প্রকৃতির গাইডরা

বলে না ‘শাপে বর’! উত্তরাখণ্ডের প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের মহিলাদের কাছে অতিমারি ছিল তাই। ওই অস্থির পরিস্থিতিতেই তাঁরা খুঁজে পেয়েছিলেন বিকল্প কর্মসংস্থান। হয়ে উঠেছিলেন স্বনির্ভর। ধীরে ধীরে পর্যটন শিল্পের মতো পুরুষশাসিত পেশায় তাঁরা গড়ে তুলেছেন নারী ক্ষমতায়নের নজির। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারী। বিভিন্ন পথে, বিভিন্ন উপায়ে, বিভিন্ন পেশায়, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, ফুচকা বিক্রি থেকে মীন শিকার, কৃষিকাজ, পৌরোহিত্য থেকে ভ্রমণগাইড, হোমস্টে পরিচালনা— আজ সর্বত্র নারীর অবাধ বিচরণ। নারী ক্ষমতায়নের স্বর্ণযুগে তাই সব পেশাই মেয়েদের পেশা। মেট্রোপলিটন শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম-মেয়েরা আজ কোনও না কোনওভাবে স্বনির্ভর। শহুরে মহিলারা এখন আর কিছু না পারুন কনটেন্ট ক্রিয়েটিংয়ে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন। নিজের কমফোর্ট জোন থেকে না বেরিয়েও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম খুঁজে পেয়েছেন আর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পাহাড়ি অঞ্চলের মহিলারাও স্বসহায়তায়, স্বনির্ভর। তাঁদের কঠিন জীবনে বিকল্প কর্মসংস্থানের এখন অভাব নেই। বিশেষত পর্যটন শিল্পে প্রত্যন্ত পাহাড়, জঙ্গলমহলের মেয়েরা নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

আরও পড়ুন-আমার পোশাক আমার স্বাধীনতা

বাওয়ারি গাঁও
উত্তরকাশী জেলার চিনিয়ালিসৌর ব্লকের অন্তর্গত মাথোলি গ্রাম স্থানীয় মহিলারা নারী ক্ষমতায়নের নয়া নজির গড়ে চলেছেন প্রতিদিন। এখানকার স্থানীয় মহিলারা তাঁদের গ্রামকে একটি নতুন এবং সমৃদ্ধশালী পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরিত করেছেন। আগে হরসিল ভ্যালি বা মোরি-সাঁকরি পর্যটনের স্থান হিসেবে খুব একটা পরিচিত ছিল না। এই জায়গাগুলোকে বিশিষ্ট পর্যটনের স্থান হিসেবে তুলে ধরেছেন মাথোলি গ্রামের কর্মঠ, পরিশ্রমী মহিলারা। স্টিরিওটাইপ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পরিচিতি গড়ে তুলতে মাথোলি গ্রামের মেয়েরা পর্যটনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন ওতপ্রোতভাবে। এই মহিলাদের দক্ষতা, প্রচেষ্টার ফলে জেলার পর্যটন মানচিত্রে কোথাও না থাকা একসময়ের অপ্রচলিত পাহাড়ি এই জনপদগুলো আজ অর্থনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে উন্নত করতে এবং ভারতের প্রকৃত সৌন্দর্য সম্পদকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে এখানে হোমস্টে চালু করেছেন তাঁরা এবং পর্যটকদের উষ্ণ আতিথেয়তা এবং ব্যবস্থাপনা ছাড়া তাঁদের খাওয়া -দাওয়া সঙ্গে গ্রামগুলো ঘুরিয়ে দেখানো অর্থাৎ সম্পূর্ণ প্রকৃতি গাইডের ভূমিকা পালন করছেন তাঁরা।
এই গ্রামের হোমস্টের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে যাঁদের অবদান রয়েছে তাঁরা হলেন অনিলা পানওয়ার এবং তাঁর স্বামী প্রদীপ পানওয়ার। মাথোলি গ্রামের বাসিন্দা প্রদীপ ও অনিলার উদ্যোগে মহিলাদের স্বাবলম্বী হওয়ার, নিজের কিছু করে দেখানোর যাত্রা শুরু হয়। প্রদীপ পানওয়ার ট্যুরিজম সেক্টরে কাজের সূত্রে গ্রামের বাইরে কাজ করতেন কিন্তু লকডাউন অতিমারিতে কাজ বন্ধ হওয়ায় নিজের গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যা গ্রামের মহিলাদের কাছে শাপে বর হয়। পানওয়ার ট্যুরিজম সেক্টরে কাজ করার সুবাদেই সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। নিজের বাড়ির গোয়ালঘর, যাকে স্থানীয় ভাষায় ছানি বলা হয়, সেই গোয়ালঘরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে শুরু করলেন হোমস্টে। এর পাশাপাশি অনিলা স্থানীয় মহিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। পর্যটকদের যত্ন, দেখাশোনা, আতিথেয়তা, তাঁবু খাটানো, ট্রেকিংয়ে তাঁরা কীভাবে সহযোগী হবে, রান্না করে খাওয়ানো, সাইট সিইয়িং করানো অর্থাৎ একজন ভ্রমণ গাইডের সবটা শিখিয়ে তৈরি করেন একটা গোটা মহিলা দল। ধীরে ধীরে এই প্রচেষ্টা নারীদের দ্বারা পরিচালিত ‘বাওয়ারি গাঁও’-এ পরিণত হয়েছে। এই প্রোজেক্টটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বাওয়ারি গাঁও’ প্রোজেক্ট, যার অর্থ মহিলাদের গ্রাম। এই মহিলা দলে রয়েছে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন। যাঁরা ওই এলাকার বিভিন্ন শিল্প, সংস্কৃতির সঙ্গে পর্যটকদের পরিচয় করানোর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেন। ববিতা, রজনী, অর্চনা, মুলমাদেবী এবং রাজিরা আজ ‘বাওয়ারি গাঁও’-এর গর্ব। এত সংখ্যক মহিলার কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে এই অভিনব উদ্যোগে। এটি গ্রামীণ মহিলাদের জন্য আয়ের একটি প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে। বাওয়ারি গাঁওয়ের বিশেষত্ব হল যে এখানকার সব কাজ মেয়েরাই করে। নারী ক্ষমতায়নের যা এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। এই মুহূর্তে গ্রামে অন্য কোনও পরিবারের মহিলারা যদি হোমস্টে শুরু করতে চায় তবে সেই বিষয়ে সেই রাজ্যের সরকারও শামিল হয়েছে সেই উদ্যোগকে সফল করতে। সেই কারণেই বর্তমানে, উত্তরাখণ্ডে পর্যটন বিভাগে নিবন্ধিত ৫,৩৩১টি হোমস্টে রয়েছে, যার বেশিরভাগই গ্রামীণ এলাকার মহিলারাই পরিচালনা করছেন।
চাম্বার মহিলারা
উত্তরাখণ্ডে এমনই আরও একটি মহিলা দল বা সমষ্টি রয়েছে যারা ইতিমধ্যেই
নারী ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।
২০২৩ সাল থেকে, তেহরি জেলার চাম্বা ব্লকের চারটি গ্রামের পুষ্পা দেবী-সহ আরও আটজন মহিলা একসঙ্গে হোমস্টে পরিচালনা এবং গাইডেড ট্রেইল পরিচালনা শুরু করেন। এই পেশায় সফল হয়ে তাঁরা এখন জীবিকা নির্বাহ করছেন। ২০২৫-এ তাঁরা পর্যটকদের জন্য গ্রাম এবং জঙ্গল জুড়ে ৫টা ট্রেইলে ৬৫টা ওয়াকিং ট্যুর বা হেঁটে ভ্রমণ পরিচালনা করেছেন। আয় করেছেন লক্ষাধিক অর্থ। এই মহিলারা সেখানকার হিম বিকাশ সমিতির অংশ। যা একটি স্বসহায়ক এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠী। ২০২৩ থেকে দেরাদুনের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিমমোথান সোসাইটি চাম্বা ব্লকে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তোলে। উদ্দেশ্য ছিল সেই গোষ্ঠীর অন্তর্গত মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগে স্বনির্ভর করে তোলা। হিমমোথান ব্লক কো-অর্ডিনেটর প্রিয়াঙ্কা রাওত বলেন, এখানে অনেক মডেল হোমস্টে গড়ে তোলা হয়েছে। মহিলাদের অর্থ প্রদানও করা হয়েছে যাতে তাঁরা নিজেদের বাড়ির ফেলে রাখা অংশেই একটি ঘর ও শৌচাগার সংস্কার করে নিতে পারে এবং পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। গ্রামের কাছেই রয়েছে ‘৫২ গড়’ নামের এক ঐতিহাসিক প্রাচীন পরিত্যক্ত ভবন।
এই গড় সম্পর্কে অনেক পর্যটকই জানত না। এখন এই মহিলাদের জন্য ৫২ গড় লাইমলাইটে। এই মহিলা দলের অন্যতম চোপরিয়াল গ্রামের ৬২ বছর বয়সি পুষ্পা দেবী বলেন, ‘‘যখন আমি ছোট ছিলাম, দিনে দু’-তিনবার জঙ্গলে যেতাম পশুখাদ্য, জ্বালানি কাঠ এবং জলের জন্য। এটা খুব কষ্টকর ছিল আমার জন্য। জঙ্গলের আগামীর যাঁরা উত্তরাধিকারী সেই নতুন প্রজন্মরা এই জায়গার সঙ্গে আত্মিক নৈকট্য অনুভব করত না কিন্তু আজ আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় এখানকার শিশুরাও এই স্থান নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আজ এখানকার শিশু থেকে নতুন প্রজন্মের তরুণ এবং তরুণীরা ওই মহিলাদের দেখে প্রকৃতির পথপ্রদর্শক বা নেচার গাইড হতে আগ্রহী।’’ হিমবিকাশ সমিতি এই মহিলা সদস্যরা একটা ফুড চেন, ক্যাফেও খুলেছেন। যে ক্যাফের বিগত দু’বছর ধরে আয়ের পরিমাণ প্রায় পাঁচ লক্ষের অধিক।

আরও পড়ুন-শিলিগুড়িতে ফিরতেই শঙ্করকে উচ্ছ্বাসে বরণ তৃণমূল কর্মীদের

মুনশিয়ারির মেয়েরা
মালিকা ভিরদি যিনি প্রায় তিন দশক আগে দিল্লি ছেড়ে নারী ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে মুনশিয়ারিতে পাহাড়ের কাছে ছোট্ট গ্রাম সারমোলিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। তিনি কেবল সেখানকার মহিলাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেননি, বিকল্প আয়ের উৎস তৈরির জন্য মহিলাদের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। সেখানেই তিনি শুরু করেন ‘হিমালয়া আর্ক হোমস্টে প্রোগাম’। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই মুনশিয়ারির পাহাড়ি অঞ্চলের অতি সাধারণ মহিলারা হয়ে উঠেছেন মুনশিয়ারির মেটাল নারী। কঠিন পাহাড়ি জীবনযাপন সামলে তাঁরা আজ মাল্টিটাস্কার। নিজেদের হোমস্টে পরিচালনা, পর্যটকদের দেখাশুনো, তাঁদের রান্নাবান্না, দেখভাল সবটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলান। সরস্বতী, গীতা, ভানুরা পর্যটকদের জন্য তৈরি করছে সুস্বাদু কুমায়ুনি ফুড। মাদুয়া কী রোটি, ভাট্টা কী স্যুপ, তিমুর কি সাগ, ভাঙ কি চাটনি-সহ আরও অনেক কিছু। মুনশিয়ারির এই সারমোলি হোমস্টে প্রোজেক্টই যে শুধু নারী ক্ষমতায়ন করছে তা নয়, সারমোলি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে একশো বছরের পুরনো দারকোট গ্রামের মহিলারা তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বুনন এবং বিরল প্রজাতির আঙ্গোরা খরগোশ পালনের মাধ্যমে নিজেদের স্বনির্ভর করে তুলেছে। দারকোট ছাড়াও, প্রায় ১২-১৩টি গ্রাম রয়েছে যেখানে প্রায় ৫০-৬০ জন মহিলা বিভিন্ন ধরনের পশমের পোশাক তৈরি করেন এবং পর্যটনের সঙ্গেও যুক্ত নানাভাবে। আজ তাঁরা প্রত্যেকে স্বাবলম্বী এবং নিজের পরিচয়ে পরিচিত।

Latest article