দশটার মধ্যে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছানোর শর্তে একটি স্টল স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। যা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এইরকম বহু ঘটনা রয়েছে তাঁর এই ২৫ বছরের জীবনে। তবে বিষয়গুলোকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। কথায় আছে শেষ ভাল যার সব ভাল তার। কেন বলছি এ কথা?
সেই শুভক্ষণ
বাজরা রন্ধন উৎসব তাঁকে হতাশ করে যেদিন ফিরিয়ে দিয়েছিল তখন তিনি ২২ বছর বয়সি তরুণ উদ্যোক্তা। দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছেন নয়া গন্তব্যের দিকে। জীবনে ওঠা-নামা আসতেই পারে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটাই আসল কথা। সেইকথা পলকের অজানা নয়। আত্মবিশ্বাসী পলক তাই সেইদিন নিরাশ হননি। তিনি আরও জানান, আয়োজকরা তাঁকে তাঁদের সমস্ত পণ্য প্রদর্শন করতে বলেছিলেন। সেখান থেকে অনেক অর্ডার পেয়েছিলেন তিনি। এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

আরও পড়ুন-সীমান্তে কাঁটাতার, বকেয়া ৩৫৬ একর জমি দ্রুত হস্তান্তরের নির্দেশ রাজ্যের

আর্থিক স্বনির্ভরতা
পলকের সংস্থা ‘মিলিয়াম’ মাসিক উপার্জন সর্বনিম্ন ৩ লক্ষ টাকা হলেও উৎসবের মরশুমে এটি মাসিক ৭ লক্ষ থেকে ৮ লক্ষ টাকাতে পৌঁছায়। একটি মেয়ে যে কি না মাসিক ৩ থেকে ৮ লক্ষ টাকা ইনকাম করছে সে চাইলে কী না পারে! কিছু লড়াই মানুষকে একাই লড়তে হয়। আপনার জীবনের লড়াই আপনাকেই লড়তে হবে। যেভাবে লড়ে যাচ্ছেন পলক অরোরা-সহ অনেকে।

হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আমাজন
পলক তাঁর পণ্য প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করেন। ২০২৩ সালে তিনি এবং তাঁর সংস্থা মিলিয়াম আন্তর্জাতিক মিলেটস বর্ষে অনেক প্রদর্শনী এবং ইভেন্টের অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর তিনি একটি ওয়েবসাইট তৈরি করেন সেখান থেকেই অনলাইনে অর্ডার নেওয়া শুরু করেন। তখন কর্মী-সংখ্যা ছিল মাত্র দু’ থেকে তিনজন। ২০২২-এ প্রতিষ্ঠিত ‘সতগুরু সুপারফুডস’ ২০২৪ সালের দিকে অন্যান্য বাজরা উৎপাদনকারীদের জন্য চুক্তিবদ্ধভাবে উৎপাদন শুরু করে। এবং তাদের ইউনিট আগের তুলনায় অনেক প্রসারিত হয়েছে। যা তাদের উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ কেজিতে নিয়ে যাবে। এবং তাদের পণ্য এখন অনলাইন অ্যাপেও পাওয়া যাচ্ছে। তিনি এই প্রগতি কিন্তু একা ভাগ করে নেননি। তাঁর কর্মকাণ্ডের অংশ তাঁর কর্মীরাও। তাঁরাও এই প্রগতির অংশ। পলকের হাত ধরে তাঁরা আজ স্বনির্ভর।

আরও পড়ুন-আজ পালিত হবে ইদ-উল-আযহা

একাই একশো
প্রতিটা মেয়ের মধ্যে যেন দশভুজার ছাপ রয়েছে। পলকও তেমনি একজন নারী। পলক প্রথম থেকেই একা হাতে সবটা সামলেছেন। প্রোডাক্ট রিসার্চ, প্রোডাকশন, মার্কেটিং প্রোডাক্ট সাপ্লাই, প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে তিনি পারদর্শিতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল ফুড ফেস্টিভ্যাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইভেন্টে যোগদান করেন। গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেন। তাঁর পণ্যের বিশেষ গুণগুলিকে তাঁদের মাঝে তুলে ধরেন। গ্রাহকরা ধীরে ধীরে নিয়মিত গ্রাহক হিসাবে পরিণত হয়। পলক তাঁর গ্রাহকদের থেকে পাওয়া ফিডব্যাক ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করেছেন। এতে করে তাঁর পণ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সময়ে ব্যবসার অগ্রগতির জন্য সমাজমাধ্যম বা নিউ মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। পলক সেক্ষেত্রেও পারদর্শী। পলক তাঁর ব্র্যান্ডকে আগামী ৫ বছরের মধ্যে গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত করতে চান।
সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছেন। আগামী দিনে আট থেকে আশি সকলের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবেন এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

Latest article